হাবিবুর রহমান মিছবাহ
প্রিন্সিপাল,মারকাযুত তাকওয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা।
যাদের সন্তানরা মূল্যবান খাবার নষ্ট করে সংকোচ ছাড়াই। হাজার টাকার নোট যাদের চা-পান'র বিল। এসি রুম বিনে যাদের ঘুম আসে না। নাস্তাকে যারা বলে ব্রেকফাস্ট! সে তারা কিভাবে পাহাড়ীয় নূন-মরিচের ভাষা বুঝবে? তারা এখন বাংলা খায় না, বাংলা কয় না, বাংলা তাদের সয়ও না।
এ সমস্ত অর্থলোভী পচনশীল চিন্তাবীদদের ধারণা, দিনমজুর স্বচ্ছ হৃদয়ের মানুষগুলো তাদের অর্থ-বিত্তের খুব মূল্যায়ন করে। কিন্তু তারা যদি জানতো বা উপলব্ধি করতো যে, গরীবরা তাদের অর্থাহংকার ও সম্পদকে কতোটা ঘৃণা করে, তুচ্ছ মনে করে সোফা-পালঙ্ককে, ঘৃণা করে তাদের ছোটমন ও বড়লোকী আচরণের, তাহলে তারা পাঁচতলার অহমিকায় গাছতলার মানুষদের দূর থেকেই সালাম জানাতো। ধনীদের প্রতি গরীবদের সম্মানজনক আচরণ তাদের দুর্বলতা নয়, বরং তাদের অর্থ না থাকলেও যে সুন্দর একটি মন আছে, তারই বহি:প্রকাশ।
ওদের মুখগুলো দেখে বেশ মায়া লেগেছিলো। দেখলাম সাথে অনেকগুলো দশ টাকার নোট রয়েছে। দশ টাকা কি করে দেই একটি বাচ্চার হাতে? দশ টাকা দিয়ে কিই বা পাওয়া যায়? চিন্তা করলাম, ওরা হয়তো এতেই খুশি হবে। চকলেট তো পাবে! দশ টাকা খুব কম হলেও ওরা সম্ভবত দু'টাকাও হাতে পায় না সচারাচর। সংকোচবোধ হলেও সিদ্ধান্ত নিলাম ওদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে নোট দিয়ে আসবো। ডাকলাম পাশের সব বাচ্চাদের। ওরা আমার সামনে জড়ো হলো।
হয়তো ওরাও আঁচ করতে পেরেছিলো কিছু হাদিয়া পাবে। তাই ওদের সে ফ্যাকাশে মুখগুলো চাঁদের হাসিতে ভরে উঠলো। আমার মনও নেচে উঠলো ওদের সে নির্মল হাসি আর আনন্দ দেখে। বিষয়টি এতো ভালো লেগেছিলো আমার কাছে, যা ভাষায় ব্যক্ত করা অসম্ভব। ওদের ডেকে ডেকে প্রত্যেকের হাতে একটি করে দশ টাকার নোট দিলাম। আমাদের সাথে আসরের নামাযে শরীক হওয়া সে প্রাপ্তবয়স্ক লোকটিও খুশিমনে দেখছে সব। অনুভব করলাম, মহিলারাও পর্দার আড়াল হতে কলিজার টুকরা সন্তানদের আনন্দ আর চারদিকে ছোটাছুটির দৃশ্য উপভোগ করছে।
পাহাড়ী পথে ক্ষুদে একজন রাহবারটি আছে আমাদের সাথে। পাহাড় বেয়ে নিচে নামার সহজ পথ দেখাতে রাহবারীর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। আমরা পাহাড়ের উঁচুতে দাঁড়িয়ে। খুব উঁচুতে। নিচে তাকাতেই কেমন যেনো কলিজা শুকিয়ে গেলো। পাদদেশের মানুষগুলো ছোট ছোট প্রাণীর মতো লাগছিলো। ভাবতেই পারছিলাম না আমরা এতো উঁচুতে কি করে উঠলাম। আমি তো প্রচন্ড ভয়ই পেয়ে গেলাম! এমন খাড়া পাহাড়। নিচে নামা ততোটা সহজ হবে না, যতোটা সহজ ছিলো উপরে ওঠা। হাত-পা কেমন নিস্তেজ হতে লাগলো। সফরসঙ্গীরা কেউই সাহস করছিলো না।
ইতোমধ্যে আমাদের পিচ্চি রাহবারটা চোখের পলকে নিচে নেমে গেলো! কিছুটা সাহস পেলাম। বুঝলাম, কখনো কখনো ছোটরাও সাহস যোগানোর উৎস হতে পারে। অভিজ্ঞতায়ও হতে পারে বড়। কেননা, জ্ঞানী হলেই যে আপনি সব কাজে পারদর্শী হবেন বিষয়টি এমন নয়। চাইলে মা'আজ ও মু'আওয়াজ রাদি. এর সেই আবু জাহেল বধ থেকেও ছোটদের মূল্যায়ন অনুধাবন করতে পারেন আপনি।
এবার নিচে নামতে শুরু করলাম আমরা। কাজটি মোটেও সহজ ছিলো না। মাটি-বালুর পাহাড়। আল্লাহ না করুন যে কোনো সময় পায়ের তলার মাটি ধসে যেতে পারে। অথবা কোনোভাবে একবার পা পিছলালেও আপনার ঠিকানা হয়তো হাসপাতাল, নয়তো শেষপাতাল। নামার পথে হঠাৎ থমকে গেলাম। দেখলাম রাহবারটি উপরে আসছে আমাকে ধরে নামামে বলে। এবার ও সত্যিই নিজেকে প্রকৃত অভিভাবক হিসেবেই জাহির করলো। ওর দায়িত্ববোধ আর সহমর্মিতা দেখে শিখেছি অনেক কিছু। ও কিন্তু ঐ অল্প সময় আমার বেশ ভক্ত হয়ে গিয়েছিলো। আমিও ওর।
পাহাড়ের মাঝ বরাবর আমরা দু'জন। জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কি এখান থেকে নিয়মিত ওঠা-নামা করো? হ্যাঁ। চালের বোস্তা, লাকড়ির আটিসহ বড় বোঝা কিভাবে উঠানো হয়? মালামাল মাথায় নিয়েই ওঠে। তবে আমাদের কেউ চালের বোস্তা আনে না তো! টাকা পাবে কোথায়! এক/দুই সের চাল আনতেই দিনশেষ। আমাদের কেউ কাজ দেয় না। আমরা নাকি অসামাজিক তাই। দিলেও মায়না কম। বলছিলো ক্ষুদে রাহবারটি। ভাবলাম, হৃদয়বান কোনো শিল্পপতির নজর কি এদের প্রতি পড়ে না! সরকারের কি কোনো দায়িত্ব নেই? হয়তো এ প্রশ্নগুলো আজীবন প্রশ্ন হয়েই থাকবে।
পাহাড়িয় লোকগুলো জিবিকা নির্বাহের তাগিদে নিয়মিত ঐ পাহাড় বেয়ে ওঠা-নামা করে। মাঝে মাঝে কেউ পড়ে যায় না? প্রশ্ন করলাম ওকে। বললো, পড়ে তো! মারাও যায়। কারো কারো হাত-পাও ভাঙ্গে। বৃষ্টির সময় এসব ঘটনা বেশী ঘটে।
নিচে নামলাম আল্লাহ তাআলার অশেষ মেহেরবানীতে। আরেকবার দেখে নিলাম পাহাড়টিকে। গাড়ীতে উঠবো। পিচ্চিটিকে কাছে ডাকলাম। আসলো। একেবারে গায়ের সাথে মিশে দাঁড়ালো। ক্ষণিকের জন্য মনে হলো, আমার সন্তান বিদায়বেলা আমার পাশে দাঁড়িয়ে গা ঘষছে। বললাম, আমার সাথে যাবে? পড়ালেখা করিয়ে আমার থেকেও বড় হুজুর বানাবো তোমাকে ইনশাআল্লাহ। বললো, আমার বাবার সাথে কাজ করবে কে? আমার বাবা একা পারেন না। আমরা দু'জন কাজ করে যা টাকা পাই, তা দিয়েই আমার মা ও ভাই-বোনের খাবার জোটে।
এভাবে দেশের বহু অবহেলিত অঞ্চল রয়েছে। যেখানের মানুষদের যথাযোগ্য কর্মসংস্থান নেই। তাই কম আয়ের মানুষগুলো সাংসারিক অভাব ঘুচাতে সন্তানকে শ্রমের সহযোগী করে নেয়। ফলে সন্তানের ভবিষ্যত হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। শিক্ষাবঞ্চিত হয় অসংখ্য সম্ভাবনাময় শিশু-কিশোর। সরকারের উচিত, দলীয় দৃষ্টিকোণ পরিহার করে, সার্বজনীন কর্মসংস্থান ও শিশুশিক্ষার ব্যবস্থা করা। দেশের অবহেলিত অঞ্চলগুলো চিহ্নিত করে, তার উন্নয়নের দিকে নজর দেয়া। দেশের প্রত্যেক অঞ্চলে সরকারী প্রাইমারী স্কুল রয়েছে। সেগুলোর সঠিক তদারকি হচ্ছে না। নেই গুণগত শিক্ষা। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় সঠিক পাঠদান হলে, গরীব বাবার সন্তানদের আলাদা টিউশনির প্রয়োজন ছিলো না। টিউশন ফী জোগাড় করতে অনেক বাবার বাড়তি শ্রম দিতে হয়।
সরকারী প্রাথমিকে যথাযথ শিক্ষা নেই বিধায় প্রাইভেট স্কুলের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। আর প্রাইভেট শিক্ষালয়ে আকাশচুম্বি খরচ থাকায় গরীব কোমলমতিদের বাধ্য হয়েই সরকারীতে পড়তে হয়। সরকারী প্রাথমিকে শিক্ষার সঠিক পরিচর্যা না থাকায়, ঐ সমস্ত শিশুদের মেধা বিকশিত হওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য সরকারী স্কুলগুলো দায়িত্ববান ব্যক্তিদের পরিচালনায় দেয়া উচিত। শিশুদের জন্য সরকারীভাবে প্রাইমারী শিক্ষালয় থাকলেও নেই আরবী শিক্ষা ব্যবস্থা। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক গণশিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও, তাতে শুধু মাসিক বেতন লেনদেনই কার্যকর রয়েছে। শিক্ষা নেই। আর সে শিক্ষার যে কারিকুলাম, তা একজন মুসলমানের ইসলামী জেন্দেগী পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়। সুবিধাবঞ্চিত, অবহেলিত ও গরীব শিশুদের আরবী ও জেনারেল শিক্ষার নিশ্চয়তা নিশ্চিতকরণের দায়িত্ব সরকারেরই। আজকের শিশু, আগামী দিনের ভবিষ্যত। এদের হাতেই শোভা পাবে দেশের পতাকা। এরাই প্রতিনিধিত্ব করবে ৫২ হাজার বর্গ মাইলের। এরাই আগামীর গাজ্জালী, থানবী বা মাদানী। তাই শিশুর সুশিক্ষা নিশ্চিত করুন। আগামীর সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলুন।
[টিভি টকশো আলোচনা, সমালোচনা ও একটি পর্যালোচনা]
এসএস/