আওয়ার ইসলাম ডেস্ক : দেশের প্রশাসনিক কাজ-কর্মের প্রাণকেন্দ্র- সচিবালয় যে জমিতে নির্মিত হয়েছে তার মালিক ছিলেন আইনউদ্দিন হায়দার ও তার স্ত্রী ফয়জুন্নেছা। মৃত্যুর আগে এ দম্পতি সাড়ে ১২ হাজার একর জমি ওয়াকফ প্রশাসনের নামে দিয়ে যান। সে হিসেবে নথিপত্র অনুযায়ী এ জমি ওয়াকফ প্রশাসনের দখলে আছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাস্তবতা হলো, এ জমির কিছু অংশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বেশির ভাগই রয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে। তারা সেগুলোয় স্থায়ী স্থাপনা গড়ে তুলেছেন।
শুধু আইনউদ্দিন হায়দার ও ফয়জুন্নেছার জমিই নয়, ওয়াকফ প্রশাসনের ৯০ শতাংশ জমিই এখন বেদখল। সম্প্রতি ওয়াকফ প্রশাসনের কার্যালয় থেকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিবের দপ্তরে পাঠানো এক চিঠি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র : দৈনিক আমাদের সময়
ওয়াকফ প্রশাসন কার্যালয় জানায়, দলিলপত্র অনুসারে সারা দেশে ওয়াকফ এস্টেটের সংখ্যা সাড়ে ৩ লাখ। এর মধ্যে মাত্র ২১ হাজার এস্টেট তাদের দখলে আছে। বাকি ৩ লাখ ২৯ হাজার এস্টেটই বেহাত হয়ে গেছে। হিসাব অনুসারে মোট জমির পরিমাণ ১ লাখ ৯৩ হাজার ২৪৯ একর। এর মধ্যে ১ লাখ ২২ হাজার ২৯৪ একর এখন বেদখল। প্রশাসনের দখলে আছে ৭০ হাজার ৯৫৫ একর জমি।
এ প্রসঙ্গে ওয়াকফ প্রশাসন কার্যালয়ের সহকারী প্রশাসক মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, ১৯৫০ সালের দিকে ওয়াকফর জমি নিয়ে তেমন খোঁজখবর নেওয়া হয়নি, তখন ওয়াকফ এস্টেটের অনেক জমি সরকার অধিগ্রহণ করে। কিন্তু ওইসব জমির কোনো ক্ষতিপূরণ ওয়াকফ প্রশাসন পায়নি। এখন যেসব জমি বেদখল হয়ে গেছে সেগুলো উদ্ধার করতে মামলা করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এবং ওয়াকফ প্রশাসনের নিয়োগ করা মোতোওয়ালির সহযোগিতায় এসব জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। মোতোওয়ালি স্থানীয়দের সঙ্গে আঁতাত করে সরকারের ভূমি জরিপ কার্যক্রম চলাকালে ওয়াকফ এস্টেটের জমি বিভিন্ন ব্যক্তির নামে রেকর্ডভুক্ত করাতে সহায়তা করেছে। এভাবে বেদখল হয়ে গেছে ওয়াকফর জমি। এসব জমির বেশিরভাগই ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে দলিল করে দখল করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসনের চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ওয়াকফ প্রশাসন একটি ধর্মীয় অনুশাসনভিত্তিক সামাজিক কল্যাণকর ও সেবামূলক স্বশাসিত সংস্থা। ১৯৪৩ সালের বেঙ্গল ওয়াকফ অ্যাক্টবলে এ সংস্থা সৃষ্টি হয়। ১৯৬২ সালের ওয়াকফ অধ্যাদেশ অনুযায়ী ওয়াকফ এস্টেটগুলোর তদারকি, নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করাই এ সংস্থার মূল্য লক্ষ্য। কিন্তু দুুর্ভাগ্যের বিষয়, ওয়াকফ প্রশাসনের বেশির ভাগ জমিই এখন বেহাত হয়ে আছে। এসব জমি উদ্ধারে মামলাও চলছে। কিন্তু উদ্ধার করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসন কার্যালয়ের প্রশাসক ও অতিরিক্ত সচিব ফয়েজ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ওয়াকফ এস্টেটের বেহাত জমি উদ্ধার করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা এবং তদারকি করতে তাদের যে জনবল দরকার তা নেই। এ ছাড়া মামলা পরিচালনার জন্য প্রচুর অর্থ দরকার। অনেক ক্ষেত্রে তারা সরকারের অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতা পাচ্ছেন না। যে কারণে জমি উদ্ধার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ব্রিটিশ আমলে আইনউদ্দিন হায়দার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ১৮৬৪ সালে তিনি নিজ জমির একটি বড় অংশ ওয়াকফ করে যান। ১৮৭৭ সালে তার স্ত্রী ফয়জুন্নেছা তাদের জমির বাকি অংশ ওয়াকফ দলিল করে যান। তারা দুজনে মোট ১২ হাজার ৫০০ একর জমি ওয়াকফ করেন। ওয়াকফকৃত এসব জমি প্রথমদিকে সংস্থাটির নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পরবর্তী সময়ে বেহাত হতে শুরু করে। একপর্যায়ে আইনউদ্দিন হায়দার ও ফয়জুন্নেছার ওয়াকফকৃত জমিতে নির্মিত হয় বাংলাদেশ সরকারের প্রধান প্রশাসনিক কার্যালয় হিসেবে পরিচিত ‘বাংলাদেশ সচিবালয়’। এ ছাড়া ওয়াকফকৃত এ জমিতে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির অফিস এবং আবাসিক ভবন নামে পরিচিত ‘বঙ্গভবন’। আরও আছে সরকারি সংস্থা হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটসহ বেশ কিছু সরকারি স্থাপনা। এ ছাড়া বেশ কিছু সরকারি স্থাপনা ওয়াকফ এস্টেটের জমিতে রয়েছে।
জানা গেছে, এসব জমি নিজ দখলে নেওয়ার আইনগত কাঠামো এখন চূড়ান্ত করেনি সরকার। এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগও নেই। এদিকে ওইসব স্থাপনার বিপরীতে সরকার ওয়াকফ প্রশাসনকে কোনো অর্থও দিচ্ছে না। ফলে সরকারি স্থাপনার জমি ওয়াকফ প্রশাসনের কাছে বেদখলি সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
সূত্র জানায়, ওয়াকফ প্রশাসন এর এটেস্টগুলোর মধ্যে যেগুলো বেদখল হয়ে গেছে সেগুলো থেকে কোনো অর্থ পায় না। এমনকি যেগুলো নিয়ন্ত্রণে আছে সেগুলো থেকেও কোনো অর্থ পায় না। ফলে ওয়াকফ প্রশাসনের নামে থাকা দখলি বা বেদখলি সম্পত্তি থেকে কোনোই আয় হচ্ছে না।
জানা গেছে, দেশের সবচেয়ে বড় ওয়াকফ এস্টেট গাজীপুর জেলার শাহজাদি এস্টেট। এই এস্টেটের জমির পরিমাণ ৭২ হাজার একর। কিন্তু বর্তমানে অল্প কিছু জমি ছাড়া এই এস্টেটের সবই বেহাত হয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, এ এস্টেটের মোতোওয়ালি ও ওয়াকফ প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এজন্য দায়ী।
ওয়াকফ প্রশাসন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, ঢাকা বিভাগের আওতাধীন এলাকায় আইনউদ্দিন হায়দার ও ফয়জুন্নেছার ১২ হাজার ৫০০ একর ও শাহজাদি বেগমের ৭২ হাজার একরসহ মোট ওয়াকফ জমির পরিমাণ ছিল ৮৫ হাজার ১০৯ একর। এর মধ্যে ৮৪ হাজার ৬৬৩ একরই এখন বেদখল।
এদিকে চট্টগ্রাম বিভাগে ওয়াকফ প্রশাসনের ১২ হাজার ৮৬৬ একর জমির মধ্যে বেদখল হয়েছে ৬ হাজার ৬৮৩ একর। রাজশাহী বিভাগে ২৩ হাজার ৭১৮ একর জমির মধ্যে বেদখল হয়েছে ২২ হাজার ৯৮৭ একর। রংপুর বিভাগে ১ হাজার ৫০১ একর জমির মধ্যে বেদখল হয়েছে ৬৭৪ একর। খুলনা বিভাগে ২ হাজার ৮৫৩ একর জমির মধ্যে বেদখল হয়েছে ৭৫৫ একর। বরিশাল বিভাগে ৫৫ হাজার ৩১৯ একর জমির মধ্যে বেদখল হয়েছে ১ হাজার ৪০৬ একর। সিলেট বিভাগে ১১ হাজার ৮৮১ একর জমির মধ্যে বেদখল হয়েছে ৫ হাজার ১৬২ একর জমি।
ওয়াকফ প্রশাসন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, ওয়াকফ এস্টেটের জমির তদারকি, নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে ১০ জন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা, ৬৭ জন তৃতীয় শ্রেণির এবং ৩৪ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীসহ মোট ১১১টি পদ রয়েছে। কিন্তু এসব পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৯৯ জন। এই জনবল দিয়ে ওয়াকফ এস্টেটের বেহাত হওয়া জমি উদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না।
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /আরআর