ফয়জুল আল আমীন : গত ০৪ জুন বিশ্বের সর্বকালের সেরা মুষ্টিযোদ্ধা মুহাম্মদ আলী ইন্তেকাল করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। মুহাম্মদ আলী ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সফর করেন। সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও রয়েছে তার কোটি কোটি ভক্ত। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
মুহাম্মদ আলীর জন্ম ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি। তিনি তিনবারের ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন এবং অলিম্পিক লাইট-হেভিওয়েট স্বর্ণপদক বিজয়ী। ১৯৯৯ সালে মুহাম্মদ আলীর নাম বিবিসি এবং স্পোর্টস ইলাট্রেটেড স্পোর্টসম্যান অব দ্য সেঞ্চুরি অথবা শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৪ সালে ইসলামি সংগঠন নেশন অব ইসলামে যুক্ত হয়ে ১৯৭৫ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব।
শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ
ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে নামে জন্ম নেয়া আলি বিখ্যাত হয়ে উঠেন ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকে লাইট-হেভিওয়েটে সোনা জিতে। ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ ডাকনাম পাওয়া আলি ১৯৬৪ সালে সনি লিস্টনকে হারিয়ে প্রথম বিশ্ব খেতাব জেতেন। পরে তিনি প্রথম বক্সার হিসেবে তিনবার বিশ্ব হেভিওয়েট শিরোপা জেতেন। ১৯৮১ সালে পেশাদার বক্সিং থেকে অবসর নেয়ার আগে ৬১টি পেশাদার লড়াইয়ের মধ্যে ৫৬টিতে জেতেন আলি। এর মধ্যে ৩৭টি লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে নকআউট করেছেন তিনি। নিজে একবারও নকডআউট হননি।
১৯৯৯ সালে মুহাম্মদ আলীর নাম বিবিসি এবং স্পোর্টস ইলাট্রেটেড স্পোর্টসম্যান অব দ্য সেঞ্চুরি অথবা শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৪ সালে ইসলামি সংগঠন নেশন অব ইসলামে যুক্ত হয়ে ১৯৭৫ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব।
রোম অলিম্পিকের পর আলি পেশাদার জগতে পা রাখেন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭, ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ ও ১৯৭৮ থেকে ১৯৭৯ সাল তিনি বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। প্রথম বিশ্ব শিরোপা জেতার পর তখনও ক্যাসিয়াস ক্লে নামেই পরিচিত আলি নেশন অব ইসলাম নামে একটি সংস্থার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, যাদের উদ্দেশ ছিল যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান আমেরিকানদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন করা। ১৯৬৭ সালে ভিয়েতনামে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ নেয়ার বিরোধিতা করে দেশে সমালোচনার মুখে পড়েন আলি। তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীযে যোগ দিতে অস্বীকার করায় তার বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব ও বক্সিং লাইসেন্স কেড়ে নেয়া হয়। পরের চার বছর আলি লড়াইয়ে অংশ নিতে পারেননি। ১৯৭১ সালে পক্ষে রায় আসার পর আলি রিংয়ে ফিরে বক্সিং ইতিহাসের তিনটি বিখ্যাত লড়াইয়ের অংশ হন।
নিউ ইয়র্কে ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ ‘ফাইট অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামে পরিচিত ম্যাচে পেশাদার ক্যারিয়ারে আলি প্রথম পরাজয়ের স্বাদ পান জো ফ্রেইজারের কাছে। ১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর জায়ারের (এখন ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কংগো) কিনশাসায় ‘রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল’ নামে পরিচিত লড়াইয়ে জর্জ ফোরম্যানকে হারিয়ে বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নের খেতাব পুনরুদ্ধার করেন আলি। ১৯৭৫ সালের ১ অক্টোবর ফিলিপিন্সের ম্যানিলায় ফ্রেইজারকে হারিয়ে প্রতিশোধও নেন তিনি।
১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিয়ন স্পিংক্সের কাছে পয়েন্টে হেরে খেতাব হারান আলি। অবশ্য বছরের শেষের দিকে প্রতিশোধ নিয়ে আবার তা পুনরুদ্ধার করেন। ১৯৮০ সালে ল্যারি হোমস ও ১৯৮১ সালে ট্রেভর বেরবিকের কাছে একতরফা হারে ক্যারিয়ার শেষ হয় আলির। তারপরই দেখা দিতে শুরু করে পারকিনসন্স রোগের লক্ষণ।
ইসলাম গ্রহণের কারণ
ক্যাসিয়াস মারসেলাস ক্লে তখন বিশ্ববিখ্যাত বক্সার। গগনচুম্বি তার জনপ্রিয়তা। তার গায়ের রঙ কালো। এটাই যেন তার অপরাধ। তিনি শিকার হন চরম বর্ণবৈষম্যের। তাকে বসতে দেয়া হতো না শ্বেতাঙ্গদের হোটেল-রেস্তোরাঁয়। দেওয়া হতো না খাবার। চারপাশ থেকে ভ্রূকুটি। সে এক অসহ্য পরিবেশ। এক সময় ক্যাসিয়াস ক্লে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থা ও শ্বেতাঙ্গদের আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। খুঁজতে থাকেন এ বৈষম্য থেকে মুক্তির পথ, সাম্যের পথ। ১৯৬৪ সালের কথা। তার কাছে পৌঁছে যায় ইসলামের বাণী। এলিজা মোহাম্মদ ও ম্যালকম এক্সের নেতৃত্বাধীন ‘নেশন অব ইসলাম’ নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ক্যাসিয়াস মারসেলাস ক্লে’র। ইসলামের সুমহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হন তিনি। জানতে পারেন ইসলামে নেই কোনো বর্ণ-বৈষম্যমূলক ভেদাভেদ। এক সময় ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। নাম ধারণ করেন ‘মোহাম্মদ আলী’। আলী তার ক্যাসিয়াস ক্লে নামকে অভিহিত করলেন,‘দাসত্বের নাম’ হিসেবে।
তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। সনি লিস্টনকে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে তিনি তার শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পান। এর দুই দিন পর বিশ্ব অবাক হয়ে শুনল তার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের খবর। লিস্টনকে হারানোর চেয়েও যেটি ছিল চাঞ্চল্যকর। তিনি পবিত্র কোরআন-হাদিস অধ্যয়ন করতে থাকেন এবং ১৯৭৫ সালে সুন্নী মুসলিম হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আলীর ইসলাম ধর্ম গ্রহণকে পশ্চিমা মিডিয়া ভালো চোখে দেখেনি। তাকে এজন্য মিডিয়ার অনেক গঞ্জনাও সইতে হয়েছে।
ইসলামের সুমহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হন তিনি। জানতে পারেন ইসলামে নেই কোনো বর্ণ-বৈষম্যমূলক ভেদাভেদ। এক সময় ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। নাম ধারণ করেন ‘মোহাম্মদ আলী’। আলী তার ক্যাসিয়াস ক্লে নামকে অভিহিত করলেন,‘দাসত্বের নাম’ হিসেবে।
তার দেখাদেখি তারই ছোট ভাই রুডলফও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, নিজের নাম পাল্টে রাখেন ‘রহমান আলী’। মেয়ে লায়লা আলীও পরবর্তীতে বক্সিং-এ সুনাম অর্জন করেন। ঐ সময় মোহাম্মদ আলী বলতেন, আমাকে যদি ‘ইসলাম এবং বক্সিং এ দুটোর মধ্য থেকে কোনো একটিকে বেছে নিতে বলা হয়; তবে আমি ইসলামকেই বেছে নেবো। তিনি আমৃত্যু মানুষের মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠা ও ভেদাভেদ নির্মূলে শান্তির লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন।
তিনি ছিলেন একজন মানবাধিকার কর্মী যিনি খেলা ও জাতীয়তার সীমা ছাড়িয়ে পুরো বিশ্বে পরিচিত হয়ে ওঠেন। যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামের পতাকা সমুন্নত রাখতে বরাবরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ মুহাম্মদ আলী। সম্প্রতি রিপাবলিকান দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসলাম বিদ্বেষী মন্তব্য করলে মুহাম্মদ আলী ট্রাম্পের কঠোর সমালোচনা করেন। এর আগেও বিভিন্ন সময় ইসলাম বিদ্বেষী বক্তব্যদানকারী ব্যক্তিদের সমালোচনা করেছিলেন এই মহান ব্যক্তি।