বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড- বেফাক। বাংলাদেশের কওমি মাদরাসা জাতীয় বোর্ড। কওমি শিক্ষাব্যবস্থায় এক যুগান্তকরি পরিবর্তন সাধন করেছে বেফাক। উন্নত করেছে এর নীতিমালা। শিক্ষার মান-কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রণয়নে বেফাকের রয়েছে অসামান্য অবদান। ব্যবস্থাপনা, শুদ্ধ মাতৃভাষা অন্তর্ভুক্তকরণ ও অবশ্যপাঠ্যে উন্নীত করা, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় ইত্যাদি। বেফাক বাংলাদেশের কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। বেফাকের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে দেশের শতকরা আশি ভাগ মাদরাসা। একটা অভূতপূর্ব শৃঙ্খলাও ফিরে এসেছে। তাই দীর্ঘদিন ধরেই এ কওমি শিক্ষাব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আওতায় আনতে সরকারের যেমন আন্তরিকতা লক্ষ করা যায়, তেমনি কওমিদের চেষ্টা-তদবিরেও কমতি নেই। এর বিভিন্ন দিক ও ‘কওমি সনদের স্বীকৃতি’ নিয়ে ৬ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার বেফাক মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জব্বার জাহানাবাদীর মুখোমুখি হয়েছেন আওয়ার ইসলামের বিশেষ প্রতিবেদক জাকির মাহদিন। সঙ্গে ছিলেন তানজিল আমীর।
জাকির মাহদিন : ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’ কওমি মাদরাসাগুলোর জন্য কী অবদান রেখেছে?
মাওলানা আব্দুল জব্বার : অতীতে কওমি মাদরাসার কোনো বোর্ড না থাকায় একেক মাদরাসায় একেক পাঠ্যসূচি ও নিয়ম-নীতি চালু ছিল। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। শিক্ষার মান উন্নয়নের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড-বেফাককে আমরা সারাদেশের কওমি মাদরাসাসমূহের একটা বোর্ড হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকি। মূলত এটা একটা জাতীয় সংস্থা। বেফাক গঠনের পর আমরা কওমি মাদরাসাগুলোর সুনির্দিষ্ট পাঠ্যসূচি ও নিয়ম-নীতি প্রবর্তন করেছি, শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। এতে শিক্ষার মান অনেক উন্নত হয়েছে। আজ যদি কওমি মাদরাসাগুলোর জন্য বেফাকের মতো একটি জাতীয় সংস্থা ও বোর্ড না থাকতো তাহলে হয়তো এ শিক্ষাঙ্গনগুলোতে স্বাভাবিক শান্তিশৃঙ্খলা থাকতো না।
জাকির মাহদিন : সম্প্রতি ‘কওমি সনদের স্বীকৃতি’ নিয়ে একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ঘোষণা দিয়েছেন এবং মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যেও যে আবেগ-উচ্ছ্বাসের বান ডেকেছে, এক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা ও মতামত কী?
মাওলানা আব্দুল জব্বার : প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে আমরা স্বাগত জানাই এবং এ পর্যন্ত যারা এ নিয়ে কাজ করেছেন, দৌড়ঝাঁপ করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই। আমরা অবশ্যই স্বীকৃতি চাই। তবে সরকারের নিয়ন্ত্রণ চাই না। কারণ সরকারের কথিত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি আর আমাদের শিক্ষানীতি সম্পূর্ণ আলাদা। দারুল উলুম দেওবন্ধের স্বীকৃতি আছে, কিন্তু সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করে না। আর যেহেতু বেফাকই একমাত্র কওমি মাদরাসাগুলোর সার্থক প্রতিনিধিত্বকারী, সর্ববৃহৎ শিক্ষাবোর্ড, সুতরাং এর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও সমন্বয় ছাড়া স্বীকৃতি ফলপ্রসূ হতে পারে বলে আমাদের মনে হয় না।
বেফাক মানে ঐক্যবদ্ধ। ‘বেফাক’ অর্থ একতা। এটা শুধু একটা বোর্ড না। আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি। রাজধানীতে আমাদের কেন্দ্রীয় অফিস, কার্যক্রম ও প্রয়োজনীয় লোকবল আছে। নিজস্ব জায়গা-জমি আছে। সারাদেশের কওমি মাদরাসার সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ, সমন্বয়, পরিচালনা, জনসংযোগ ও ব্যাপক জনসমর্থন আছে যা অন্যদের নেই। বেফাককে আমরা একটা বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি চাই।
জাকির মাহদিন : সরকার স্বীকৃতির পাশাপাশি অনাকাঙ্ক্ষিত নিয়ন্ত্রণও আরোপ করতে চান তা আপনারা কিভাবে ধারণা করলেন?
মাওলানা আব্দুল জব্বার : কারণ সরকারের ঘোষণা বা মনোভাব স্পষ্ট নয় এবং বেফাকই কওমি মাদরাসাগুলোর সর্ববৃহৎ ও একমাত্র সার্থক প্রতিনিধিত্বকারী হলেও সরকার বেফাকের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করছে না, বরং সরকারের আজ্ঞাবহ কিছু লোকের মাধ্যমে স্বীকৃতির ব্যাপারটি সেরে ফেলতে চাচ্ছে পরিণামে যা ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। তাই আমরা মনে করি বেফাকের মতামত ও নেতৃত্ব ছাড়া স্বীকৃতির বিষয়টি মঙ্গল বয়ে আনবে না।
জাকির মাহদিন : সরকার যদি স্বায়ত্বশাসনের পাশপাশি স্বীকৃতি দেয়...
মাওলানা আব্দুল জব্বার : আমরা সেটাই চাই। তবে সেটা বেফাকের নামে হতে হবে। কারণ বেফাক মানে ঐক্যবদ্ধ। ‘বেফাক’ অর্থ একতা। এটা শুধু একটা বোর্ড না। আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি। রাজধানীতে আমাদের কেন্দ্রীয় অফিস, কার্যক্রম ও প্রয়োজনীয় লোকবল আছে। নিজস্ব জায়গা-জমি আছে। সারাদেশের কওমি মাদরাসার সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ, সমন্বয়, পরিচালনা, জনসংযোগ ও ব্যাপক জনসমর্থন আছে যা অন্যদের নেই। বেফাককে আমরা একটা বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি চাই। এই প্রস্তাবনা আমরা সরকারের কাছে দিয়ে রেখেছি।
জাকির মাহদিন : শুধুমাত্র বেফাককে স্বীকৃতি দিলে অন্যান্য বোর্ড কি তা মেনে নেবে?
মাওলানা আব্দুল জব্বার : অন্যান্য বোর্ডের সঙ্গে আমরা বেফাককে সমন্বিত করব। তাদেরকে সম্মানজনকভাবে এতে অন্তর্ভুক্ত করব। শুরু থেকেই আমরা অন্যান্য বোর্ড ও সক্রিয় ব্যক্তিগণকে এ আহ্বান জানিয়ে আসছি। এখনো জানাই। সবাইকে ধারণ ও সমন্বয় করার সামর্থ্য আমাদের আছে। ইদানিং স্বীকৃতির ব্যাপারে অনেককেই উৎসাহী ও সক্রিয় দেখা যায়, এটা খুবই ভালো। আমরা তাদের উদ্যোগ ও মেহনতকে স্বীকার করি। তবে শুরু থেকে মূলত আমরাই স্বীকৃতি নিয়ে মাঠে ছিলাম, এখনো তাই আছি।
নেতৃত্বে কোনো সমস্যা নেই। হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম সাহেব এ বোর্ডের চেয়ারম্যান। তার নেতৃত্ব মেনে নিতে বেফাক এবং অন্যকারো কোনো আপত্তি নেই। বেফাক সম্পর্কে মাওলানা আহমদ শফীর বক্তব্য এবং আমাদের বক্তব্য একই। সুতরাং এ সম্পর্কে তার সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই।
জাকির মাহদিন : বেফাকের আওতাধীন সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে যেসব মাদরাসা আছে, সেগুলোর স্থানীয় সমস্যা, ফান্ডিং, শিক্ষার মানোন্নয়ন ইত্যাদির ক্ষেত্রে পরিদর্শন, দিক-নির্দেশনা, কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদের মাসিক/ত্রৈমাসিক সশরীরে উপস্থিতি এবং নীতিমালা কতটুকু আছে?
মাওলানা আব্দুল জব্বার : বেফাক পরিচালিত মাদরাসাগুলোর সবরকম সমস্যা মোকাবেলা করা এবং শিক্ষাব্যবস্থা ও অন্যান্য দিক দেখাশুনা করার জন্য জেলা ও থানা পর্যায়ে বেফাকের কমিটি আছে। কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিগণ নিয়মিত যাতায়াত করেন। আমাদের একটা টিম আছে, পরিদর্শক টিম। এ টিম উক্ত কাজগুলো করে থাকে। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জনগণের সঙ্গে তারা মতবিনিময় করেন। ছাত্রদের নসিহত করেন, সমস্যা পর্যালোচনা করে আমাদের অবহিত করেন। আমরা সে আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
জাকির মাহদিন : ‘কওমি মাদরাসা শিক্ষার স্বীকৃতি’ নিয়ে এ মুহূর্তে মূল সমস্যা কী, নেতৃত্ব?
মাওলানা আব্দুল জব্বার : না, নেতৃত্বে কোনো সমস্যা নেই। হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম সাহেব এ বোর্ডের চেয়ারম্যান। তার নেতৃত্ব মেনে নিতে বেফাক এবং অন্যকারো কোনো আপত্তি নেই। বেফাক সম্পর্কে মাওলানা আহমদ শফীর বক্তব্য এবং আমাদের বক্তব্য একই। সুতরাং এ সম্পর্কে তার সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই।
আরো পড়ুন: কওমি শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বীকৃতি প্রসঙ্গে
১৭ অক্টোবর বেফাকের জাতীয় ওলামা সম্মেলন
সাক্ষাৎকারটি অপূর্ণাঙ্গ, দ্বিতীয় পর্ব আসছে কাল...
আরআর