ফয়জুল আল আমীন : ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডেলিগেট সংখ্যা এখন ১২৩৯, যদিও জয়ের জন্য ম্যাজিক নম্বর ছিল ১২৩৭। ফলে তার রিপাবলিকান দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত হয়ে গেছে। দলীয় নেতারা তার পেছনে জড়ো হচ্ছেন। স্পিকার পল রায়ান ও দলের বড় নেতারা তার পক্ষে আসছেন। অপরদিকে হিলারি ক্লিন্টন তার দলের অনেকটা নিশ্চিত প্রার্থী হলেও তার মনোনয়ন এখনো চূড়ান্ত নয়। তার ডেমোক্রেট দলে জয়ের জন্য ম্যাজিক নম্বর হলো ২৩৮৩; কিন্তু হিলারির আছে ২৩০৯। অর্থাৎ এখনো বাকি ৭৪টি গেলিগেট ভোট। তবে বার্নি স্যান্ডার্স যদি বাকি সবগুলো স্টেটেও জেতেন তবুও হিলারির মনোনয়ন লাভ নিশ্চিতপ্রায়। ক্যালিফোর্নিয়াতে ডেলিগেট সংখ্যা ৫৪৬, সেখানে ৭ জুনের প্রাইমারিতে স্যান্ডার্স-হিলারি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হিলারি চাইছেন এখানে জিতে প্রাইমারি শেষ করতে। স্যান্ডার্স জয়ী হলে বা হিলারি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলে ডেমোক্রেট শিবিরে বইতে পারে পাল্টা হওয়া।
গত ৫ মে এক জরিপে হিলারি এখানে ১০ পয়েন্টে এগিয়ে থাকলেও সদ্য ফক্স জরিপ দেখাচ্ছে সমান-সমান, হিলারি ৪৮%, বার্নি ৪৬%। তবে মিশিগানের মতো সব জরিপ ম্লান করে দিয়ে বার্নি স্যান্ডার্স ক্যালিফোর্নিয়াতে ব্যাপকভাবে জয়ী হবেন বলে বার্নি শিবির আশা করছে। কেননা বার্নির একের পর এক জয়ে সবাই চমকিত এবং তার সমর্থন বাড়ছে। যদিও স্যান্ডার্স কোনোভাবেই প্রচলিত প্রথায় দলীয় মনোনয়ন পাবেন না, অর্থাৎ প্রয়োজনীয় ডেলিগেট তিনি পাবেন না। তাই তিনি চাচ্ছেন, কন্টেস্টেড সম্মেলন। হিলারি যদি ম্যাজিক নম্বরে পৌছতে ব্যর্থ হন, তবে ডেমোক্রেট দলে তা-ই হবে। সেক্ষেত্রে বার্নি স্যান্ডার্সের ভাগ্য খুলতে পারে। অবশ্য অন্য ইকুয়েশনও আছে। আর সে জন্যই বার্নি শেষ পর্যন্ত রেসে থাকছেন। রিপাবলিকান দলে প্রথম দিকে কন্টেস্টেড সম্মেলনের সম্ভাবনা দেখা দিলেও এখন ট্রাম্পই দল গোছাতে সচেষ্ট হচ্ছেন। বিভক্তি এখন ডেমোক্রেটদের মধ্যে।
বিশ্লেষকদের মতে, হিলারি মনোনয়ন পেলেও ডেমোক্রেট সম্মেলন খুব একটা সুখপ্রদ হবে বলে মনে হয় না। কারণ স্যান্ডার্সের অভাবনীয় উত্থানে ডেমোক্রেটরা চিন্তিত। শেষ পর্যন্ত কি হয় বলা মুশকিল। বার্নির একাংশ সমর্থক হিলারিকে সমর্থন নাও করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে জয় হিলারির জন্য সোনার হরিণ হয়ে যাবে। তবে হিলারি-বার্নি জুটি হলে ভিন্ন কথা, তা কি হবে? রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই, তবুও হিলারি-বার্নি তিক্ততার কথা মনে রেখে অনেকেই সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দিচ্ছেন। এমনিতে বলা হচ্ছে, হিলারি পারবেন না ট্রাম্পকে হারাতে, স্যান্ডার্স পারবেন। বিভিন্ন জরিপ তাই বলছে। বার্নি বলেছেন, তিনি কনভেনশন পর্যন্ত যাবেন। দলীয় নেতা বা অঙ্গীকারাবদ্ধ ডেলিগেটদের তিনি তার পক্ষে আসার জন্যও আহবান জানিয়েছেন। গত সপ্তাহের এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, ভোটাররা হিলারি বা ট্রাম্প কাউকেই পছন্দ করছেন না, ট্রাম্পকে অপছন্দ ৫৮%-এর, হিলারিকে পছন্দ করছেন না ৫৪%। এরপরও শেষ পর্যন্ত যদি ওই দুজনই প্রার্থী হন, তবে ভোটারদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই একজনকে বেছে নিতে হবে।
২৫ মে স্টেট ডিপার্টমেন্ট অডিট হিলারির কড়া সমালোচনা করে বলেছে, ব্যক্তিগত ই-মেইল ব্যবহার করে হিলারি ‘দেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি’ নিয়েছেন এবং তিনি প্রশাসনিক নীতিমালা মানেননি বা আইনগত পরামর্শও নেননি। হিলারি অবশ্য বলেছেন, তিনি সব ই-মেইল জমা দিয়েছেন এবং এ ঘটনা তার নির্বাচনী প্রচরণা বা প্রেসিডেন্সির কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। ট্রাম্প বলেছেন, বিষয়টি অত সোজা নয়। ট্রাম্পের ট্যাক্স-রিটার্ন প্রকাশের জন্য তার ওপর চাপ বাড়ছে, কিন্তু তিনি বারবারই তা নাকচ করে বলছেন, ‘ওটা আইআরএস ও আমার মধ্যকার বিষয়’। শেষ পর্যন্ত তিনি যদি তা প্রকাশ না করেন তবে চার দশকে এটি একটি রেকর্ড হবে। ট্যাক্স-রিটার্ন প্রকাশে আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, তবে সবাই তা করে থাকেন।
ওবামা বলেছেন, মার্কিন ভোটাররা সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। স্মর্তব্য যে, পূর্বাহ্নে ওবামা বলেছিলেন, ট্রাম্প কখনো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবেন না। ওবামার মতো ওয়াশিংটনে অনেকের ধারণা যে, হিলারি প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। তাদের মতে, ট্রাম্প তো যাবেনই, সঙ্গে সিনেটও নিয়ে যাবেন, অর্থাৎ রিপাবলিকানদের হাত থেকে সিনেট ডেমোক্রেটদের হাতে চলে যাবে। তবে ১৮ মে এক জরিপে দেখা যায়, হিলারি সামান্য ব্যবধানে ট্রাম্প থেকে পিছিয়ে পড়েছেন, ট্রাম্প ৪৫%; হিলারি ৪২%। যদিও এটা ভুলভ্রান্তির সীমানার মধ্যে তবুও লক্ষণীয় যে, এপ্রিলে সকল জরিপেই হিলারি বেশ ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন। কয়লাসমৃদ্ধ স্টেটে হিলারির অবস্থান বেশ নড়বড়ে। ডেমোক্রেটরা ভয় পাচ্ছেন, হিলারি হয়তো ট্রাম্পকে হারাতে পারবেন না, তাই বার্নির সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ডেমোক্রেট দলে বিভক্তিতে ট্রাম্প লাভবান হবেন। এর আগে রিপাবলিকান শিবিরে ট্রাম্প বিরোধীরা উঠেপড়ে লেগেছিলেন যাতে ট্রাম্পকে ঠেকানো যায়। তারা এমনকি নির্দলীয় তৃতীয় প্রার্থী দেয়ার জন্য কাজ শুরু করেন। এই উদ্যোগে জল ঢেলে দেন রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির চেয়ার রিয়ানস প্রিবাস। এতসবের পরও ট্রাম্প কিন্তু এখনো দলীয় নেতাদের আক্রমণ করতে ছাড়ছেন না। তাই প্রশ্ন উঠেছে, ট্রাম্প কিভাবে দলে ঐক্য ফিরিয়ে আনবেন? তবে কি ট্রাম্পের নমিনেশন রিপাবলিকান পার্টিতে বিভক্তি প্রসারিত করবে? ট্রাম্পবিরোধী শিবিরে রথী-মহারথীর অভাব নেই, ক্রুজ-কাসিচ তো আছেনই। তবে এর মধ্যে ট্রাম্প শিবিরের জন্য ভালো খবর রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট সবাইকে ট্রাম্পের পেছনে সমবেত হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। বিপক্ষ শিবিরে আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছে দেখে ডেমোক্রেট শিবিরের খুশি হওয়ার মতো কোনো কারণ নেই।
এদিকে হিলারির মুখ থেকে ভোটাররা নুতন কিছু শুনছে না, পুরাতনরা তার সঙ্গে থাকলেও নুতনদের তিনি টানতে পারছেন না। স্যান্ডার্সের বসে পড়ার কোনো লক্ষণ নেই, বরং তিনি বলেছেন, ১৪ জুন প্রাইমারির শেষ দিন পর্যন্ত হিলারি ম্যাজিক নম্বর ডেলিগেট পাবেন না, তাই ‘কনটেস্টটেড কনভেনশন’ অনিবার্য। তিনি সুপার ডেলিগেটদের পক্ষ ত্যাগ করারও আহবান জানিয়েছেন। আর হিলারি যদি দলীয় মনোনয়ন পেয়েও যান, বার্নি স্যান্ডার্স স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে তো কোনো আপত্তি নেই! তিনি যদি প্রার্থী নাও হন, তার সমর্থকরা কি হিলারিকে ভোট দেবে? ট্রাম্প বলছেন, স্যান্ডার্সের অনেক সমর্থকই তাকে চুপি চুপি ভোট দেবে।
বিপরীত চিত্র হলো, ট্রাম্প নারী সংক্রান্ত বিষয়ে ক্লিন্টনকে যাচ্ছেতাইভাবে আক্রমণ করেছেন। অনেকেরই প্রশ্ন, ট্রাম্প এবার কিভাবে এগিয়ে এলেন? প্রধানত দুটি কারণেÑ এক. মেস্কিকানদের গালিগালাজ করে তিনি বলেছেন, মেস্কিকো সীমান্তে দৈত্যাকার দেয়াল দেবেন এবং এর খরচ আনুপাতিক হারে মেস্কিকোকে বহন করত হবে। দুই. তিনি মুসলমানদের আমেরিকায় ঢোকা বন্ধ করে দেবেন। তিনি শুধু যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তা নয়, তিনি মেস্কিকান ক্রিস্টানদের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন, মূলত তাকে ‘এন্টি-ইমিগ্র্যান্ট’ বলা যেতে পারে। তবে বাংলাদেশের যারা ট্রাম্পবিরোধী বা তার বক্তব্য অপছন্দ করছেন, তাদের অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় এক একজন ট্রাম্প! বিবিসি অবশ্য একটি ভিডিও করে দেখিয়েছে, প্রেসিডেন্ট হলে ট্রাম্প সম্ভবত দেয়াল তৈরি বা ইমিগ্রেশন ঠেকানো কোনোটার পক্ষেই থাকবেন না।
সম্প্রতি পিউ রিসার্স জরিপে দেখা যায়, ট্রাম্প ও হিলারি তিনটি সুইয়িং স্টেটে সমানে-সমান, এগুলো হচ্ছে, ফ্লোরিডা, ফিলাডেলফিয়া ও ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া। তবে ওইসব স্টেটে হিলারির চেয়ে বার্নির অবস্থান ভালো এবং তিনি প্রার্থী হলে ট্রাম্পের খবর আছে। বার্নি অবশ্য দরজা খোলা রেখেছেন ‘ভাইস-প্রেসিডেন্ট’ পদে হিলারির সঙ্গে জুটি বাঁধতে। এপ্রিলের শেষে ট্রাম্প তার ফরেন পলিসি ভাষণে নিজেকে প্রেসিডেন্টসিয়াল হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এবং বলেছেন, আমেরিকা ফার্স্ট।
দেখা যাক, মার্কিনিরা শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প না ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট হিলারিকে জয়মাল্য পরান।
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম / এআর