সময় দুপুর তিনটা। কাঠফাটা রোদ উত্তাপ ছড়ানোর কথা থাকলেও তখন মাথার উপর সূর্যের দেখা নেই। চারদিকে ছেয়ে আছে অন্ধকার। আকাশজুড়ে জমে ধাকা মেঘগুলো নামবে নামবে করছে। ঠিক এমন সময় আমার বের হতে হলো। রিকশায় চড়তেই শুরু হলো বৃষ্টি। ঝিরঝির বৃষ্টি আর প্রবল বাতাস উপেক্ষা করে আমি চলছি।
গন্তব্য কাকরাইল ইসলামি ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতাল। যেখানে শুয়ে আছেন জামানার কিংবদন্তি। বাংলা সাহিত্যের মুকুটহীন স¤্রাট মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। পঞ্চাশের দশক থেকে যিনি নিজের সবটুকু মেধা, শ্রম ও আন্তরিকতা দিয়ে ইসলামের খেদমত করেছেন। ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা চিত্র আরবি ও উর্দু থেকে বাংলায় রূপান্তর করে বাংলা ভাষী লক্ষ কোটি মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন।
আজ তিনি জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি অসুস্থ। কিডনীতে সমস্যা, শ্বাসকষ্ট ও বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে আরও অনেক আগেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন । অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকতেন। গত কয়েক বছরে তিনি কোন সভা সমাবেশে যোগ দেননি। দুএকটি বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার চেষ্টা করা হলেও পুলিশি বাধার কারণে যেতে পারেননি। এই সময়টাতে ঘরের চেয়ে তিনি হয়তো হাসপাতালেই বেশি থেকেছেন। কখনো শমরিতা, কখনো বারডেম অথবা সেন্ট্রাল হাসপাতাল, এভাবেই তার সময় কেটেছে।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে তিনি হটাৎ খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পরেন। বারডেমে ভর্তি করা হলে ডাক্তাররা দ্রুত তাকে আইসিইউতে শিফট করেন। সেখানে মাস খানেক চিকিৎসা গ্রহণের পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। আইসিইউ থেকে বের হয়ে আসেন। কিন্তু আরও একটু সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরার চিন্তা করে ভর্তি করা হয় কাকরাইল ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে ভর্তি করার পর অবস্থা দিনদিন অবনতির দিকে যেতে থাকে। ১৭ ই মে মারাত্মক শ্বাস কষ্ট শুরু হলে ডাক্তারদের পরামর্শে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। সেই থেকে আজ অবধি তিনি লাইফ সার্পোটে আছেন।
দুই.
আমি হাসপাতাল পৌছতেই লিফটের সামনে দেখা হলো হুজুরের ছোট সাহেবজাদাহ, মাসিক মদিনার সহকারি সম্পাদক আহমদ বদরুদ্দীন খানের সাথে। এক সাথেই উপরে উঠলাম। খান সাহেব আছেন এগারো তলায় অবস্থিত আইসিইউতে। আমরা গেলাম বারো তলার ওয়েটিং রুমে। সেখানে আগে থেকেই ছিলেন হুজুরের মেঝ ছেলে মুর্তজা বশিরুদ্দীন খান। তিনি তখন ঘুমাচ্ছিলেন।
তিনি ঘুম থেকে উঠলে তারপর হুজুরকে দেখতে যাবো এই চিন্তা করে আমরা একটু বসেছি। কিন্তু হুজুরের ছেলে আহমদ খান বারবার দেখতে যাচ্ছেন মেঝ ভাই ঘুম থেকে উঠলো কিনা। বুঝতে পারলাম, তিনি বাবাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছেন। বললেন, আইসিইউতে এপ্রোন পরে যেতে হয়, আর এপ্রোন মেঝ ভাই এর কাছে, তিনি তো ঘুমাচ্ছেন। কিন্তু আব্বাকে না দেখে আমার ভাল্লাগছে না। আপনি একটু বসুন, আমি আব্বাকে এক নজর দেখে আসি। এই কথা বলে তিনি নতুন আরেকটি এপ্রোন ব্যবস্থা করে আইসিইউতে গেলেন।
ফিরে এসে আমাকে বললেন, এবার আপনি যান। আমি আইসিইউতে আগে কখনো প্রবেশ করিনি। এটাই প্রথম। আমার ধারণা ছিল, আইসিইউ হয়তো কেবিনের মতই হবে। একেকজন রোগীর জন্য আলাদা আলাদা রুম থাকবে। কিন্তু ভীতরে ঢুকে দেখি দশ বারোজন রোগী পাশাপাশি বেডে শায়িত আছেন। সবার অবস্থাই সংকটাপন্ন। একজনের অবস্থা অপরজন থেকে ভয়ংকর। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা এতজন রোগীর মাঝে দাঁিড়য়ে আমার ভীতরটা কেপে উঠলো।
একাধিক রোগী এক সাথে থাকার কারণে খান সাহেবেরও খুব কষ্ট হতো। প্রথম যখন তাকে আইউসিইউতে আনা হয়, তখন তাঁর সেন্স সম্পূর্ণ ঠিক ছিল। সারা শরীরে পাইপ লাগানো থাকায় নড়াচড়া করতে পারতেন না। কথা বলতে পারতেন না। কিন্তু সব বুঝতেন। আশপাশের রোগীদের কার উপর দিয়ে কি যাচ্ছে দেখতে দেখতে অস্থির হয়ে যেতেন। কাউকে পেলেই কাতরাতে থাকতেন। ইশারায় বলতেন, আমাকে খুলে দাও। আমাকে খুলে দাও।
হুজুরের ছেলে আহমদ খান বলেন, আব্বার খুব কষ্ট হতো, কষ্টে পাগলের মত করতেন, আর বলতেন আমাকে খুলে দাও। কাগজে লিখে দিতেন, হায়াত মউত আল্লাহর হাতে, তোমরা আমাকে খুলে দাও। বাসায় নিয়ে যাও। কিন্তু ডাক্তারদের বক্তব্য ছিল, লাইফ সাপোর্ট খোলা হলে আর তাকে বাঁচানো যাবে না। তাই বাধ্য হয়েই আব্বাকে লাইফ সার্পোটে রাখতে হয়েছে।
কিন্তু আমি যখন গিয়েছি, তখন তিনি চেতনাহীন অবস্থায় আছেন। হাতে, বুকে, মুখে পাইপ লাগানো। কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস নিচ্ছেন। কোন নড়াচড়া নেই। একেবারেই নিরব। কারো উপস্থিতি টেরও পেলেন না।
আমার তখন মনে পড়ছিল গত রমজানের কথা। ঠিক এই সময়ে হুজুরের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তখনও তিনি অসুস্থ। কিন্তু অবস্থা আরও ভালো ছিল। চেয়ারে বসে নামাজ পড়তেন। সেদিন বলেছিলেন, কয়েকটা রমজান পেতে ইচ্ছে করে, আর কোন চাহিদা নাই। আর আক্ষেপ শুধু একটাই সিজদা করতে পারি না।
তিন.
হাসপাতালে প্রায় তিন ঘন্টা ছিলাম। হুজুরের ছেলে আহমদ খানের সাথে অনেক কথা হলো। কথায় কথায় তিনি খান সাহেবের জীবনের কয়েকটি অজানা অধ্যায় মেলে ধরলেন। নতুন করে জানলাম মাওলানা খানকে। দূর থেকে দেখা আর কাছ থেকে দেখার মাঝে পার্থক্যের মাত্রাটাও অনুমান করতে পারলাম।
কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয় মাওলানা মুহিউদ্দীন খান কে? তাহলে সে হয়তো বলবে, তিনি বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি, সিরাত সাহিত্যের জনক। আরেকজন হয়তো বলবে, তিনি এক আপোষহীন জননেতা। এটুকুই। কিন্তু তার পরিচয় এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। এর বাইরেও তারঁ আরও পরিচয় আছে। প্রচার বিমুখতার দুলর্ভ গুণ সেগুলো লোকচক্ষুর আড়ালেই রেখেছে।
তিনি বলেন, সারা জীবন তিনি শুধু মানুষের জন্য করেছেন। মানুষের সহায়তা করাই ছিল আব্বার নেশা। দুই হাতে তিনি মানুষদের দিয়েছেন। যার যা প্রয়োজন, তাকে তাই দিয়েছেন। যা দিচ্ছেন, সেটা কত বড় সেই চিন্তা কখনো করেননি। নিজের, বা পরিবারের ভবিষতের চিন্তাও করেননি। শুনলে বিশ্বাস হওয়ার মত নয়, তিনি তার নিজ সম্পত্তির প্রায় দুই তৃতীয়াংশই মানুষদের ফি সাবিলিল্লাহ দান করে দিয়েছেন।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছি, না শুনছি না, গিলছি। এরই মধ্যে এক ব্যক্তি আসলো। তিনি এসেছেন মাওলানা খানের জন্মভূমি গফরগাও থেকে। তার চোখে পানি। হাতে বাড়ি থেকে স্বযত্নে নিয়ে কিছু আম। সে জানেও না লাইফ সার্পোটে থাকা রোগী পযর্ন্ত এই আম নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। এইটুকু জ্ঞান তার না থাকলেও তার হৃদয়জুড়ে আছে খান সাহেবের জন্য ভালোবাসা। জানতে চাইলাম কখন এসেছেন, সে বললো এহনই আইসি, আজকা যাইতাম না, কালহা যায়াম। আজকা হুজুরের কাছে থাকমু। আয় আল্লা তুমি হুজুররে হায়াত দাও। হুজুর গেলে গা আমগোরে কে দেখবো, কে খাওয়াইবো।
আহমদ খান বললেন, ইনি আব্বার মাদরাসার শিক্ষক। আব্বা বাড়িতে একটা মাদরাসা পরিচালনা করেন। সম্পূর্ণ নিজ খরচে। প্রতিমাসের ইনকাম থেকে সবার আগে মাদরাসার খরচ দিতে হয়। এছাড়াও অসংখ্য পরিবারের একটা তালিকা আছে আব্বার, যাদেরকে প্রতি মাসে নির্ধারিত হারে তিনি অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকেন। যা এখনও অব্যাহত আছে। বাবার কথা বলতে গিয়ে তিনি বারবার বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন। চোখ বেয়ে ঝরে পড়ছিল অশ্রুবিন্দু।
আমার শুধু মনে হলো, খান সাহেবকে আমরা চিনি না। এই জাতিও তাকে চিনতে পারেনি। আজ তো এসেছিলাম তাকে একনজর দেখতে। কিন্তু আরেকদিন আসতে হবে খান সাহেবকে জানতে, শিখতে, অনুপ্রাণিত হতে।
চার.
অর্ধশতাব্দির অধিক কাল ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ এই মানুষটি হাসপাতালের বেডে শুয়েও দ্বীনের কথাই ভাবতেন। মেধার সক্রিয়তা বাকি থাকার শেষ সময়টুকু পযর্ন্ত তিনি কেবল এই চিন্তাই করেছেন, দ্বীনের হেফাজত কিভাবে হবে, বেশি থেকে বেশি মানুষ কিভাবে দ্বীনের উপর থাকবে, বাতিল কিভাবে দমন হবে, সকল ইসলাম বিদ্বেষী অপশক্তির হাত থেকে দেশ কিভাবে পাবে।
গত ১১ ই মে ড. আব্দুল্লাহ জাহাংগির সাহেবের মৃত্যুর খবর শুনে তিনি এতটাই মুষড়ে পরেন যে, অসুস্থতা বেড়ে যায়। তিনি তখন আফসোস করে বলছিলেন, ভাবছিলাম আমরা চলে গেলে তারা দ্বীনের জন্য কাজ করবে, কিন্তু তিনিও চলে গেলেন। দ্বীনের হেফাজত কিভাবে হবে।
মাওলানা খান ছিলেন ছায়াদার বটবৃক্ষের মত। যার আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে লালিত পালিত হয়েছে শতশত পরিবার। আদর সোহাগ দিয়ে সবাইকে আগলে রেখেছেন। কাউকেই ছুটতে দেননি। ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনিদের নিজের কাছে রেখে পরম মমতায় বড় করেছেন।
বড় ছেলে মোস্তফা মঈনুদ্দীন খান বলেন, আব্বার এই অবস্থায়ও সবার কথাই চিন্তা করেছেন। সেদিন আমি ডাক্তারের কাছে আব্বার অবস্থা জানতে চাইলাম, আমার গলার আওয়াজ পেয়েই বললেন, 'মোস্তফা এসেছো?' কন্ঠ খুব দূর্বল, আওয়াজ অস্পষ্ট। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, 'দুপুরে খেয়েছো?' তারপর জানতে চাইলেন শহিদকে তার গ্রামের বাড়ি যেতে দিয়েছি কিনা। তারপর বললেন, "আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও," বুঝলাম এ অবস্থায়ও তিনি আমাদের কথাই ভাবছেন। আমার অশ্রু কোথায় লুকাবো!
হুজুরের এক নাতির সাথে কথা হলে বললেন, গত কয়েক বছর ধরে দাদা প্রায়ই হাসপাতালে থাকেন। আমরা দেখা করতে আসলে বলেন, তোমাদের কিছু লাগবে? কোন প্রয়োজন আছে? থাকলে বলো। এমন মানুষ আমরা আরেকটা কোথায় পাবো!
এই প্রথম দাদাকে ছাড়া রোজা রাখছি। দাদা ভোজনরসিক মানুষ। আমাদের সবাইকে নিয়ে অনেক আনন্দের সাথে ইফতার করতেন। কেউ একজন না এলে মুখে ইফতার তুলতেন না। আজ তিনি বিছানায় কাতরাচ্ছেন। আর কোন দিন দাদার সাথে ইফতার করা হবে কি না জানি না!
হুজুরের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাওয়া হলে ছোট ছেলে বলেন, আব্বার অবস্থা ভালো না। অবস্থার আরও অবনতি হওয়ায় কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস গ্রহণের জন্য গলায় অপারেশন করা হয়েছে। তখন প্রচর রক্তক্ষরণ হয়েছে। অপারেশন সফল হলেও আব্বার অবস্থার কোন উন্নতি দেখছি না।
মাওলানা খানের পরিবার এখন এক কঠিন সময় পার করছেন। প্রতি মুহূর্ত এক অজানা আশঙ্কায় তাঁর পরিবার ও প্রিয়জনদের সময় কাটছে। চব্বিশ ঘন্টা বাবার পাশে ছায়ার মতো আছেন তাঁর তিন ছেলে মুস্তফা মঈনুদ্দীন খান, মুর্তজা বশিরুদ্দীন খান ও আহমদ বদরুদ্দীন খান। যে কোন প্রয়োজনে তাদের সঙ্গ দিচ্ছেন খান সাহেবের নিকট আত্মীয় স্বজন। প্রতি মূহুর্তের খবর রাখছেন দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ কোটি ভক্তবৃন্দ। প্রতিদিন দেশের আনাচ কানাচ থেকে শতশত মানুষ হাসপাতালে ভীর করছেন তাকে এক নজর দেখার জন্য।
মাওলানা খান আজ জীবনের শেষ প্রান্তে উপনিত। দীর্ঘ ষাট বছর অবধি দেশ জাতি ও ইসলামে জন্য খেদমত করা এই মানুষটি আজ বর্ণনাহীন কষ্ট অনুভব করছেন। তার পরিবার ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা তার ভক্তদের জন্য যা সহ্য করা অত্যন্ত কঠিন। হে আল্লাহ তুমি তার পরিবারকে ধর্য্য ধারণের শক্তি দাও। দ্বীনের জন্য নিবেদিত প্রাণ এই মানুষটির উপর রহম ও দয়া করো। শান্তিতে নিশ্বাসটুকু নেয়ার সামর্থ দাও। পৃথিবীবাসীর উপর তার বরকতময় ছায়া আরও দীর্ঘ করো। আমিন।
/মুহাম্মদ এহসানুল হক
সাব এডিটর, আওয়ার ইসলাম টুয়েন্টিফোর ডটকম