ঢাকা : সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে জঙ্গিবাদের উত্থান। লেখক-প্রকাশক-ব্লগার থেকে শুরু করে ভিন্ন ধর্ম ও মতালম্বীদের হত্যার ঘটনা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আর এসব ঘটনার প্রায় প্রতিটিতেই দায় স্বীকার করে বক্তব্য দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের চরমপন্থী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)।
জঙ্গি গোষ্ঠীটির এ ধরনের বক্তব্য ও ‘কর্মকাণ্ড কি বাংলাদেশে তাদের পরবর্তী ঘাঁটি (হটস্পট) গড়ে তোলার ইঙ্গিত দিচ্ছে? মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এ প্রশ্নটি তুলেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত দুই বছর ধরে একের পর এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রথমদিকে হত্যাকাণ্ডগুলোর একটি প্যাটার্ন ছিলো- সুপরিচিত সেক্যুলার লেখকদের ওপর এ হামলা চালানো হতো। যারা ইসলামের সমালোচনা করতো তাদের হত্যা করা হতো। এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিলো ২০১৪ সালে রাজধানীতে বাংলাদেশি-আমেরিকান নাগরিক লেখক অভিজিৎ রায় এবং গত এপ্রিলে এক সমকামী অধিকারকর্মী ও তার বন্ধুকে হত্যা।
সম্প্রতি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপ্তি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষক থেকে শুরু করে হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এমনকি মুসলমান ভিন্ন মতাবলম্বীরাও বাদ যাচ্ছেন না। এসব হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা এখন ৪০ ছাড়িয়েছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডেই রামদা ব্যবহার করা হয়েছে। আইএস বেশ কতগুলো হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে। স্থানীয় কয়েকটি ইসলামি গ্রুপও বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে। তবে বাংলাদেশ সরকার বারবার দেশে আইএসের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করে আসছে।
পুলিশ অবশ্য জানিয়েছে, অধিকাংশ হামলাকারীই নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিনের (জেএমবি) সদস্য। তবে এ দাবির স্বপক্ষে যথার্থ তথ্য নেই পুলিশের হাতে।
দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক সংবাদমাধ্যম সাউথ এশিয়ান টেররিজম পোর্টালের নির্বাহী পরিচালক আজাই সাহনি বলেন, আইএস বাজারে লোকজনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে না। আইএস সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমে হয়তো কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকারের খবর আসতে পারে। এর মাধ্যমে তারা সংগঠনের বিশালতা বোঝানোর চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, এটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে চাচ্ছে। কিন্তু এসব হামলায় যদি আইএসের সংশ্লিষ্টতা থেকেই থাকে তাহলে আসল অস্ত্র কোথায়? প্রশিক্ষিত ও যুদ্ধরত সেনারা কোথায়?
সাহনি বলেন, ‘ছুরিকাঘাত ও কোপানো বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিচু স্তরের সহিংসতার নজির রয়েছে। তবে এখন এটা এখন পরিষ্কার যে, বড় কিছু একটা ঘটছে। কারণ এগুলো এখন সংগঠিতভাবে হচ্ছে এবং ভুল বা সঠিক যেভাবেই হোক আইএসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ছোটখাটো হামলাও বাদ যাচ্ছে না। জঙ্গিদমনে গ্রামবাসীর হাতে বাঁশের লাঠি তুলে দিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছে পুলিশ তবে সন্ত্রাসবাদে অভিজ্ঞ এশিয়া-প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের সাজ্জান গোহেল বলেন, আইএসের সঙ্গে এখন জেএমবির সংশ্লিষ্টতা দেখা যাচ্ছে। জেএমবি বিদেশি, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের হামলার লক্ষ্য বানাচ্ছে।
অপরদিকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মতো স্থানীয় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলি ব্লগার ও নাস্তিকদের টার্গেট করছে। এবিটির সঙ্গে আল-কায়েদার ভারতীয় শাখা আল-কায়েদা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের (একিউআইএস) সংশ্লিষ্টতা দেখা যাচ্ছে। গোহেলের কথা যদি সত্য হয় তাহলে আইএস ও আল-কায়েদার মধ্যে লড়াইয়ের ক্ষেত্র হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ কিংবা এতোদিনে হয়ে গেছে।
আর এর উদ্দেশ্যটিও পরিষ্কার। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মুসলমান জনগোষ্ঠীর এই দেশে ঘাঁটি গাড়তে চাচ্ছে তারা। পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে গোহেল বলেন, আইএস তাদের প্রচারিত ম্যাগাজিন ‘দাবিক’-এ বলেছে তারা বাংলাদেশে অনেক উচ্চ পদস্থ লোকদের ওপর হামলা চালাতে যাচ্ছে। পরের হামলাগুলো হবে আরো বড় ও সুসংহত।
গোহেল অভিযোগ করে বলেন, বাংলাদেশ সরকার পুরো বিষয়টিকেই অস্বীকার করছে। সিএনএনের সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক বিশ্লেষক পিটার বারগেন জানিয়েছেন, ছোটখাটো সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর কাছে খ্যাতির জন্য ব্রান্ডিং বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, তালেবানের সাবেক সদস্যরাও নিজেদের আইএসের সদস্য বলে দাবি করে। যদিও তাদের সঙ্গে আইএসের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
আইএসের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার ঘোষণা তাদেরকে আরো বড় ও বাজেভাবে উপস্থাপনে সাহায্য করে। পবিত্র রমজান মাসে বিশ্বব্যাপী অস্ত্র তুলে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে আইএস। তবে এমন আশঙ্কাও আছে যে ছুরি দিয়ে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের কুপিয়ে হত্যার আদলে অন্য সন্ত্রাসীরাও কুপিয়ে নিজেদের দায় এড়াতে চাইছে। তবে এসব হত্যা বন্ধে সরকারের কিছু পদক্ষেপ আরো হাস্যকর। যেমন মাগুরায় ইতোমধ্যেই পুলিশ গ্রামবাসীর হাতে বাঁশের লাঠিও বাশি তুলে দিয়েছে। ‘প্রতিটি গ্রাম থেকে ২০ জন বাছাই করা হবে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সদা সতর্ক থাকা এবং সচেতনতার বৃদ্ধির জন্য এই আইডিয়া,’ বলছিলেন মাগুরার পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম।
তবে সরকারের এই নীতির চূড়ান্ত এবং প্রকৃত রায় হবে কোনটা সঠিক তা নিয়ে নয়, বরং হামলা সত্যিই থামানো গেল কিনা তার ওপর। সে পর্যন্ত কুৎসিত শিরোনাম বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করে যাবে।
/এআর