|| মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক ||
আকাবিরের শুধু নাম শুনে নেওয়াও অনেক বড় সৌভাগ্য। আর যদি পরিচয় লাভ হয় তাহলে তো আরও বড় সৌভাগ্য! তার ওপর যদি তাঁর হেদায়াত ও খেদমত থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়, তাহলে তো নূর আলা নূর, সোনায় সোহাগা। আর যদি তাঁর সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় থাকে এবং তাঁর সোহবতে ও জিয়ারতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই!
আমি গ্রামের এক মাদরাসার (মাদারাসা আরাবিয়া খেড়িহর, শাহরাস্তি, চাঁদপুর) অধম তালিবুল ইলম। স্বভাবগতভাবেই আমি কিছুটা বেখবর মানুষ, তার সঙ্গে যদি যুক্ত হয় উদাসীনতার আরও বিভিন্ন কারণ, তখন এক কম বয়সী তালিবুল ইলমের জন্যে আর কতটুকু বাখবর হওয়া সম্ভব! তারপরও আমি আল্লাহর শোকর আদায় করি, শোকর আদায় করি আমার ওয়ালিদাইন মাজিদাইনের এবং মুশফিক আসাতিজায়ে কেরামের, তাদের তাওয়াজ্জুহের বরকতে ছাত্রজীবনের অধিকাংশ সময় বেখবর পরিবেশে কেটে যাওয়ার পরও দেশের এবং দেশের বাইরের নিকট অতীতের অনেক আকাবির এবং অনেক বাহায়াত আকাবিরের ব্যাপারে আমার ইলম হাসিল হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা আমার ওয়ালিদাইনকে, আমার সকল আত্মীয় মুরব্বিকে, আমার বড় ভাইকে এবং আমার সকল আসাতিজাকে নিজের শান মোতাবেক আজর দান করুন। তাদের তরবিয়ত ও তাওয়াজ্জুহের বরকতেই আমি আকাবিরের ব্যাপারে ইলম হাসিল করতে পেরেছি, অন্তরে আকাবিরের মহব্বত নিয়ে বড় হতে পেরেছি। তাদের সোহবত ও তরবিয়তের বরকতে অন্তরে এসকল বিষয় গেঁথে গেছে-
১. প্রত্যেক যুগের আকাবিরে উম্মত ইলমের সে সকল ধারক-বাহকের অন্তর্ভুক্ত, যাদের মাধ্যমে আল্লাহ দীন ও শরিয়তের সিলসিলা জারি রেখেছেন। সুন্নত জিন্দা রেখেছেন। শিরক-বিদআত কুফর ইলহাদ এবং সকল বাতিলকে হক থেকে পৃথক করে দিয়েছেন।
২. শরিয়তের পাবন্দ, সুন্নাতের অনুসারী আকাবিরে উম্মত আমাদের আদর্শ। তাদের হালকায় শামিল থাকা, তাদের সাথে নিজের নিসবত যুক্ত রাখা এবং সেই নিসবতের লাজ রক্ষা করা- এতেই আমাদের সৌভাগ্য। নির্বুদ্ধিতার শিকার হয়ে অতি ইলমের বা অতি হেদায়াতের ধোঁকায় পড়ে তাদের ‘হালকা’ থেকে যদি কেউ দূরে চলে তাহলে-আল্লাহ পানাহ- এতে নিজেরই ক্ষতি। এ অবস্থায় যদি কোনো সহিহ খেদমতও হয়, তাহলেও তা বরকত ও মকবুলিয়াত থেকে মাহরুম থাকে।
৩. আকাবিরের কোনো এক ব্যক্তি ভিন্নভাবে মাসুম নন, কিন্তু আকাবিরের সকল ফরদ এমন, যার মধ্যে খায়ের ও নেকির দিকটাই প্রবল। তথাপি মাসুম নয় এমন ব্যক্তি থেকে কখনও কোনো ভুল প্রকাশ পাওয়া বা কোনো বিষয়ে কিছু বাড়াবাড়ি বা শৈথিল্য হয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এক্ষেত্রে শরিয়তের হুকুম হলো, ভুলের ক্ষেত্রে কারও তাকলিদ করা যাবে না। এবং কারও ‘তাসামুহে’র কারণে ‘রাহে ইতিদাল’ পরিত্যাগ করা যাবে না। আবার ভুল বা তাসামুহের কারণে আকাবিরদের থেকে ইস্তিফাদা বন্ধও করা যাবে না। এতে নিজেরই ক্ষতি। আর তাদের কারও সাথে বেয়াদবির অর্থ হলো, নিজের দীন ও ঈমান এবং নিজের আখেরাতকে বরবাদ করা। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন।
نَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الحَوْرِ بَعْدَ الكَوْرِ
৪. এটা স্পষ্ট যে, কোনো এক ব্যক্তির জন্যে নিজের ইলমি ও ইসলাহি তায়াল্লুক সকলের সাথে রাখা মুশকিল। তবে হ্যাঁ, আজমত ও মহব্বত সকল আকাবিরের প্রতি থাকা জরুরি। এখানে অনেকে ভুল করে ফেলে। তারা ইত্তেবা ও তাআল্লুুক এবং আজমত ও আদবকে এক বানিয়ে ফেলে। অথচ এ বিষয়গুলোর মাপকাঠি হুবহু এক নয়। হাকিমুল উম্মত ও অন্যান্য আরও আকাবিরের বারবার তাকিদ করা একটি নসিহত আমাদের মনে রাখা দরকার। তা হলো, নিজের আমলি মুরব্বি বা ইসলাহি মুরব্বির তাহকিক ও জওকের ওপর আমার আমল করা উচিত। কিন্তু যে মাসয়ালায় আকাবিরদের মাঝে ইজতেহাদি ইখতেলাফ রয়েছে, বা যে বিষয়ে তাদের মাঝে জওকের ভিন্নতা রয়েছে, আমার জন্যে উচিত নয়, আমার ইসলাহি বা ইলমি মুরব্বির জওক অন্য কোনো বুজুর্গ বা তার অনুসারীর ওপর চাপিয়ে দেব। এবং কারও এই অধিকারও নেই যে, শুধু জওকি ও ইজতেহাদি ইখতেলাফের কারণে কোনো মুরব্বির নিন্দা করবে। আর গিবত ও সমালোচনা কারও ক্ষেত্রেই জায়েজ নেই।
৫. আমাদের বড়রা আমাদেরকে এ শিক্ষাও দিয়েছেন যে, আমরা যেন ‘মুশাজারাতে আকাবিরে’র ক্ষেত্রে ‘মুশাজারাতে সলফে’র পন্থাই অবলম্বন করি। মুতাকাদ্দিমিনের মধ্যে ইবনে আবদুল বার ‘জামিউ বায়ানিল ইলমে’, এর পরবর্তী যুগে তাজুদ্দিন সুবকি ‘তবাকাতে শাফিইয়্যার’ মধ্যে এবং নিকট অতীতে শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলভী রহ. ‘আল ইতিদাল’ ও ‘তাকমিলাতুল ইতিদাল’-এ এই কায়দা ও আদাব উল্লেখ করেছেন এবং তা গুরুত্বের সাথে ধারণের তাকিদ করেছেন।
আমি আমার আসাতিজা ও মুরব্বিদের দিল থেকে শোকরিয়া আদায় করছি যে, তারা ইত্তেবায়ে আকাবিরের ক্ষেত্রে আমাদেরকে এই ‘সিরাতে মুস্তাকিমের’ রাহনুমায়ি করেছেন এবং তার ওপর দৃঢ় থাকার তালকিন করেছেন। ভূমিকাটি লম্বা হয়ে গেল, কিন্তু মনে হয় বেফায়দা হয়নি ইনশাআল্লাহ। এর থেকে কর্মজীবনের অনেক ক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যাবে।
আকাবিরের অস্তিত্বই অনেক বড় নেয়ামত। তাদের কারও আখেরাতের সফরে রওয়ানা হয়ে যাওয়া জীবিতদের জন্যে অনেক বড় বিপদ। আরবিতে এই প্রবাদ প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে- আলেমের মৃত্যু আলমের মৃত্যু। যোগ্য লোকের অভাবের এই যুগে বড় বড় ব্যক্তি তো এমনিতেই হাতে গণনা করার মতো। ওদিকে দু’চার জন যারা আছেন তারাও একের পর এক বিদায় নিচ্ছেন। এবং অবস্থা এই যে, যিনি যাচ্ছেন, তার জায়গা পূরণ হওয়ার কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না। আফসোস! আকাবিরের কাফেলার অনেক বড় ব্যক্তিত্ব হজরত মাওলানা মুফতী আব্দুর রহমান সাহেব বিদায় নিয়ে গেলেন।
إنا لله و إنا إليه راجعون، إن لله ما أخذ و له ما أعطى و كل شيء عنده بمقدار.
হজরতের মাঝে আল্লাহ তায়ালা অনেক গুণের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে দান করেছেন বৈচিত্র্যময় কর্মজীবন। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর খেদমত করেছেন তিনি অনেক দিক থেকেই। তাঁর খেদমতের ময়দান ছিল অনেক বিস্তৃত। যেসকল উলামায়ে কেরাম তাঁকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন, তাঁর কর্ম ও কীর্তির ওপর তারাই লেখার সবচেয়ে হকদার। আমি একজন তালিবুল ইলম। শুধু বরকত হাসিলের জন্যে হজরতের সঙ্গে আমার কিছু স্মৃতির কথা আলোচনা করব।
আমি আগেই বলেছি, আমি স্বভাবগতভাবেই কিছুটা বেখবর। এবং প্রায় বেখবর মাহাওলেই আমার বেড়ে ওঠা। সম্ভবত ১৪০৬ হিজরি সনে সর্বপ্রথম আমি ওয়ালিদ সাহেব রহ. থেকে হজরত মুফতী সাহেবের নাম শুনি। তখন আমি খেড়িহর মাদরাসার তালিবুল ইলম। সে বছর দারুল উলুম হাটহাজারীর সাবেক মুহতামিম হজরত মাওলানা হামেদ সাহেব রহ.-এর উদ্যোগে শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম ও দেশের প্রায় সকল মাদরাসার মুহতামিম ও নাজিমে তালিমাতকে নিয়ে একটি পরামর্শসভা আয়োজন করা হয়। যতদূর মনে পড়ে, এর বিষয়বস্তু ছিল তালিম ও তারবিয়াত এবং ইসলাহি খেদমতের ক্ষেত্রে মাদরাসাগুলোর উন্নতির বিষয়ে মুজাকারা ও মাশওয়ারা, ওয়ালিদ সাহেব সেই মজলিসে যোগদান করেছিলেন। তিনি ওখান থেকে ফেরার পর সেখানকার কিছু কারগুজারি শোনাচ্ছিলেন। যতটুকু মনে পড়ে, তখন সর্বপ্রথম হজরত মুফতী আবদুর রহমান সাহেব রহ.-এর নাম শুনি। কিন্তু আমার বেখবরির হালত দেখুন, হজরতের ব্যাপারে বিস্তারিত জানি তারও আরও অনেক পরে-যখন আমি রিয়াদে- বেরাদারে মুহতারাম মাওলানা রিযওয়ানুর রহমান ইবনে হজরত প্রফেসর হামীদুর রহমান থেকে। হজরতের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ তার মাধ্যমেই হয়। ১৪১৬ হিজরি রজব মাসে শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.-এর ওখান থেকে দুই মাসের জন্যে দেশে আসি, কিন্তু দ্বিতীয়বার আবার শায়খের খেদমতে যাওয়ার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হই। ১৪১৬ শাবানে হজরত ওয়ালিদ সাহেব রহ. এবং করাচির কয়েকজন আকাবিরের পরামর্শে ভাই সাহেব কয়েকজন মুহিব্বিনসহ মারকাজুদ দাওয়াহ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এবং আমাকেও তাতে শামিল করে নেন। এখানে ওয়াদাবদ্ধ হওয়ার পর ১৪১৬ হিজরির রমজানুল মোবারকে মাওলানা রিযওয়ানুর রহমানের মাধ্যমে হজরত মুফতী সাহেবের পয়গাম পৌঁছে। রিযওয়ান ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন। সেই সাক্ষাতে হজরত সুধারণাবশত মারকাজুল ফিকরিল ইসলামিতে উলুমুল হাদিসের খেদমতের দাওয়াত দেন। হজরতের মতো জালিলুল কদর উঁচু মরতবার বুজুর্গ ও অভিজ্ঞ লোকের ছায়ায় খেদমতের সুযোগ কত উপকারী এবং অন্তর প্রশান্তকারী তা বলা বাহুল্য। কিন্তু আমি যেহেতু পূর্ব থেকে ওয়াদাবদ্ধ ছিলাম, তাই মাজিরাত করা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। হজরতও খুব স্পষ্ট ভাষায় বললেন, আমি চাই বাংলাদেশে ইলমে হাদিসের চর্চা হোক, শুধু আমার এখানেই হবে এটা জরুরি নয়। আপনি যেখানেই মাদরাসা করেন এবং এই ফনের চর্চা করেন কোনো বাধা নেই। আমার যদি সম্ভব হয়, আমি পাঁচ টাকা দিয়ে হলেও আপনার সহযোগিতা করব। সত্যি বলতে কী, বড়দের কথাও অনেক বড় হয়। ওই সাক্ষাতে হজরতের কাছে এই তথ্যটিও পেয়েছি যে, হজরত যে বছর দারুল উলুম দেওবন্দে দাওরা শেষ করলেন, সে বছর দারুল উলুমে সর্বপ্রথম তাকমিলে ইফতার বিভাগ খোলা হয়। এবং হজরত ও তার সাথীরাই এই বিভাগের প্রথম ছাত্র। যতদূর মনে পড়ে, হজরত ১৯৫১ সনের কথাই বলেছেন। এতে বোঝা যায়, দীন, ইলমে দীন, ইসলাম ও উম্মতে মুসলিমার কল্যাণে হজরতের খেদমতের ব্যাপ্তি ষাট বছরেরও কিছু অধিককাল।
তারপর দেখা-সাক্ষাতের ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। আমার নির্ধারিত ব্যস্ততা খুব বেশি বেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বারবার সেখানে হাজির হওয়ার সৌভাগ্য হতো। তাঁর বয়ান থেকে ইস্তেফাদা করার সুযোগ হতো। একসময় বেরাদারে আজিজ মুসলেহুদ্দীন আহমাদ রুমি (হাজী নাজিমুদ্দীন সাহেব রহ.-এর ছোট সাহেবজাদা) মারকাজুল ফিকরিল ইসলামির জামে মসজিদে তারাবিতে কুরআন খতম শোনাত। আমি খতমের রাতে সেখানে তারাবিহ পড়তাম এবং হজরতের বয়ান ও মর্মস্পর্শী দীর্ঘ মোনাজাত থেকে উপকৃত হতাম। যাত্রাবাড়ীতে কয়েকবার দাওয়াতুল হকের মজলিসে হজরতের বয়ান শুনেছি। একবার এমন হয়েছে যে, বয়ানের আগে কেউ এলান করতে চাচ্ছিল। হজরত তার থেকে স্পিকার নিয়ে বললেন, এলানের কী দরকার! এলান করতে গেলে তো শুধু নাম নয়, নামের সাথে ফকীহুল মিল্লাত এবং আরও কত কী বলবেন! এটাও হজরতের বড়ত্বের একটি দলিল।
যাত্রাবাড়িতে একবার হজরত জনসাধারণের উদ্দেশে বয়ান করতে গিয়ে এটাও বলেছেন যে, আপনারা যে সুন্নতের শিক্ষা গ্রহণ করছেন, যদি কোনো আলেমকে তার খেলাফ আমল করতে দেখেন তাহলে ধরে নেবেন, এটা হয়ত কোনো ওজরের কারণে করেছেন। যদি এমন না করে তার ওপর বদগুমানি করেন তাহলে তা আপনার জন্যে ক্ষতির কারণ হবে। সুন্নতের তালিম ও তাবলিগ থেকে যতটুকু অর্জন করলেন, তা বরবাদ হয়ে যাবে।
হজরতের এই কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই এ বিষয়টি খেয়াল করে না। আর অনেকের তো একথা জানাই নেই যে, অনেক জায়গায় মাসনুন তরিকাই থাকে একাধিক। অর্থাৎ খোদ হানাফি মাজহাবেই একাধিক পদ্ধতি রয়েছে। সহজ হওয়ার কারণে অথবা নিজের কাছে রাজেহ মনে হওয়া কারণে কোনো বুজুর্গ যদি কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করেন, তাহলে অনেকে না জানার কারণে অন্য পদ্ধতি অবলম্বনকারী বুজুর্গের ব্যাপারে মন্দ ধারণা করে এবং কখনও কটু কথাও বলে, যা একেবারেই ভুল।
মারকাজুল ফিকরিল ইসলামি থেকে প্রকাশিত হজরতের মালফুজাত এবং ‘মামুলাতে মাছুরা’ থেকেও ইস্তিফাদা করেছি। কুরআনি মক্তবের গুরুত্ব, তালিমে কুরআন, তাসহিহে কুরআন এবং তাজিমে হামিলিনে কুরআন বিষয়ক হজরতের মালফুজগুলো অনেক ভালো লেগেছে। সেখানে জরুরি এবং মুফিদ অনেক কথাই রয়েছে। যেহেতু কিতাবগুলো ছাপানো এবং প্রকাশিত, তাই এখানে কিছু উদ্ধৃত করলাম না।
হজরতের ইন্তেকারের প্রায় বার তের বছর আগের কথা। সেন্ট্রাল হাসপাতালে হজরতের পায়ে অপারেশনের পর শুকাতে দেরি হচ্ছিল। দীর্ঘ সময় হজরতকে হাসপাতালে থাকতে হয়। অবশেষে চিকিৎসার জন্যে হজরত দুবাই তাশরিফ নিয়ে যান। কয়েক মাস পর যখন ফিরে আসেন তখন মাওলানা রিযওয়ানুর রহমান ও মাওলানা হাবীবুর রহমান খানের সাথে আমিও হজরতের ইয়াদাতে যাই বসুন্ধরা মারকাজুল ফিকরিল ইসলামিতে। অনেক লম্বা সময় মজলিস হয়। হজরতও খুব প্রফুল্ল ছিলেন। তখন হজরত একটা কথা বলেছিলেন- ডাক্তার আমাদের দেশেও আছে এবং ওখানেও আছে। কিন্তু এখানে কমার্শিয়াল মনোভাব বিস্তার লাভ করেছে আর ওখানে খেদমতের মেজাজ এখনও বাকি আছে। হজরত আরও বলেছিলেন, আমার ডাক্তার সর্বদাই আমার খবর নিতেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর যখন প্রথম জুমাবার হলো, তখন আমি মনে করেছিলাম, আজ ডাক্তার আসবেন না। কিন্তু দেখা গেল অন্যান্য দিনের মতো যথাসময়ে ডাক্তার এলেন। এবং পরে নিয়মিত আসতেই থাকলেন। ঈদের দিন মনে হলো, আজ তো কোনোক্রমেই আসবেন না। কিন্তু দেখা গেল, সেদিনও সময়মতো ডাক্তার উপস্থিত!
যখন লেখা শুরু করলাম, তখন মনে হয়েছিল, হজরতের সাথে আমার স্মৃতি কয়টাই বা হবে। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি- একের পর এক টুকরো টুকরো অনেক স্মৃতিই মনে পড়ছে। তাই আজ এখানেই কলম থামিয়ে দিতে চাই।
হজরত রহ. সেই বুজুর্গদের একজন যাদের আল্লাহ দীনের গুরুত্বপূর্ণ সকল ময়দানে খেদমতের তাওফিক দান করেছেন। তালিম ও তারবিয়াত, দাওয়াত ও তাবলিগ, সুলুক ও ইহসান এবং খেদমতে খালক- সকল ময়দানেই তাঁর খেদমত ছিল বিস্তৃত। হজরতের অনেক বড় একটি খেদমত ছিল, তিনি সকল শ্রেণির লোকের কথা শুনতেন। তাদের সমস্যাবলী শুনে তাদেরকে নেক মশোয়ারা দিতেন। কত পেরেশানহাল লোক তার ছায়ায় গিয়ে সুকুন ও ইতমিনান হাসিল করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ইলম ও আকল, ফাহম ও ফিরাসাত এবং ¯েœহ-ভালোবাসার অধিকারী আল্লাহওয়ালাদের সোহবতেই কেবল এই দৌলত হাসিল হতে পারে। মারকাজুল ফিকরিল ইসলামি তাঁর সকল খেদমতের জন্যে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান ছিল। এই প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের আমলি তরবিয়তের ওপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়। এটা আমাদের জন্যে একটি আদর্শ। ইনশাআল্লাহ এই প্রতিষ্ঠান এবং হজরতের অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠান ও দীনি খেদমত সাদাকায়ে জারিয়া হিসেবে কেয়ামত পর্যন্ত বাকি থাকবে। আমরা আশা করব, মারকাজুল ফিকরিল ইসলামির দায়িত্বশীলরা হজরতের জীবনীর ওপর শায়ানে শান কাজ করবেন। হজরতের গুণাবলি এবং খেদমত আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে শুধু কোনো স্মারকগ্রন্থই নয় বরং স্বতন্ত্র গ্রন্থ প্রকাশ করা হবে। আর ‘আল আবরারে’র বিশেষ সংখ্যা তো বের হবেই।
আমার জন্যে অনেক বড় সৌভাগ্য। ইন্তেকালের প্রায় এক মাস আগে প্রফেসর হজরত হামীদুর রহমান সাহেবের সাথে হজরতের ইয়াদাতের সৌভাগ্য হয়। হযরতের সাহেবজাদাগণ এবং মাদরাসার অন্যান্য উস্তাজগণের সাথে সাক্ষাৎ হয়। হজরত তখন আরাম করছিলেন। তাই আমরা শুধু দোয়া পড়ে চলে আসি।
২৭ মুহাররম ১৪৩৭ হিজরি মোতাবেক ১০ নভেম্বর ২০১৫ ঈসায়ি মঙ্গলবার এশার আগে মারকাজুদ দাওয়ার কেন্দ্রীয় দফতর থেকে এক ভাই ফোনে জানালেন, কিছুক্ষণ আগে হজরত আখেরাতের সফরে রওয়ানা হয়ে যান।
إنا لله و إنا إليه راجعون، إن لله ما أخذ و له ما أعطى و كل شيء عنده بمقدار.
বুধবার সকালে হজরতের জানাজায় হাজির হলাম। জানাজায় অনেক লোকের ভিড় ছিল। অনেক লোক যানজটের কারণে গাড়িতেই আটকা পড়ে গেল। জানাজার নামাজ পড়ান হজরতওয়ালার বড় সাহেবযাদা মুফতী আরশাদ রাহমানী সাহেব। দাফন হয় বসুন্ধরার নতুন কবরস্থানে। আল্লাহ তায়ালা হজরতওয়ালাকে মাগফেরাতের চাদরে ঢেকে নিন! তাঁর দারাজাত বুলন্দ করুন! তাঁকে আলা ইল্লিয়্যিনে স্থান দিন! তাঁর প্রতিষ্ঠান ও খেদমতগুলোকে সমৃদ্ধির সাথে স্থায়ী করুন! পরবর্তীদের (যাদের মধ্যে হজরতের আওলাদ ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে সকল মুতাআল্লিকিন মুহিব্বিন অন্তর্ভুক্ত) সবরে জামিলের তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: খতিব, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম ঢাকা।
হাআমা/