ইমাম মালিক রহ. এর জীবন কর্ম
মহান ইমামদের চিন্তাধারা ও শরিয়ত বিধিবদ্ধকরণের প্রক্রিয়া এই স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয়। ইসলামি শরিয়ত বিধিবদ্ধকরণের ক্ষেত্রে কী ধরনের জ্ঞানের গভীরতা, যুক্তি ও জীবনঘনিষ্ঠ চিন্তাধারা অনুশীলন করা হয়েছে তার কিছু নমুনামাত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এখানে।
অনুসন্ধিৎসু পাঠকসমাজকে ইসলামের মননশীলতা ও যুক্তিশীলতা অনুধাবনে সহায়তা করাই আমাদের লক্ষ্য। বিভিন্ন প্রামাণ্য গ্রন্থ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এ পর্বটি সংকলন করা হয়েছে।
ইমাম মালিক ইবনে আনাস রহ. আরবের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ইসলামের আবির্ভাবের আগে ও পরে আরবে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মর্যাদার অধিকারী ছিল। এই পরিবারের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন ইয়েমেন থেকে। ইমাম মালিক রহ. ছিলেন মহানবী সা.-এর পূর্ণ অনুসারী। সমগ্র জীবনব্যাপী জ্ঞান-গবেষণা ও মহান আল্লাহর ‘ইবাদত বন্দেগীতে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর ছিয়াশি বছরের জীবন ছিল একটি আলোকোজ্জ্বল জীবন।
নাম ও বংশ :
নাম- মালিক, উপনাম-আবূ আবদুল্লাহ। বংশপরম্পরা- মালিক ইবনু আনাস ইবনু আবূ ‘আমির ইবনু আমর ইবনু হারিস আল আসবাহী। তিনি আরবের প্রসিদ্ধ কাহত্বান গোত্রের উপগোত্র আসবাহ-এর অন্তর্ভুক্ত, এ জন্য তিনি ‘আল আসবাহী’ বলে পরিচিত।
জন্ম ও প্রতিপালন :
ইমাম মালিক রহ. পবিত্র মদীনা নগরীতে এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষানুরাগী মুসলিম পরিবারে জন্মলাভ করেন। জন্মের সন নিয়ে কিছু মতামত থাকায় ইমাম যাহাবী রহ. বলেন : বিশুদ্ধ মতে ইমাম মালিক রহ.-এর জন্ম সন হল ৯৩ হিজরী, যে সনে রাসূলুল্লাহ সা.-এর খাদেম আনাস বিন মালিক রা. মৃত্যুবরণ করেনই।
তিনি পিতা আনাস বিন মালিকের কাছে মদীনায় প্রতিপালিত হন। তাঁর পিতা তাবে-তাবেঈ ও হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন, যার কাছ থেকে ইমাম যুহুরীসহ অনেকেই হাদীস বর্ণনা করেন। খুদ ইমাম মালিকও পিতার নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেন। তাঁর দাদা আবূ আনাস মালিক রহ. প্রসিদ্ধ তাবেঈ ছিলেন, যিনি ওমার, আয়িশা ও আবু হুরায়রা রা. হতে হাদীস বর্ণনা করেন। তাঁর পিতামহ আমির বিন আমর রা প্রসিদ্ধ সাহাবী ছিলেন। এ সম্ভ্রান্ত দ্বীনী পরিবেশে জ্ঞানপিপাসা নিয়েই তিনি প্রতিপালিত হন।
শিক্ষা জীবন :
রাসূল সা.-এর হিজরতের পর হতে আজও পর্যন্ত দ্বীনী জ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্র হলো মদীনা। সে মদীনাতে জন্মলাভ করার অর্থ হল দ্বীনী জ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্রেই জন্ম লাভ করা। বিশেষ করে বংশীয়ভাবে তাঁদের পরিবার ছিল দ্বীনী জ্ঞানচর্চায় অগ্রগামী। এজন্য তিনি শৈশবকাল হতেই শিক্ষা শুরু করেন। বিশেষ করে তাঁর মাতা তাকে শিক্ষার প্রেরণা যোগান।
ইমাম মালিক রহ. বলেন : আমি একদিন মাকে বললাম, ‘‘আমি পড়ালিখা করতে যাব! মা বললেন : আস শিক্ষার লেবাস পড়, অতঃপর আমাকে ভাল পোষাক পড়ালেন, মাথায় টুঁপি দিলেন এবং তার উপর পাগড়ী পড়িয়ে দিলেন, এরপর বললেন : এখন পড়া লিখার জন্য যাও। তিনি বলেন : মা আমাকে ভালভাবে কাপড় পড়িয়ে দিয়ে বলতেন : যাও মদীনার প্রসিদ্ধ আলিম রাবিয়াহর কাছে এবং তাঁর জ্ঞান শিক্ষার আগে তাঁর আদব আখ্লাক শিক্ষা কর।
এভাবে তিনি মদীনার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, ফকীহদের নিকট হতে শিক্ষালাভ করেন।
ইমাম মালিকের রহ. শিক্ষক বৃন্দ :
ইমাম মালিক রহ. অসংখ্য বিদ্যানের নিকট শিক্ষালাভ করেন। ইমাম যুরকানী রহ. বলেন : ‘‘ইমাম মালিক রহ. ৯০০ এর অধিক শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। বিশেষ করে ইমাম মালিক স্বীয় গ্রন্থ মুয়াত্ত্বায় যে সব শিক্ষক হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাদেরই সংখ্যা হল ১৩৫ জন, যাদের নাম ইমাম যাহাবী ‘‘সিয়ার’’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন নিম্নরূপ : ১. ইমাম রাবীয়া বিন আবূ আবদুর রহমান রহ.। ২. ইমাম মুহাম্মদ বিন মুসলিম আয্যুহুরী রহ.। ৩. ইমাম নাফি মাওলা ইবনু ওমার রহ.। ৪. ইব্রাহীম বিন উক্বাহ রহ.। ৫. ইসমাঈল বিন মুহাম্মদ বিন সা’দ রহ.। ৬. হুমাইদ বিন কায়স আল ‘আরজ রহ.। ৭. আইয়ূব বিন আবী তামীমাহ আসসাখতিয়ানী রহ. ইত্যাদি।
ইমাম মালিক রহ.-এর ছাত্র বৃন্দ :
ইমাম মালিক রহ. হলেন ইমামু দারিল হিজরাহ, অর্থাৎ মদীনার ইমাম। অতএব মদীনার ইমামের ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য কে না চায়। তাই তাঁর ছাত্র অগণিত। ইমাম যাহাবী উল্লেখযোগ্য ১৬৬ জনের নাম বর্ণনা করেছেন। ইমাম খাতীব বাগদাদী ৯৯৩ জন উল্লেখ করেন।
ইমামের প্রসিদ্ধ কয়েকজন ছাত্রের নাম নিম্নে প্রদত্ত্ব হল : ১. ইমাম মুহাম্মদ বিন ইদ্রীস আশ্শাফেঈ রহ.।২. ইমাম সুফাইয়ান বিন উয়ায়নাহ রহ.। ৩. ইমাম আব্দুল্লাহ বিন মুবারক রহ.। ৪. ইমাম আবু দাউদ আত্তায়ালিসী রহ.। ৫. হাম্মাদ বিন যায়দ রহ.। ৬. ইসমাঈল বিন জাফর রহ.। ৭. ইবনু আবী আযযিনাদ রহ. ইত্যাদি।
জ্ঞান গবেষণায় ইমাম মালিক রহ.
ইমাম মালিক রহ. জন্মগতভাবেই অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। মেধা শক্তি ছিল খুবই প্রখর। আবূ কুদামাহ বলেন: ‘‘ইমাম মালিক স্বীয় যুগে সর্বাধিক মেধা শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন।
হুসাইন বিন উরওয়াহ হতে বর্ণিত : তিনি বলেন : ‘‘ইমাম মালিক বলেন : একদা ইমাম যুহুরী রহ. আমাদের মাঝে আসলেন, আমাদের সাথে ছিলেন রাবীয়াহ। তখন ইমাম যুহুরী রহ. আমাদেরকে চল্লিশের কিছু অধিক হাদীস শুনালেন। পরেরদিন আমরা ইমাম যুহুরীর কাছে আসলাম, তিনি বললেন : কিতাবে দেখ আমরা কি পরিমান হাদীস পড়েছি, আরো বললেন, গতকাল আমরা যে হাদীস বর্ণনা করেছি, তোমরা কি কিছু পড়েছ? তখন রাবীয়া বললেন : হ্যাঁ, আমাদের মাঝে এমনও ব্যক্তি আছেন যিনি গতকাল আপনার বর্ণনাকৃত সব হাদীস মুখস্ত শুনাতে পারবেন।
ইমাম যুহুরী বললেন : কে তিনি? রাবিয়া বললেন : তিনি ইবনু আবী আমীর অর্থাৎ ইমাম মালিক। ইমাম যুহুরী বললেন : হাদীস শুনাও, ইমাম মালিক বলেন : আমি তখন গতকালের চল্লিশটি হাদীস মুখস্ত শুনালাম।
ইমাম যুহুরী বলেন : আমার ধারণা ছিল না যে, আমি ছাড়া এ হাদীসগুলো এভাবে আর দ্বিতীয় কেউ মুখস্ত করেছে। অতএব ইমাম মালিক রহ.-এর অসাধারণ পান্ডিত্বের সাথে গভীরভাবে জ্ঞান গবেষণা ও সংরক্ষণ সম্পর্কে আর বেশী কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না।
হাদীস শাস্ত্রে ইমাম মালিক রহ.
হাদীস শাস্ত্রে ইমাম মালিক রহ. এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, হাদীস সংকলনে অগ্রনায়ক। মযদিও তাঁর পূর্বে কেউ কেউ হাদীস সংকলন করেন, যেমন ইমাম যুহুরী, কিন্তু ইমাম মালিক রহ.-এর হাদীসের সাধনা, সংগ্রহ ও সংকলন ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
এজন্যই তাঁর সংকলিত গ্রন্থকে বলা হয়, ‘‘আল্লাহর কিতাব কুরআনের পর সর্ববিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ ইমাম মালিকের মুয়াত্ত্বা গ্রন্থ। তিনি হাদীস শিক্ষায় পারিবারিকভাবে উৎসাহী হলেও তাঁর অসাধ্য সাধন এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে অনেক অগ্রসর হয়েছেন। শয়নে স্বপনে সব সময় একই চিন্তা, কিভাবে তিনি হাদীস শিক্ষালাভ করবেন। মানুষ যখন অবসরে তখন তিনি হাদীসের সন্ধানে।
ইমাম মালিক একদাঈদের সালাতে ইমাম যুহুরীকে পেয়ে মনে করলেন, আজ মানুষ ঈদের আনন্দে ব্যস্ত, হয়ত ইমাম যুহুরীর কাছে একাকী হাদীস শিক্ষার সুযোগ পাওয়া যাবে। ঈদের ময়দান হতে চললেন ইমাম যুহুরীর বাসায়, দরজার সামনে বসলেন, ইমাম ভিতর থেকে লোক পাঠালেন গেটে দেখার জন্য, ইমামকে জানানো হল যে, গেটে আপনার ছাত্র মালিক, ইমাম বললেন : ভিতরে আসতে বল। ইমাম মালিক বলেন, আমি ভিতরে গেলাম। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মনে হয় তুমি সালাতের পর বাড়ীতে যাওনি? আমি বললাম : হ্যাঁ যাইনি, জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু খেয়েছ কি? আমি বললাম : না, তিনি বললেন : খাও, আমি বললাম : খাওয়ার চাহিদা নেই। তিনি বললেন, তাহলে তুমি কি চাও? আমি বললাম : আমাকে হাদীস শিখান, অতঃপর তিনি আমাকে সতেরটি হাদীস শিখালেন।
ইমাম মালিক রহ. বেশীভাগ সময় একাকী থাকা পছন্দ করতেন, তাঁর বোন পিতার কাছে অভিযোগ করলেন, আমাদের ভাই মানুষের সাথে চলাফিরা করে না। পিতা জবাব দিলেন : মা তোমার ভাই রাসূল সা.-এর হাদীস মুখস্ত করায় ব্যস্ত, তাই একাকী থাকা পছন্দ করে। হাদীস সংগ্রহে কঠোর সতর্কতা: ইমাম মালিক রহ. হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহে সদা ব্যস্ত হলেও যেখানেই বা যার কাছেই হাদীস পেলে তিনি তা গ্রহণ করতেন না, যতক্ষণ না হাদীস বর্ণনাকারীর ঈমান-আক্বীদাহ ও সততা সম্পর্কে অবগত হতে পারতেন। বিশ্বস্ত প্রমাণিত হলে হাদীস গ্রহন করতেন।
ইমাম সুফাইয়ান ইবনু উইয়ায়না রহ. বলেন : ‘‘আল্লাহ তা’আলা ইমাম মালিককে রহম করুন, তিনি হাদীসের বর্ণনাকারীর ব্যাপারে খুব কঠিনভাবে যাচাই বাছাই করতেন (সহজেই কারো হাদীস গ্রহণ করতেন না)।’’ আলী বিন মাদীনী রহ. বলেন : ‘‘হাদীস গ্রহণে কঠোর নীতি ও সতর্কতায় ইমাম মালিকের ন্যায় আর কেউ আছে বলে আমি জানিনা।’’
ইমাম মালিক বিদ’আতীদের থেকে হাদীস গ্রহণ করতেন না। এ সতর্কতা শুধু তিনি নিজেই অবলম্বন করেননি, বরং তিনি অন্যদেরকেও গুরুত্বারোপের নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেন : ‘‘হাদীস হল দ্বীনের অন্যতম বিষয়, অতএব ভালভাবে লক্ষ কর তোমরা কার নিকট হতে দ্বীন গ্রহণ করছ। আমি সত্তর জন এমন ব্যক্তি পেয়েছি যারা রাসূল সা.-এর নামে হাদীস বর্ণনা করে, কিন্তু আমি তাদের কিছুই গ্রহণ করিনি। যদিও তারা অর্থ সম্পদে আমানতদার হয়, কিন্তু এ বিষয়ে তাদেরকে আমি যোগ্য মনে করিনি। অথচ আমাদের মাঝে ইমাম যুহুরীর আগমন হলে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহে আমরা তাঁর দরবারে ভীর জমাতাম’’।
সুতরাং ইমামু দারিল হিজরা বা মাদীনার ইমাম মালিক রহ. রাসূল সা.-এর হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহে যেমন জীবন উৎসর্গ করেছেন, তেমনি হাদীস সংরক্ষণে খুব কঠোর ভূমিকা রেখেছেন।
হাদীস পালনে ইমাম মালিক রহ.
হাদীস শুধু কিতাবের পাতায় নয়, বরং তা বাস্তবে পালনের অন্যতম দৃষ্টান্ত হলেন ইমাম মালিক রহ. আব্দুল্লাহ বিন বুকাইর বলেনঃ আমি ইমাম মালিককে বলতে শুনেছি তিনি বলেন : ‘‘আমি কোন আলিমের কাছে যখন বসেছি। অতঃপর তার কাছ হতে বাড়ীতে আসলে তার কাছে শুনা সব হাদীস মুখস্ত করে ফেলি এবং ওই হাদীসগুলির মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত বা আমল না করা পর্যন্ত ওই আলিমের বৈঠকে ফিরে যাইনি।’’
হাদীস শিক্ষাদান ও ফতোয়া প্রদান:
ইমাম মালিক রহ. শুধু হাদীস শিক্ষা ও আমল করেই ক্ষান্ত হননি, বরং শিক্ষার পাশাপাশি মানুষকে শিক্ষা দান ও ফতোয়া প্রদানে বিড়াট অবদান রেখেছেন।
ইমাম যাহাবী রহ. বলেন : ইমাম মালিক রহ. ২১ বছর বয়সে হাদীসের পাঠদান ও ফতোয়া প্রদানে পূর্ণ যোগ্যতা লাভ করেন। ইমাম মালিক রহ. বলেন : ইচ্ছা করলেই শুধু হাদীস শিক্ষা ও ফতোয়া প্রদানের জন্য মসজিদে বসা যায় না, রবং এ ক্ষেত্রে যোগ্য ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ নিতে হবে, তারা যদি উপযুক্ত মনে করেন তাহলে এ কাজের জন্য নিয়োজিত হতে পারে। সত্তর জন বিজ্ঞ পন্ডিত- শাইখের আমার ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদানের পর আমি এ কাজে নিয়োজিত হই। মুস্‘আব বিন আব্দুল্লাহ বলেন ‘‘ইমাম মালিককে কোন হাদীস জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি অযূ করে ভাল পোষাক পড়ে সুন্দরভাবে প্রস্ত্ততি নিতেন, তাঁকে এরকারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জবাবে বলেন : এ হল রাসূল সা.-এর হাদীসের জন্য সম্মান প্রদর্শন।’’
সারা মুসলিম বিশ্ব হতে শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র মদীনায় জ্ঞান পিপাসুরা শিক্ষার জন্য পাড়ি জমান এবং ইমাম মালিকের মত মুহাদ্দিসের নিকট হতে হাদীস শিক্ষালাভ করে ধন্য হতেন। ইমাম মালিক রহ. ফতোয়া প্রদানেও যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করতেন। জটিল বিষয়গুলো দীর্ঘ গবেষণার পর ফতোয়া প্রদান করতেন। ইবনু আব্দুল হাকীম বলেন : ‘‘ইমাম মালিককে রহ. কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি প্রশ্নকারীকে বলতেন যাও আমি ওই বিষয়ে চিন্তা- গবেষণা করি।’’
আব্দুর রহমান বিন মাহদী বলেন : ইমাম মালিক বলেন, ‘‘কখনও এমন মাস‘আলা এসেছে যে, চিন্তা-গবেষণা করতে আমার গোটারাত কেটেগেছে।’’ ইমাম মালিক রহ.কোন বিষয় উত্তর না দেয়া ভাল মনে করলে ‘‘জানি না’’ বলতেও কোন দ্বিধাবোধ করতেন না। কারণ তিনি মনে করতেন প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া মানে জান্নাত ও জাহান্নামের সম্মুখীন হওয়া। প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে যেন আখিরাতে জবাব দিহিতার সম্মুখীন হতে না হয়।
সঠিক আক্বীদাহ বিশ্বাসে ইমাম মালিক রহ. আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আক্বীদাহ-বিশ্বাসের অন্যতম ইমাম হলেন ইমাম মালিক রহ.। বিশেষ করে আল্লাহ তা’আলার সিফাত গুণাবলীর প্রতি ঈমানের যে ক্বায়দা বা নীতি ইমাম মালিক রহ. মুতাযিলাদের প্রতিবাদে বর্ণনা করেন, সেটাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের নীতি। যেমন ইমাম ইবনু আবিল ইয্ আল হানাফী শারহুল আক্বীদাহ আতম তাহাবিয়ায় উল্লেখ করেন। কুরআনুলকারীম ও সহীহ হাদীসের আলোকে ইমাম মালিক রহ. ঈমান আক্বীদাহর সকল বিষয়ে হকপন্থীদের সাথে একমত ছিলেন।
ইমাম মালিক রহ. সম্পর্কে আলিম সমাজের প্রশংসা :
১. ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন : ‘‘আলিম সমাজের আলোচনা হলে ইমাম মালিক তাদের মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্র, কেউ ইমাম মালিকের স্মৃতিশক্তি, দৃঢ়তা, সংরক্ষণশীলতা ও জ্ঞানের গভীরতার সমপর্যায় নয়। আর যে ব্যক্তি সহীহ হাদীস চায় সে যেন ইমাম মালিকের কাছেযায়।
২. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. বলেন : ‘‘বিদ্যানদের অন্যতম একজন ইমাম মালিক, তিনি হাদীস ও ফিকাহ শাস্ত্রে একজন অন্যতম ইমাম, জ্ঞান-বুদ্ধি ও আদাব আখলাকসহ হাদীসের প্রকৃত অনুসারী ইমাম মালিকের মত আর কে আছে?
৩. ইমাম নাসায়ী রহ. বলেন : ‘‘তাবেঈদের পর আমার কাছে ইমাম মালিকের চেয়ে অধিক বিচক্ষণ আর কেউ নেই এবং হাদীসের ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে অধিক আমানতদার আমার কাছে আর কেউনেই।
ইমাম মালিকের রহ. রচিত গ্রন্থাবলী:
ইমাম মালিক রহ.-এর বেশ কিছু রচনাবলী রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল : ১. আল মুয়াত্ত্বা। হাদীসের জগতে কিছু ছোট ছোট সংকলন শুরু হলেও ইমাম মালিকের ‘মুয়াত্ত্বা’ সর্ব প্রথম হাদীসের উল্লেখযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য সংকলন। এ গ্রন্থে ইমাম মালিক রহ. রাসূল সা.-এর হাদীস, সাহাবী ও তাবেঈদের হাদীস এবং মদীনাবাসীর ইজমা সহ অনেক ফিকহী মাসআলা বিশুদ্ধ সনদের আলোকে সংকলন করেন। তিনি দীর্ঘদিন সাধনার পর, কেউ বলেন ৪০ বৎসর সাধনার পর এ মূল্যবান গ্রন্থ সংকলন করেন। সে সময় বিশুদ্ধতার দিক দিয়ে হাদীসের গ্রন্থ ‘মুয়াত্ত্বা’ খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন : ‘‘কিতাবুল্লাহ অর্থাৎ কুরআন এর পরই সর্ব বিশুদ্ধ গ্রন্থ হল ইমাম মালিকের ‘‘মুয়াত্ত্বা’’। হ্যাঁ, সহীহ বুখারীর সংকলনের পূর্বে মুয়াত্ত্বাই সর্ব বিশুদ্ধ গ্রন্থ ছিল। অবশ্য এখন সহীহ বুখারী সর্ববিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ।
২. ‘‘কিতাবুল মানাসিক’’ ৩. ‘‘রিসালাতুন ফিল কাদ্র ওয়ার্রাদ আলাল কাদারিয়া’’। ৪. ‘‘কিতাব ফিন্নুজুমি ওয়া হিসাবি মাদারিয্যামানি ওয়া মানাযিলিল কামারি’’। ৫. ‘‘কিতাবুস সিররি’’। ৬. ‘‘কিতাবুল মাজালাসাত’’। ইত্যাদি সহীহ সনদে প্রমাণিত যে, এ সব ইমাম মালিক রহ.-এর সংকলিত ও রচিত গ্রন্থ। ইহা ছাড়াও আরো অনেক গ্রন্থ রয়েছে।
ইমাম মালিক রহ.-এর ইন্তেকাল :
ইমাম মালিক রহ. ১৭৯ হিঃ রবিউল আউয়াল মাসে ৮৬ বছর বয়সে মদীনা মুনাওয়ারায় মৃত্যুবরণ করেন। এবং তাকে মদীনার কবরস্থান ‘‘ জান্নাতুল বাকী’’তে দাফন করা হয়। আল্লাহ তাঁকে রহম করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে স্থান দান করুন। আমীন!
এআরকে
বাংলাদেশকে শান্তির প্রতীক হিসেবে গ্রহণ কর: জুমার খুতবায় মদিনার ইমাম