|| তাওহীদ আদনান ইয়াকুব ||
ভারতে সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে লক্ষ্য করে এক ভয়াবহ প্রশাসনিক অভিযান শুরু হয়েছে। এরই এক উদ্বেগজনক উদাহরণ হলো মধ্যপ্রদেশের পান্না জেলার একটি ৩০ বছরের পুরনো মাদ্রাসা ভবনকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে ভেঙে ফেলার ঘটনা। এই ঘটনাকে নিছক একটি স্থানীয় সিদ্ধান্ত বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না; বরং এটি সেই বৃহৎ প্রেক্ষাপটেরই অংশ, যার নাম ওয়াকফ আইন সংশোধন—একটি বিতর্কিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পদক্ষেপ যা মুসলিমদের সম্পদের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হয়ে উঠছে।
মধ্যপ্রদেশের পান্না জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসা, যেটি গত ৩০ বছর ধরে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের শিশুদের ধর্মীয় ও প্রাথমিক শিক্ষা দান করে আসছিল, তা আচমকাই ‘অবৈধ নির্মাণ’ বলে ঘোষণা করা হয়। স্থানীয় প্রশাসন দাবি করে, এই ভবনটি ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে থাকলেও সরকারি রেকর্ডে তা বৈধভাবে সংরক্ষিত নয়। ফলাফল—কোনো ধরনের পূর্ণ তদন্ত ছাড়াই, একদিনেই বুলডোজার চালিয়ে মাদ্রাসা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
এই নির্মম পদক্ষেপ কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংসই নয়, বরং এটি মুসলিম সমাজের আত্মপরিচয়, শিক্ষা, ও ধর্মচর্চার ওপর সরাসরি হামলার নামান্তর। ঘটনাটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
ওয়াকফ আইন সংশোধন: মুসলিমদের সম্পদ দখলের নয়া নকশা
ভারত সরকার সম্প্রতি ওয়াকফ আইনে যে সংশোধনী প্রস্তাব করছে, তা মূলত ওয়াকফ বোর্ডের প্রশাসনিক স্বাধীনতা হরণ করে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পরিকল্পনা। সংশোধনীতে যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:
ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি সরকারি প্রয়োজনে অধিগ্রহণের সুযোগ।
বোর্ড ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা রাজ্য সরকারের হাতে দেওয়া।
নতুন ওয়াকফ ঘোষণাকে কঠিনতর করা এবং পূর্বঘোষিত ওয়াকফ সম্পত্তিকেও সন্দেহের চোখে দেখা।
এই আইনি পদক্ষেপগুলোকে অনেকেই মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার হরণ ও তাদের সামাজিক ভিত্তি দুর্বল করার একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেখেছেন।
ওয়াকফ সম্পত্তি: মুসলিম সমাজের আধ্যাত্মিক ও অর্থনৈতিক রক্ষাকবচ
ওয়াকফ কোনো সাধারণ সম্পত্তি নয়। এটি মুসলমানদের আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গকৃত সম্পদ, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, দরিদ্রকল্যাণ কেন্দ্র ও অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক খাতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ভারতজুড়ে আনুমানিক ৬ লক্ষ একর ওয়াকফ সম্পত্তির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১.৫ লাখ কোটি রুপিরও বেশি।
এই সম্পদ কেবল ইতিহাসের অংশ নয়, বরং আজও তা মুসলিম সমাজের শিক্ষা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখার অন্যতম সহায়। অথচ এখন সেই পবিত্র ব্যবস্থাই রাষ্ট্রের দখল নীতির শিকার হচ্ছে।
পান্না থেকে শুরু: কোথায় গিয়ে থামবে এই আগ্রাসন?
পান্নার এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটকসহ বিভিন্ন রাজ্যে একের পর এক মাদ্রাসা ও ওয়াকফ সম্পত্তিকে ‘অবৈধ’ বা ‘নির্বিচার ব্যবহার’ আখ্যা দিয়ে দখল কিংবা গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযান শুরু হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনো ধরনের আইনি নোটিশ, বিকল্প ব্যবস্থা কিংবা আপিলের সুযোগ না দিয়ে বুলডোজার চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ও স্থানীয় মুসলিম জনসাধারণ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।
মধ্যপ্রদেশের পান্নায় গুঁড়িয়ে দেওয়া মাদ্রাসা ভবন কেবল একটি শিক্ষাকেন্দ্রের ধ্বংস নয়—এটি ভারতীয় মুসলিমদের আত্মপরিচয়, বিশ্বাস, এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ওপর চালানো রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের প্রতীক। ওয়াকফ আইন সংশোধনের নামে এই দখল নীতি মুসলিম সমাজকে প্রান্তিক করে দেওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ, এবং এর বিরুদ্ধে সচেতনতা ও প্রতিরোধ এখন সময়ের দাবি। নাহলে একে একে হারিয়ে যাবে শত শত বছরের ঐতিহ্য, এবং চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।
প্রয়োজন এখন আইনগত, নৈতিক ও সামাজিক প্রতিরোধ
ভারতের সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করছে। তাই ওয়াকফ আইন সংশোধন এবং তার প্রয়োগের নামে মাদ্রাসা ধ্বংস—এটি সংবিধানের সরাসরি লঙ্ঘন। তাই এখন প্রয়োজন—
১. আইনি প্রতিরোধ: সংশোধিত আইন ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে মামলা।
২. গণসচেতনতা: মুসলিমদের মধ্যে ওয়াকফের গুরুত্ব ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জনমত গড়ে তোলা।
৩. আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপন: মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে এই আগ্রাসনের চিত্র আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরা।
এমএইচ/