মোস্তফা ওয়াদুদ, বিশেষ প্রতিবেদক : মসজিদের নগরী ঢাকা। প্রাচীনকাল থেকে ঢাকায় মসজিদ প্রতিষ্ঠা হয়ে আসছে। আগেকার রাজাগণ যেখানেই যেতেন নামাজের জন্য তৈরি করতেন মসজিদ। এসব মসজিদ এখন কালের স্বাক্ষী হয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোনো মসজিদের ভবন এখনো অক্ষত। কোনোটার ভবন আমূল পাল্টে গেছে। আর কোনোটার বাকি আছে শুধু নামফলক। প্রাচীন ঢাকার কয়েকটি প্রাচীন মসজিদ নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন ।
বিনত বিবির মসজিদ
রাজধানীর পুরান ঢাকায় অবস্থিত একটি মধ্যযুগীয় মসজিদের নাম "বিনত বিবির মসজিদ"। নারিন্দা পুলের উত্তর দিকে অবস্থিত এই মসজিদের গায়ে উৎকীর্ণ শিলালিপি অনুসারে ৮৬২ হিজরি সালে, অর্থাৎ ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহের শাসনামলে মারহামাতের কন্যা মুসাম্মত বখত এটি নির্মাণ করেন। যার ফলে মোগল আমল থেকেই ঢাকা মসজিদের নগরে পরিণত হয়। এরই সাক্ষ্য বহন করে এখনো দাঁড়িয়ে থাকা একাধিক মোগল মসজিদ। তবে মসজিদের শহরের প্রথম মসজিদটি নির্মিত হয় আজ থেকে প্রায় ৬০০ বছর পূর্বে। সুলতানী আমলে। ১৪৫৭ খ্রিষ্টাব্দে। এবং ইতিহাসে পাওয়া যায় এটিই রাজধানীর প্রথম মসজিদ। ঢাকার প্রথম মসজিদের মর্যাদা পাওয়া বিনত বিবির ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে আছে পুরনো ঢাকার নারিন্দা ছয় নম্বর রোডে।
মসজিদের আকার : মসজিদটি চৌকোনা, এবং এতে একটি দুটি গম্বুজ রয়েছে। এর একটির গায়ে আদি ভবন প্রতিষ্ঠার সাল লেখা আছে। আরেকটির গায়ে লেখা আছে মসজিদটির সংস্কারের তারিখ। মারহামাতের কন্যা "মুসাম্মত বখত বিনত" এর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় "বিনত বিবি মসজিদ"। সম্প্রতি এই ভবনের পাশে মসজিদের নতুন ভবন তৈরি করা হচ্ছে।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে মসজিদের মুসুল্লি অধিকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে জায়গার সংকুলান হচ্ছে না। তাই স্থান বৃদ্ধির নিমিত্তে নতুন ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদিকে প্রাচীণ এই মসজিদটি তারা স্বস্থানেই রাখছে। মসজিদের নতুন ভবনের কারণে পুরাতন এ ভবনে কোনো আচর লাগছেনা। মসজিদের খাদেম জানান, মসজিদটি প্রতি বছর নতুন পলেস্টারসহ রং করা হয়। তাতে এখনো এর দেয়াল সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে আছে। ইমাম সাহেবের বক্তব্য হলো, স্থানীয় মসজিদ কমিটি ও এলাকাবাসী মসজিদের যত্নের প্রতি ও এর দেখভালের প্রতি যথার্থ আন্তরিক।
২. চকবাজার জামে মসজিদ
রাজধানীর আরেকটি পুরাতন মসজিদের নাম চকবাজার শাহী মসজিদ। এর পুরাতন নাম শায়েস্থা খান মসজিদ। ইতিহাসের বই "তারীখে ঢাকা" বা "ঢাকার ইতিহাস" নামক গ্রন্থের বিবরণ অনুযায়ী ঢাকার নায়েবে নাজিমরা ঈদের নামাজ পড়তেন চকবাজার জামে মসজিদে। ১৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে শায়েস্তা খান মসজিদটি নির্মাণ করেন। বাংলায় উঁচু প্লাটফর্মের উপর নির্মিত প্রাচীণ স্থাপত্য মনে করা হয় এটিকে। এই মসজিদ এখন চকবাজার শাহী মসজিদ নামে পরিচিত। চক সার্কুলার রোডে এর অবস্থান। মসজিদটি একাধিকবার সম্প্রসারণ করা হয়েছে। দেয়ালের পুরুত্ব কমিয়ে মিহরাব ও প্রবেশ পথগুলোকে প্রস্থে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ ছাড়া উত্তর ও দক্ষিণের দুটি প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মেঝেতে কাজ করা হয়েছে মার্বেল পাথর দিয়ে। তবে এই সংস্কার কাজের সময় আদি ভবন অক্ষত রাখা হয়েছে।
মসজিদে এখন দুটি মিনার আছে। এর একটিতে রয়েছে সিরামিকের ভাঙা টুকরোর কারুকাজ। এটি আয়তনে ছোট। এর চেয়ে বড় মিনারটি লালরঙা। মসজিদের মূল ভবনের বাইরের দেয়ালে রয়েছে কালো রঙের একটি ফলক। মসজিদের একজন খাদেম জানান, ফলকটি যে দেয়ালে রয়েছে সেটি আদি মসজিদের দেয়াল। আদি মসজিদের রূপ দেখতে হলে মসজিদের একেবারে ভেতরে ঢুকতে হবে। বর্তমানে মসজিদটিতে প্রায় ৮০০ মুসুল্লি একসাথে নামাজ আদায় করতে পারে। নামাজে আসা একজন মুসুল্লি জানান, আমি এ এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। আমিসহ আমার পূর্বের চার পুরুষ এই মসজিদেই নামাজ আদায় করতেন। আমি যেখানেই থাকি পিতামহ,প্রপিতামহের স্মৃতি বিজরিত মসজিদে এসেই নামাজ আদায় করি।
৩. বেগমবাজার মসজিদ
মুঘল আমলে নির্মিত অন্যতম মসজিদগুলোর মধ্যে এটি একটি। কারো কারো কাছে এটি কারতালাব খাঁ মসজিদ নামেও পরিচিত। ১৭০৪ সালে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এটি নির্মাণ করেন। সৈয়দ মাহমুদুল হাসানের বাংলাদেশের মসজিদ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, কারতালাব খাঁনের প্রকৃত নাম মুহাম্মদ হাদী। তিনি হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হলে মুর্শিদ কুলি খাঁ নাম ধারণ করেন।
মসজিদটির মূল ভবন অলঙ্করণে স্থাপত্যর ওপর বিশেষ গুরুত্ব লক্ষ্য করা যায়। পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটির প্রবেশ পথের পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র মিনার, মিহরাব, ছোট গম্বুজ, পদ্ম ও কলসশোভিত ফিনিয়ালগুলো যেন মসজিদ অবয়বে এনেছে এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। এ ছাড়া প্যারাপেট ও গম্বুজ ড্রামের গায়েও রয়েছে উন্নত মেরলন মোটিফ। এ ছাড়া মসজিদের গম্বুজগুলো ভেতরের দিক থেকে নকশাকৃত আর শীর্ষবিন্দু মেডালিয়নের মধ্যে একটি রোসেট দ্বারা অলঙ্কৃত। তবে ধীরে ধীরে মসজিদটির প্রকৃত সৌন্দর্য হারাচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন।
৪. তারা মসজিদ
বিনত বিবির মসজিদের পর ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীণ মসজিদ হলো তারা মসজিদ। পুরনো ঢাকার আরমানিটোলায় আবুল খয়রাত সড়কে এটি অবস্থিত। এটি স্থাপিত হয় ১৮০০ সালের শুরুর দিকে। তৎকালীণ প্রভাবশালী মুসলিম জমিদার মির্জা গোলাম পীর এ মসজিদটি নির্মাণ করেন।
মসজিদের আকার : মসজিদটি সাদা মার্বেলের গম্বুজের ওপর নীলরঙা তারায় খচিত । নির্মাণকালীন সময় মসজিদের গায়ে নির্মাণ-তারিখ খোদাই করা ছিল না।
জানা যায়, আঠারো শতকে ঢাকার 'মহল্লা আলে আবু সাঈয়ীদ'-এ (পরে যার নাম আরমানিটোলা হয়) আসেন জমিদার মির্জা গোলাম পীর (মির্জা আহমদ জান)। ঢাকার ধণাঢ্য ব্যক্তি মীর আবু সাঈয়ীদের নাতি ছিলেন তিনি। মির্জা গোলাম পীর এ মসজিদ নির্মাণ করেন। মির্জা সাহেবের মসজিদ
হিসেবে এটি তখন বেশ পরিচিতি পায়। ১৮৬০ সালে মারা যান মির্জা গোলাম পীর। পরে, ১৯২৬ সালে, ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী, আলী জান বেপারী মসজিদটির সংস্কার করেন। সে সময় জাপানের রঙিন চিনি-টিকরি পদার্থ ব্যবহৃত হয় মসজিদটির মোজাইক কারুকাজে। মোঘল স্থাপত্য শৈলীর প্রভাব রয়েছে এ মসজিদে। ঢাকার কসাইটুলীর মসজিদেও এ ধরনের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। উল্লেখ্য, দিল্লি , আগ্রা ও লাহোরের সতের শতকে নির্মিত স্থাপত্যকর্মের ছাপ পড়ে মোঘল স্থাপত্য শৈলীতে।
তারা মসজিদ বারান্দা : মির্জা গোলামের সময় মসজিদটি ছিল তিন গম্বুজঅলা, দৈর্ঘ্যে ৩৩ ফুট (১০.০৬ মিটার ) আর প্রস্থে ১২ ফুট (৪.০৪ মিটার)। আলী জানের সংস্কারের সময়, ১৯২৬ সালে, মসজিদের পূর্ব দিকে একটি বারান্দা বাড়ানো হয়। ১৯৮৭ সালে তিন গম্বুজ থেকে পাঁচ গম্বুজ করা হয়। পুরনো একটি মেহরাব ভেঙে দুটো গম্বুজ আর তিনটি নতুন মেহরাব বানানো হয়। মসজিদের বতর্মান দৈর্ঘ্য ৭০ ফুট (২১.৩৪ মিটার), প্রস্থ ২৬ ফুট (৭.৯৮ মিটার)।
৫. মুসা খার মসজিদ
ঢাকা গেইটের দক্ষিণে নিকটতম প্রাচীন স্থাপত্যের নাম মুসা খার মসজিদ। অষ্টাদশ শতকে স্থাপিত ঢাকা শহরের অন্যতম স্থাপত্য এই মসজিদ। ঢাকা হলের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত এই পুরাতন মসজিদটি দেওয়ান ঈশাখার পুত্র মুসা খার নামে পরিচিত হলেও এ’দুজনের কেও এটি নির্মাণ করেন নি। মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন মুসা খার পুত্র মনোয়ার খা। মসজিদে তিনটি গম্বুজ রয়েছে। পূর্ব দিকে আছে তিনটি দরজা। পশ্চিম দেয়ালে তিনটি সুন্দর মেহরাব এবং উপরে একটি সুন্দর মিনার আছে। উচু বেদীর উপর নির্মিত মসজিদে সিড়ি বেয়ে উঠতে হয়। মসজিদের উত্তর-পূর্ব কোণে মুসা খার মাজার এবং পশ্চিম দিকে জ্ঞান তাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মাজার রয়েছে। পরিচর্যার অভাবে খসে পড়ছে দেয়ালের প্লাষ্টার। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অবহেলার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে প্রাচীন এ মসজিদটি।
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /আরআর