জহির উদ্দিন বাবর: অস্থির এই সময়ে পৃথিবীজুড়ে বাহ্যিক উপায়-উপকরণের কোনো কমতি নেই। সভ্যতার চোখ ধাঁধাঁনো উন্নতি আমাদের কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। এক সময় মানুষ যা চিন্তা করারও সাহস করেনি এখন এর অনেক কিছুই বাস্তব। সভ্যতার উৎকর্ষের গতি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু তবুও পৃথিবীতে কিসের যেন অভাব। একটি অপূর্ণতা কুরে কুরে খাচ্ছে মানবসভ্যতাকে। এগিয়ে যাওয়ার সব সরঞ্জামই আছে, কিন্তু নেই মানবতাবোধ।
বাহ্যিকভাবে মানুষের কোনো কমতি নেই; কিন্তু মনুষ্যত্ববোধের অভাব। আকারে-প্রকারে মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও বাড়ছে না মানবতাবোধ। সবার মধ্যে খাই খাই ভাব। ‘আরও চাই’, ‘আরও চাই’ এর অসম প্রতিযোগিতা। কে কত ভোগ করতে পারে এটাই যেন এখন মানবজন্মের পরম সার্থকতা! সভ্যতার নৈরাজ্যময় এই পরিস্থিতিতে পরের কথা ভাববে; সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার স্লোগানকে ধারণ করবে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই নগণ্য।
বিংশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ খ্যাত আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. ছিলেন বিরলপ্রজ সেই মানুষদের একজন। জীবনভর মানবতাবাদকে সমুজ্জ্বল করার মহান মিশন নিয়ে কাজ করেছেন। ১৯৭৪ সালে ‘রিসালাতুল ইনসানিয়াহ’ বা মানবতার ডাক নামক সংগঠনটির গোড়াপত্তন করেন তিনিই। এটি গতানুগতিক কোনো সংগঠন নয়। পদ-পদবি, নেতৃত্বের টানাপোড়েন আর সস্তা খ্যাতির পেছনে কখনও ছুটেনি এই সংগঠন। ‘রিসালাতুল ইনসানিয়াহ’র মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের ভেতরে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলা, পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসা, ঐক্য ও সংহতি, মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকানো। আর্ত-মানবতার সেবা, মানবজন্মের প্রকৃত উদ্দেশ্যের সঙ্গে পরিচিত করানো। সামাজিক অসমতা, অঙ্গতি, অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করা। জুলুম ও নৈরাজ্যের অবসান ঘটিয়ে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিপদাপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো; আর্তের সেবায় এগিয়ে আসা। নতুন প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষাদান, বিপথগামিতা থেকে রক্ষার কৌশল অবলম্বন। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা; হিংসা-হানাহানির অবসান।
[caption id="attachment_5869" align="alignnone" width="819"] মুফাক্কিরে ইসলাম সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. [/caption]
তিনটি কর্মসূচি সামনে রেখে পরিচালিত হয় ‘রিসালাতুল ইনসানিয়াহ’র কার্যক্রম। প্রথমটি হলো দাওয়াহ। এর আওতায় ঈমানবঞ্চিত মানুষদের কাছে ঈমানের দাওয়াত পৌঁছানো; ইসলামবিচ্যুত মানুষদের ইসলামে ফিরিয়ে আনা; মুসলমানদের মধ্যে সংস্কারমূলক কার্যক্রম পরিচালনা; ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ঈমান-আকিদা সংরক্ষণে কুরআনি মকতব, ইসলামি স্কুল/কিন্ডারগার্টেন ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা; নতুন প্রজন্মের মধ্যে সমাজ সেবা ও দ্বীনি চেতনা জাগ্রতকরণের কাজ আঞ্জাম দেয়া হয়।
দ্বিতীয়টি হলো তাজকিয়া। এর মাধ্যমে মুসলমানদের আমল-আখলাক বিশুদ্ধকরণ; উন্নত চরিত্র ও নৈতিকতায় বলিষ্ঠ করতে বিভিন্ন কর্মসূচি এবং নগ্নতা ও অবক্ষয়ের রোধে কার্যকরী পদক্ষেপমূলক কাজ আঞ্জাম দেয়া হয়।
তৃতীয়টি হলো খিদমাহ। এর আওতায় সুবিধাবঞ্চিত-অসহায় মানুষদের সহযোগিতা; এতিম প্রতিবন্ধী ও নওমুসলিমদের পুনর্বাসন; গরিব-দুস্থ শিশুদের শিক্ষা সহায়তা এবং যৌতুকমুক্ত বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়।
মুফাক্কিরে ইসলাম সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. প্রতিষ্ঠিত ‘রিসালাতুল ইনসানিয়াহ’ ভারতে বেশ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নদভী রহ.-এর সুযোগ্য উত্তরসূরিরা সংগঠনটি দ্বারা ব্যাপক খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন। বাংলাদেশে এই সংগঠনের দায়িত্ব পেয়েছেন তরুণ আলেমে দ্বীন, নদভী চিন্তা-চেতনায় বলিষ্ঠ, দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামার রূহানী সন্তান মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকী। ২০১১ সালেই এদেশে সংগঠনটির দায়িত্ব তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন আলী মিয়া নদভী রহ.-এর সুযোগ্য তিন উত্তরসূরি আল্লামা সাইয়েদ মুহাম্মদ রাবে’ হাসানী নদভী, আল্লামা সাইয়েদ সালমান হোসাইনী নদভী ও আল্লামা সাইয়েদ আব্দুল্লাহ হাসানী নদভী রহ.।
[caption id="attachment_5872" align="alignleft" width="362"] মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকী[/caption]
কাজ-পাগল ও উদ্যমী মাওলানা ফারুকী দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে মুরব্বিদের পরামর্শক্রমে এই সংগঠনের আওতায় ব্যাপক কার্যক্রম আঞ্জাম দিচ্ছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি প্রবাসে থাকলেও ‘রিসালাতুল ইনসানিয়াহ বাংলাদেশ’-এর কার্যক্রম দেশে অব্যাহত রেখেছেন। গঠনমূলক, ইতিবাচক ও সৃষ্টিশীল কর্মকান্ডের কারণে সংগঠনটি ইতোমধ্যে বিজ্ঞ মহলের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছে।
বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে ইতিবাচক ও গঠনমূলক কাজের বড়ই অভাব। আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.-এর মতো গঠনমূলক কিছু কাজের খুবই দরকার। ঘুণে ধরা আমাদের এই সমাজব্যবস্থায় ইতিবাচক একটি ধাক্কা দিতে এর কোনো বিকল্প নেই। গতানুগতিক সংগঠন ও সংস্থার কোনো অভাব নেই। এসব সংস্থা ও সংগঠনে পদ-পদবির মারামারি আর নীরব প্রতিযোগিতাও কম না। গতানুগতিকতার বাইরে উদার চিন্তাভাবনা নিয়ে সমাজে কিছু কাজ করার মতো সংস্থা বা সংগঠন নেই বললেই চলে। ‘রিসালাতুল ইনসানিয়া বাংলাদেশ’ সেই শূন্যতা পূরণে সচেষ্ট হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
সবাইকে তাক লাগানোর মতো রাতারাতি উত্থান কোনো সংগঠনের জন্যই ভালো না। ধীরেসুস্থে, দৃঢ় পদক্ষেপে, কৌশলী ভূমিকায় সামনে অগ্রসর হওয়া যেকোনো সংগঠনের জন্য জরুরি। রিসালাতুল ইনসানিয়া বাংলাদেশের দায়িত্বশীলদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, অস্তিত্ব দৃঢ় করে স্থায়িত্ব লাভে সচেষ্ট হোন। অল্প হলেও গঠনমূলক ও ইতিবাচক কর্মকান্ড আঞ্জাম দিন। গতানুগতিকতার বাইরে নতুন কিছু করার; জাতিকে নতুন কিছু দেয়ার মানসিকতা লালন করুন। আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন। নিরন্তন শুভকামনা রইল রিসালাতুল ইনসানিয়াহ বাংলাদেশের জন্য।
লেখক : আলেম ও সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /আরআর