আব্দুল্লাহ বিন রফিক : অতীত জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। অতীতের পাঠশালা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কল্পপ্রাসাদ নির্মাণ করি। অতীতের অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের ক্যানভাসে আঁকি। কিন্তু আমরা কজনই-বা তা মনে রাখি? অধিকাংশরাই তা ভুলে যাই। কিন্তু স্মৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য পৃথিবীর বুকে টিকে থাকে বহুকাল ও শতাব্দী অবধি। অতীতে ফেলে আসা এই স্মৃতি-বিস্মৃতি ধরে রাখতে মিউজিয়াম বা যাদুঘরগুলোর জুড়ি নেই। তাই উনবিংশ শতাব্দী থেকে শুরু হয় মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য ও শিল্পকলা সংরক্ষণ কর্মসূচি।
১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে মিশরীয় শাসক ইসমাঈল খাদীবীর শাসনামলে সর্বপ্রথম মুসলিম ঐতিহ্য ও শিল্পকলা যাদুঘর নির্মাণের চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৮৮১ সালে ‘‘আরবীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদ’’ গঠনের মধ্য দিয়ে এই শিল্প আরও ব্যাপকতা লাভ করে। আজ আমরা ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এসব যাদুঘর বা মিউজিয়ামের সাতকাহন নিয়ে কথা বলবো।
কায়রো মিউজিয়াম
প্রাচীন মিশরীয় এই যাদুঘরটি মিশরীয় ও আরব ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ দলীল-দস্তাবেজ, শিলালিপি, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং বিচিত্র সব নিদর্শনের খণ্ডচিত্র সংগ্রহ করার দিক থেকে বিশ্বে প্রথম সারির তালিকায় থাকা এক সমৃদ্ধ যাদুঘর। মিসরীয় শাসক ফারাও বা ফেরাউনী নিদর্শন সংগ্রহের বিচারে এটি বিশ্বের সর্ব বৃহৎ সংগ্রহশালা। সর্বপ্রথম ১৮৩৫ সালে মিসর সরকার আযবিকিয়্যা গার্ডেনের পাশে যাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীতে কায়রো দূর্গে তা স্থানান্তর করা হয়। ১৮৮৫ সালে মিসর সরকার অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ম্যাক্সিমিলিয়ানকে যাদুঘরের সকল শিল্পসামগ্রী দান করে। যেটি এখন ভিয়েনায় অবস্থিত কান্স হিস্টরিস মিউজিয়াম নামে পরিচিত। বহু চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে অবশেষে ১৯০২ সালে কায়রোর তাহরির স্কয়ারে মিউজিয়ামটি সর্বশেষ স্থানান্তরিত করা হয়। মিউজিয়ামটিতে মোট ১০৭ টি গ্যালারি আছে। গ্যালারির সবগুলোই বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে সমৃদ্ধ। বিশেষতঃ ফেরআউন যুগের অধিকাংশ নিদর্শন অতি যত্নসহ এখানে স্থান পেয়েছে। ঐতিহাসিক এই মিউজিয়ামটির সংগ্রহশালায় আছে এক লাখ ষাট হাজারের মতো বিচিত্র সব বিষয়বস্তুর দূর্লভ সংগ্রহ; যা মিশরের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস-জ্ঞান আজও আমাদের সামনে সেই অতীত মেলে ধরছে।
মক্কা মিউজিয়াম
বিশ্ব মানবতার কল্যাণ ও শান্তির শ্রেষ্ঠতম মুক্তিদূত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্মৃতি ধন্য পূণ্যভূমি মক্কা-মদীনা। শত সহস্র বছরের সেই স্মৃতিই ধারণ করে আছে এখনকার মক্কা মিউজিয়াম। তাই পাথুরে মরুময় মক্কার যাত্রী ও পর্যটকগণ মিউজিয়ামটি ঘুরে যেতে ভুল করেন না। যারা এখনও মিউজিয়ামটিতে যাননি, তারাও যাতে ঘরে বসে অনায়াসে দেখে নিতে পারেন সেই ব্যবস্থাও করা আছে। সামাজিক ও গণযোগাযোগ সাইটে চাইলে এক কৃত্তিম ঘোরাঘুরি আপনিও করে নিতে পারেন।
কাবা শরীফের কাছাকাছি ওমরা মসজিদে যাবার পথেই এই মক্কা মিউজিয়াম। দ্বিতল এই যাদুঘরটির নিচতলায় ভিন্ন ভিন্ন বেশ কয়েকটি কক্ষ আছে। এতে আছে সৌদি আরবের প্রাচীন সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশবিশেষ পোশাক-পরিচ্ছদ, ব্যবহার সামগ্রী ইত্যাদি। পাশের আরেকটি কক্ষে আছে আরবী বর্ণমালা কীভাবে বিবর্তিত হয়ে আজকের রূপে এসেছে তার একটা তালিকা। বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ষ্টাইলের করা হস্তলিপিগুলো দেয়াল প্রদর্শনীতে শোভা পাচ্ছে। সংরক্ষিত আছে প্রাচীন আরব নারী-পুরুষের ব্যবহৃত পোশাক, বাদ্যযন্ত্র, আসবাবপত্র ইত্যাদি।
মিউজিয়ামের এক কোণায় রাখা আছে আরবের ঐতিহ্যবাহী পানির কূপ। এছাড়াও আছে কূপ থেকে পানি উত্তোলন করার যন্ত্রপাতি। পাশের আরেকটি কক্ষে আছে বিভিন্ন সময়ে আরবী আয়াত উৎকীর্ণ পাথুরে নকশা, প্রাচীন ধাতব মুদ্রা ইত্যাদি। ভিন্ন আরেকটি কক্ষে আছে চোখ ধাঁধানো নজরকাঁড়া বিচিত্র সব আরবী ক্যালিওগ্রাফী প্রদর্শনী হল।
মিউজিয়াম অফ ইসলামিক আর্ট: কাতার
এই যাদুঘরটি কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থিত। মিউজিয়ামের নকশা এঁকেছেন স্থাপত্যবিদ আই. এম. পাই। প্রাচীন ইসলামী স্থাপত্য দ্বারা মিউজিয়ামটি বেশ প্রভাবিত। তথাপি এর রয়েছে অনন্য স্থাপনা শৈলী। স্থাপত্য শিল্প-শৈলীর এমন শৌর্যময় প্রাসাদ অত্র অঞ্চলে এটাই প্রথম। জাদুঘরে মুসলিম শিল্পকলার এক বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। এছাড়া গবেষণা ও পড়ার জন্য আছে পাঠাগার ব্যবস্থা।
মিউজিয়াম অফ ইসলামিক আর্ট ৪৫,০০০ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত। আসলে এটি একটি কৃত্রিম উপদ্বীপ। এখান থেকে দোহা উপসাগরের দক্ষিণ প্রান্ত দেখা যায়। যাদুঘরটির প্রথম নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০০৬ সালে। পরবর্তীতে কয়েক ধাপে এর নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। ২০০৮ সালের ২২ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়। জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ২০০৮ সালের ৮ ডিসেম্বর। মিউজিয়ামের মূল ভবনের পেছনে একটি ২৮০,০০০ বর্গমিটার বিশিষ্ট পার্ক রয়েছে। পাঁচতলা বিশিষ্ট এই যাদুঘরে রয়েছে একটা গিফট শপ, পাঠাগার, শ্রেণীকক্ষ এবং দুইশো’ আসন বিশিষ্ট থিয়েটার। ওযু-নামাযের জন্য যাদুঘরে আছে বিশেষ ব্যবস্থা। তাছাড়া উন্নতমানের রেষ্টুরেন্টও আছে; যাতে আরবীয় খাবারের পাশাপাশি ফ্রেঞ্চ ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের খাবার পাওয়া যায়।
তোপকাপি মিউজিয়াম
১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় মুহাম্মাদ কুসতুনতুনিয়া বা কনস্টান্টিনোপল জয় করে অটোমান সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। ১৪৬৫-১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দ অবধি তোপকাপি প্রাসাদ ছিলো অটোমান বা উসমানীয় সুলতানদের মূল বাসস্থান। এই প্রাসাদই এখন মিউজিয়ামে রূপ নিয়েছে। মিউজিয়ামটি ধাপে ধাপে নির্মিত হয়। এর প্রথম কাজ শুরু হয় ১৪৭৮ সালের দিকে সুলতান মাহমুদের শাসনামলে। ১৫ শতক থেকে নিয়ে ১৮ শতক পর্যন্ত বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন স্থান পেয়েছে এই যাদুঘরে। বলা হয়ে থাকে, সেই উসমানীয় শাসনামলে প্রায় চার হাজার লোক বাস করতো এই প্রাসাদে। বিংশ শতকে এসে প্রাসাদের সেই শৌর্যবীর্য ও মাহাত্ম ভেঙ্গে পড়ে। তাই মূল প্রাসাদের খুব সামান্যই আর আগের চেহারায় আছে। এই প্রাসাদটি পরবর্তীতে যাদুঘরে রূপান্তরিত হয়। ১৯২৩ সালে তুর্কী খিলাফাতের পতন হলে তৎকালীন সরকার এটিকে অধুনা যুগের যাদুঘর হিসেবে গণ্য করে এবং সংস্কৃতি ও ট্যুরিজম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন করে দেয়। বর্তমানে কয়েকশো’ ঘরের মধ্যে সীমিত কিছু ঘর, সুলতানদের ব্যবহার করা পোষাক-আশাক, অস্ত্রশস্ত্র ও গহনা ইত্যাদি সর্বসাধারণের প্রদর্শনীর জন্য রাখা আছে।
কিন্তু গোটা পৃথিবীর মুসলিমদের কাছে এই প্রাসাদের মাহাত্ম অন্য কারণে এখানেই রাখা আছে আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যবহৃত পোশাক জুব্বা, বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র যেমন, ধনুক-তরবারী, সীলমোহর, উহুদ যুদ্ধে রাসূলের ভেঙ্গে যাওয়া দন্ত মোবারক, কেশ মোবারক, পায়ের ছাপ, বিভিন্ন দাওয়াতী চিঠি, ইত্যাদি। আছে খলীফা আবূ বকর-ওমর-ওসমান-আলী-খালিদ বিন ওয়ালিদ-আমর বিন ইয়াসিরের রা. প্রমুখ সাহাবীগণের তরবারী। আছে নবী দাউদ আ.-এর তরবারী, ইব্রাহিম আ.-এর পাত্র, মূসা আ.-এর লাঠি এবং মক্কার বিভিন্ন দরজার চাবি। মক্কার দরজার চাবি থাকতো অটোমান সুলতানদের নিয়ন্ত্রনে। মুসলিম বিশ্বে অটোমানদের প্রভাব কতটা ছিলো তা এ থেকে সহজেই অনুমেয়।
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর/ওএস