আব্দুল্লাহ বিন রফিক, বিশেষ প্রতিবেদক : ইসলামের অসংখ্য নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে জর্দানের পূন্যভূমিতে। সেসব নিদর্শনের পাশাপাশি আছে শত-সহশ্র বছর ব্যাপী গড়ে উঠা অতীত সভ্যতার স্মৃতি-ছবি, মসজিদ, বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা ও সাহাবিদের সমাধিস্থল। যেমন- আবু যর গিফারি ও আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহর মতো মহান সাহাবিদ্বয় এখানেই সমাধিস্থ হয়ে আছেন। শুয়ে আছেন মু’তা যুদ্ধের বীর শহীদগণ- জাফর বিন আবি তালিব, যায়েদ বিন হারিছা, আব্দুল্লাহ বিন রওয়াহা ও হারিছ বিন উমায়ের রা.-এর মতো প্রমুখ বীর-বিক্রমী যোদ্ধা সাহাবিগণ। এসব সমাধি ও স্থাপত্য মুসলমানদের অসংখ্য স্মৃতির স্বাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে জর্দানের মাটিতে। বিভিন্ন লক্ষ্য-উপলক্ষ্যে বিশে^র বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখনও মুসলমানরা তা পরিদর্শনে এসে থাকেন। আর তাই জর্দানে ছড়িয়ে থাকা এসব পর্যটনকেন্দ্রে সারা বছর মুসলমানদের আনা-গোনাও খুব বেশি হয়ে থাকে। জর্দান হচ্ছে মুসলমানদের জয়-বিজয়ের গৌরবগাঁথা, বিচিত্র ইতিহাস ও বড় বড় ঐতিহাসিক যুদ্ধের স্বাক্ষ্য-বাহক। এর মধ্যে মু’তা যুদ্ধের বিজয়-গৌরব ভোলার মতো নয়। দুই লাখ রোমীয় সেনার বিরুদ্ধে মাত্র তিন হাজার নির্ভীক মুসলিম সেনার এক অলৌকিক জয়। তাছাড়া ইয়ারমূক ও ফাহাল যুদ্ধে মুসলমানদের যুদ্ধবিজয়ের প্রেক্ষাপটও এই রণভূমি। এসব স্থান পূন্যাত্মা সাহাবিদের পদ-ধূলিতে ধন্য হয়ে আছে। এখানে তাদের অস্তিত্ব ও চারণ-বিচরণের স্মৃতিরা এখনও যেনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
এই দীনি পর্যটনকেন্দ্রের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে স্থাপনা নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বিশেষত সাহাবায়ে কেরামের ত্যাগ ও কুরবানির বিনিময়ে যে ধর্মীয় ও ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করেছেন তার মূল্যবান সেই নিদর্শন ধরে রাখতেই বিশেষ এই উদ্যোগ।
যেসব নেতৃস্থানীয় সাহাবিদের পদভারে জর্দানের ভূমি অলঙ্কৃত হয়েছে তাদের মধ্যে আছেন মু’তা যুদ্ধের তিন গর্ব- যায়েদ বিন হারেছা, জাফর বিন আবি তালিব, আব্দুল্লাহ বিন রওয়াহা। জর্দানের দক্ষিণে মু’তার মাজার শহরে তাঁরা সমাহিত। এখানকার বিশাল বিশ^বিদ্যালয়ে দাঁড়িয়ে তাদের সমাধি সহজেই প্রত্যক্ষ্য করা যায়।
যায়েদ বিন হারেসা রা.
তাঁর সমাধিটি জর্দানের আল-কারক জেলার মাজার নামক মরু অঞ্চলে অবস্থিত। একটি সম্পূর্ণ নতুন ভবন গড়ে তোলা হয়েছে এখানে। এর ভেতরেই যায়েদ বিন হারেসার সমাধি। মু’তা যুদ্ধের প্রথম সেনানায়কের পদটা প্রথমে তিনিই অলঙ্কৃত করেছিলেন। তাই যুদ্ধের প্রথম ঝা-াটা তাঁর হাতেই ছিলো। আরবের এই শ্রেষ্ঠ ধনুকধারী মাররে ইয়াসির ছাড়া প্রায় সকল যুদ্ধেই সমানভাবে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধে অসীম সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। বর্ষা ও তীরের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত দেহে ঢোলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে অমরত্ব লাভ করেন ইতিহাসের পাতায়।
[caption id="attachment_4492" align="alignnone" width="810"] মসজিদ এ জাফর বিন আবি তালিব রা.[/caption]
জাফর বিন আবি তালিব রা.
জাফর বিন আবি তালিব রা.-এর সমাধিটাও এই আল-কারকেই অবস্থিত। এখানে একটি বড়সড় জামে মসজিদও আছে। এখানে এলে আইয়ুবি ও অন্যান্য শাসকদের শাসনামলের বেশ কিছু নিদর্শন এখনও চোখে পড়ে। জাফর বিন আবি তালিবের সমাধিটাও মসজিদের ভেতরে অবস্থিত। মু’তা যুদ্ধের এই দ্বিতীয় সেনানায়ক নিজের সবটুকু দিয়ে রোমান সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। যায়েদ রা. শাহাদাত বরণ করতেই তিনি ঘোড়া থেকে নেমে আপন ঘোড়াটা বধ করে দেন যাতে শত্রুরা সেটা ব্যবহার করতে না পারে। তারপর যায়েদের পতাকা হাতে নিয়ে শত্রুসেনার একদম ভেতর ঢুকে তুমুলবেগে লড়াই শুরু করেন। ডান হাত কেটে যাওয়ার পর ঝা-া বাম হাতে ধারণ করেন। কিছুক্ষণ পর ফের তরবারির আঘাতে বাম হাতটাও কাটা পড়ে। তবু হাল ছাড়তে রাজি নন। এবার বাহু দিয়ে পাঁজা করে ঝা-াটা বুকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর কোনকিছু বুঝে উঠার আগেই প্রতিপক্ষের তরবারীর আঘাতে দেহটা দ্বিখ-িত বদনে পরিণত হয়। ক্ষত-বিক্ষত আঘাতের সংখ্যা ছিলো নব্বইয়ের অধিক। পঞ্চাশের অধিক ক্ষত ছিলো কেবল সামনের দিকে। অসীম সাহসে লড়াই করতে করতে তিনিও একইভাবে শাহাদাত বরণ করেন।
আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা রা.
আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা রা.-এর কবরও একই স্থানে অবস্থিত। তাঁর সমাধিটিও সম্পূর্ণ একটি নতুন ভবনের অভ্যন্তর ভাগে বিদ্যমান। মূতা যুদ্ধের তৃতীয় সেনানায়ক ছিলেন তিনি। সেনাপতি হওয়ার তৃতীয়তম পদটি তাঁর হাতেই ন্যস্ত ছিলো। চতুর্থ হিজরিতে বদরে সুগরা যুদ্ধ ছাড়া সবকটি যুদ্ধে সমান অংশগ্রহন করেছিলেন। মু’তা যুদ্ধের প্রাককালে মুসলিম সেনারা প্রতিপক্ষ সৈন্যের বহর-বিশালত্ব দেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণ কিংবা রাসূলের কাছে ফিরে গিয়ে পরামর্শ করার প্রশ্নে যখন দ্বিধা-চিত্ত হলেন তখন আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা এমন জ¦ালাময়ী ভাষণ দিলেন, তাতে মুসলিম সেনাদের দ্বন্দ-সন্দেহ মুহূর্তেই উবে গেলো। উপস্থিত সেনারা একবাক্যে বলে উঠলো, আল্লাহর কসম! ইবনে রাওয়াহা ঠিকই বলেছেন। যুদ্ধ উদ্দীপক কবিতা পাঠ করতে করতে সবাইকে নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। জাফর রা. শহীদ হওয়ার পর রাসুলের কথামতো ঝাণ্ডা তিনি হাতে নিলেন। এর মধ্যে যুদ্ধ কিছুটা ঝিমিয়ে এলে তাঁর চাচাতো ভাই হাড়সহ এক টুকরো গোশত হাতে তুলে দিলেন। যেই টুকরোটা মুখে পুরেছেন অমনি তুমুল যুদ্ধের রণডঙ্কা বেজে উঠলো। ‘তুমি এখনও বেঁচে আছো?’- কথাটা বলেই হাড়টা ফেলে দিয়ে তরবারি হাতে ঝাপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিপক্ষ সৈনিকের অতি বলশালী এক বাণের আঘাতে তিনি মারাত্মক আহত হন। এতে অনর্গল রক্ত ক্ষরণ হতে থাকে এবং অবশেষে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
[caption id="attachment_4493" align="alignright" width="427"] জিরার ইবনুল আজওয়ার রা. এর মাকবারা[/caption]
জিরার ইবনুল আজওয়ার রা.
জর্দানের যিরার নামের এক ছোট্ট গাঁয়ে মহান এই সাহাবির সমাধি অবস্থিত। একটি নতুন দালান আছে এখানে যার ভেতরেই তার সমাধিসৌধটি বিরাজমান। অসীম সাহসী এক অশ্বারোহী ছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে এক স্বপ্নমান কবিসত্ত্বাও। হজরত ওমর রা.-এর খেলাফতকালে তঊনে আমওয়াস তথা আমওয়াসের প্লেগ মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। নবম হিজরির শুরুতে আসাদ গোত্রের দশ সদস্যের এক কাফেলা মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। সেই দলে তিনিও ছিলেন। হজরত আবু বকরের শাসনামলে খালিদ রা.-এর আদেশে তিনিই মালেক বিন নুওয়াইরাকে হত্যা করেছিলেন। আবুল আযওয়ার বলেই ডাকতো সবাই। ইমাম আ’মাশ সহ অনেক তাবেয়িগণ তাঁর কাছে থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। ইয়ামামা যুদ্ধে প্রাণপণে লড়েছেন। ফলে পায়ের গোড়ালিটা হারিয়েছেন। তিনি জাহেলি যুগ ও ইসলামি যুগ দু’টোই পেয়েছিলেন। এখন যেখানে তিনি শুয়ে আছেন তাঁর নামানুসারেই জনপদটি যিরার শহর নামে খ্যাত হয়ে আছে।
[caption id="attachment_4497" align="alignright" width="437"] মুআজ বিন জাবাল রা.[/caption]
মুআজ বিন জাবাল রা.
কীর্তিমান এই আনসারি সাহাবি শুয়ে আছেন জর্দানের ‘দক্ষিণ শাওনা’ শহরে। তুর্কী শাসনামলে তুর্কী শাসকগণ তাঁর সমাধি কেন্দ্র করে উঁচু উঁচু পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট বিশেষ স্থাপনা নির্মাণ করেছিলেন। পাশেই শুয়ে আছেন তাঁর আরেক পুত্র। আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ রা.-এর সমাধি থেকে এটির দূরত্ব প্রায় ২৮ কি.মি.। এখানে এখন নতুন মসজিদও নির্মাণ করা হয়েছে। আমওয়াসের প্লেগ মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে ইন্তিকাল করেন এই খ্যাতিমান ফকিহ সাহাবি। ‘ইমামুল ফুকাহা’, ‘কানজুল উলামা’ ও ‘রব্বানিয়ুল কুলূব’ ইত্যাদি খেতাব পেয়েছিলেন খায়রুল কুরুন তথা সাহাবায়ে কেরামের যুগ থাকতেই। মক্কা থেকে মদীনায় রাসুল প্রেরিত মহান দায়ী মুসআব ইবনে উমায়েরের হাতে নবুওয়াতের দ্বাদশ বছরে ইসলাম গ্রহণ করেন। বয়স তখনও আঠারো। মক্কায় ইসলাম গ্রহণের পর মদীনায় ফিরে গিয়ে কয়েক সদস্যের যুবকদের নিয়ে পণ করলেন, মূর্তি ও প্রতিমা মুক্ত মদীনা গড়বেন। রাসুলের জীবদ্দশাতেই মুআজ রা. কুরআন হিফজ করেন। যারা কুরআন সংরক্ষণ ও সংকলন করেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। নবম হিজরিতে ইয়ামান অঞ্চলের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করলে আল্লাহর রাসুল হজরত মুআজ রা.-কে সেখানকার আমির নিযুক্ত করেন। তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন ঘনিষ্ঠ সাহাবি। শৈশব থেকেই খুব বুদ্ধিমান ছিলেন। তাই আল্লাহর রাসুল প্রায়ই তাঁকে বাহনের পিঠে বসিয়ে ইলম ও মারিফাত শিক্ষা দিতেন। রাসুলের এই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ফলে তিনি বিচিত্র প্রতিভাবান হয়ে উঠেন অল্পদিনেই। বিজ্ঞ ফকিহ, দক্ষ শিক্ষাগুরু, কৌশলী গভর্নর, শান্তি দূত, বীর সেনাপতি ও দিগি¦জয়ী একজন যোদ্ধা হওয়া ছাড়াও আরও অনেক গুণে গুনান্বিত ছিলেন এই মহান মণীষী সাহাবি। যৌবনের ভেলা পার না করতেই ইন্তিকাল করেন। বয়স তখন কেবল আটত্রিশের কোঠায়। ‘দক্ষিণ শাওনা’য় অবস্থিত এক প্রাসাদের বাগান ঘেঁষা স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
আবু যর গিফারি রা.
ইবাদাত ও আরাধনা স্থল হিসেবে জর্দানের জিবয়ান শহরের পশ্চিমে অবস্থিত শাকিক নামের একটি গ্রামকেই নির্বাচন করেন আল্লাহভীরু এই সাহাবি। শাম থেকে প্রত্যাবর্তন করে বহু বছর এখানে তিনি একাকী কাটিয়ে দেন। স্ত্রী ছাড়া সঙ্গে আর কেউই ছিলো না এখানে। এমনকি যখন তিনি দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে জাজিরাতুল আরব তথা আরব উপদ্বীপে চলে আসলেন তখনও কেউ সঙ্গে ছিলো না। খাদ্য সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে বড় বড় সাহাবিদের সঙ্গে বিবাদমান মতবিরোধের কারণে তিনি এখানে একা থাকার সিদ্ধান্ত নেন। অবশেষে তিনি এখানেই ইন্তিকাল করেন। জাহেলি যুগের প্রথমে একজন নামকরা ডাকাত ছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে জীবনে এক নতুন মোড় এলো। সত্যের দিশা পেলেন। সব ছেড়ে দিয়ে রাসূলের দরবারে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। আদতেই তিনি ছিলেন একদম সরল সাদামাটা দুনিয়া বিমুখ, নির্জনপ্রিয় মানুষ। তাই আল্লাহর রাসুল তাঁর উপাধি দিয়েছিলেন ‘মসীহুল ইসলাম’। আল্লাহর রাসূলের ইন্তিকালের পর তাঁর বিহনে এবং তারপর আবু বকরের ইন্তিকালে বিচ্ছেদ বেদনায় আরও কাতর হয়ে মদীনা ত্যাগ করেন। ৩১ কিংবা মতান্তরে ৩২ হিজরিতে ইন্তিকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা মোট ২৮টি। তার মধ্যে বুখারি ও মুসলিমের মুত্তাফাক আলাইহি তথা সমন্বিত বর্ণনা সংখ্যা ১২টি। আল্লাহর রাসুল তাঁর ব্যাপারে বলেছেন, ‘আসমানের নিচে ও জমিনের ওপরে আবু যর সর্বাধিক সত্যবাদী ব্যক্তি।’
আমের বিন আবি ওয়াক্কাস রা.
জর্দানের দক্ষিণাঞ্চলে ওয়াক্কাস নামের একটি গ্রামে তাঁর সমাধি-সৌধটি অবস্থিত। তাঁর সমাধি কেন্দ্র করে এখানে নির্মিত হয়েছে একটি নতুন স্থাপনা। তিনি ফুতুহুশ শাম তথা শামের বিজয়-যুদ্ধসমূহে অংশ নিয়েছিলেন। ১৫ হিজরিতে সংঘটিত হওয়া ইয়ারমুক যুদ্ধের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী ছিলেন তিনি। তাঁর নামানুসারে গ্রামটি ওয়াক্কাস গ্রাম হিসেবে সবার মাঝে পরিচিতি পেয়েছে।
[caption id="attachment_4494" align="alignnone" width="800"] শুরাহবিল ইবনে হাসানা রা. মসজিদ[/caption]
শুরাহবিল ইবনে হাসানা রা.
আবু উবায়দা সমাধি সৌধ থেকে ২০ কি. মি. উত্তরে আল-ইয়াবিস উপত্যকায় হজরত শুরাহবিল রা.-এর সমাধিটি অবস্থিত। সম্পূর্ণ নতুন একটি ভবন। তাঁর ভেতরেই আছে জর্দান বিজয়ী খ্যাতিমান সাহাবি হজরত শুরাহবিল বিন হাসানা রা.-এর কবর। এখানে একটি মসজিদ আছে। মসজিদের ভেতর ঢুকতে হাতের ডান দিকেই পড়ে মখমলের কাপড়ে মোড়া এই মূল্যবান সমাধি সৌধটি। তিনি ইসলামের শুরু যুগেই ঈমান আনেন। মক্কা থেকে হাবশাগামী প্রথম কাফেলার সাথে হাবশায় হিজরত করেন। তারপর হাবশা থেকে সরাসরি মদীনায় চলে আসেন এবং সেখানেই বসবাস করতে শুরু করেন। হজরত আবু বকরের শাসনামলে চার সেনা কমান্ডারের তিনি একজন। তাছাড়া বহু যুদ্ধ-লড়াইয়ের সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৮ হিজরিতে আমওয়াসের প্লেগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন।
আবুদ্দারদা রা.
ইরবিদ জেলা থেকে প্রায় ১৫ কি. মি. দূরে ‘সাওমুশ শানাক’ নামক একটি ছোট্ট গাঁয়ে হজরত আবুদ্দারদা রা.-এর মাযার অবস্থিত। আর পাঁচটা ইসলামের ঐতিহাসিক স্থাপনার মতো এটাকেও সংরক্ষণ করা হয়েছে। তিনি ছিলেন আরবের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী , একজন দক্ষ বিচারক ও সেরা অশ^ারোহী। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। ঈমান আনার পর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে ইবাদাত-আরাধনায় পূর্ণ আত্মনিয়োগ করেন। বদর যুদ্ধের আগে কিংবা পরে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এতো বড় জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও অন্যদের চে’ পরে ইসলাম গ্রহণের কারণ- তিনি অনেক ভেবে-চিন্তে, বুঝে-শুনে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। সম্ভবত রাসুলের মদীনায় আগমণের পর তিনি এক বছর পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে গভীর চিন্তা করেন এবং ভালোমতো খোঁজ-খবর নেন। তবে এই একটি বছর পেছনে পড়ার কারণে সারা জীবন অনুশোচনা করেছেন। পরবর্তীতে প্রায়ই বলতেন, ‘এক মুহূর্তের প্রবৃত্তির দাসত্ব দীর্ঘকালের অনুশোচনা জন্ম দেয়।’
[caption id="attachment_4495" align="alignright" width="361"] বিলাল বিন রাবাহ রা. এখানেই শুয়ে আছেন[/caption]
বিলাল বিন রাবাহ রা.
‘আস-সাইর’ নামের উপত্যকা বা গ্রামটিতে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন বিলাল বিন রাবাহ রা.। আল্লাহর রাসূলের মুঅজ্জিন হিসেবে তাঁকে কে না চেনে? যার আজানের মুগ্ধধ্বনি সোনালি যুগকে কোমল গভীর যত্ন-পরশ বুলিয়েছে, তাঁকে কি কেউ কখনও ভুলতে পারে? যার আত্মত্যাগ ও বলিদান সাদা-কালো আর ধনী-গরিবের ভেদাভেদ পেছনে ফেলে মানবতা প্রতিষ্ঠা করেছে উম্মাতে মুহাম্মাদি এতো সহজে তাঁকে কিভাবে ভুলে যাবে? তিনি হাবশি ছিলেন। হাবশি হিসেবে তাঁর গায়ের রঙ কালো হলেও অন্তর ছিলো দারুণ স্বচ্ছ। আভিজাত্যের বড়াই ও কৌলিণ্যের দাপটে শে^তাঙ্গ আরবরা যখন নিরন্তর সত্য প্রত্যাখ্যান করে চলেছিলো, তখনই তাঁর অন্তর ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিলো। রাসূলের সফর ও হযরের একমাত্র মুআজ্জিন তিনি। সকল যুদ্ধেই তিনি অংশ নেন। বদর যুদ্ধে উমাইয়া ইবনে খালফকে হত্যা করেছিলেন। মক্কায় হজরত বিলালের উপর অত্যধিক নির্যাতাদের মধ্যে এই উমাইয়া ছিলো শীর্ষস্থানীয়। দীর্ঘকাল সিরিয়াতেই বসবাস করেছিলেন। অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার ও গোত্রের সঙ্গে তাঁর পরিণয় সূত্র হয়েছিলো কিন্তু কোনও পক্ষেই সন্তান হয়নি। অবশেষে তিনি এখানেই ইন্তিকাল করেন। উল্লেখ্য, তৎকালীন সময়ে সিরিয়া বলতে জর্দানকেও বুঝাতো।
ইকরিমা রা.
হজরত ইকরিমা রা.-এর মাজারটি সামাদিয়া গির্জার কাছাকাছি জর্দানের একটি বিখ্যাত জেলা আজলূনে অবস্থিত। অঞ্চলটিতে খুব বেশি পাথরের স্তূপ পরিলক্ষিত হয়। এখানকার স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এখানেই হজরত ইকরিমা বিন আবি জাহালকে সমাহিত করা হয়েছে। তিনি ইসলাম গ্রহন অনেক পরে করেছেন। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও মুসআব ইবনে উমায়েরের মতো প্রথম দিকে ঈমান আনার সুযোগ হয়নি। পিতা আবু জাহালের সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা ও ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাবই সত্য গ্রহনের পথে বাঁধ সাধে। ইয়ারমূক যুদ্ধে বীর পরাক্রমে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধ করতে করতে এক পর্যায়ে রোমান সৈন্যদের অভ্যন্তরে ঢুকে গেলেন। হজরত খালিদ রা. বললেন আপনার হানি মুসলমানদের পক্ষে বড় ধরণের ক্ষতির কারণ হতে পারে। তখন হজরত ইকরিমা রা. বললেন, ‘খালিদ! আমায় ছেড়ে দাও। রাসুলের উপর ঈমান আনার প্রশ্নে তুমি অগ্রগামী। পিতা ও আমি ছিলাম রাসূলের সবচে’ বড় শত্রু। আমায় অতীতের কাফফারা আদায় করতে দাও। বহু যুদ্ধ আমি রাসূলের বিরুদ্ধে করেছি। আজ রোমানদের ভয়ে পালাবো? এ আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ এই ইয়ারমূক যুদ্ধেই শাহাদাত বরণ করেন তিনি।
যায়েদ বিন আলী আল-হুসায়ন বিন আলী বিন আবী তালিব রা.
আল-কারক প্রদেশের রাবা শহরে এই সমাধিটি অবস্থিত। এই মাযারের গায়ে চমৎকার আরবি ক্যালিওগ্রাফী পরিলক্ষিত হয়। আর জনশ্রুতি আছে- এটাই যায়েদ বিন হুসাইন রা.-এর সমাধি। এর চিত্রলিপি ও কারুকার্যের স্টাইল তুর্কী স্থাপত্য শিল্পের সাথেই অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। আল-কারক প্রদেশের মুসলিম মিউজিয়ামে এসব নকশা, চিত্র-কারুকার্য শিল্প স্থানান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে।
হারেছ বিন উমায়ের আল-আজদি
এই মাজারটি ‘আত-তফিলা’ শহর থেকে বিশ কি. মি. দক্ষিণে অবস্থিত। এখানে এলেই একটি নতুন বিল্ডিং চোখে পড়বে। এর ভেতরকার কবরটি হজরত হারেছ রা.-এর কবর বলে পরিচিত। আল্লাহর রাসুল তাঁকেই বসরার আমিরের কাছে দূত হিসেবে পাঠান। মূতার শাসক শুরাহবিল বিন আমর গাসসানি তাঁকে হত্যা করে। তিনি ছাড়া আল্লাহর রাসূলের আর কোনও দূতকে হত্যা করা হয়নি। জর্দানের দক্ষিণে আত-তফিলা অঞ্চলের অধিবাসীরা শহরে এই মহান আত্মত্যাগী সাহাবির সমাধি আজও বিদ্যমান আছে।
সূত্র: আফাক নিউজ ডটকম ও উইকিপিডিয়া অবলম্বনে।
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /আরআর