রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :

স্বাধীনতা যুদ্ধে ১১ আলেম ও মাদরাসার বক্তব্য ও অবস্থান!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।হাফেজ ফজলুল হক শাহ।।

আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় অর্জন লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে কেনা স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি। একটি স্বাধীন লাল সুবুজ পতাকার জন্য আমাদের চড়া মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। এ স্বাধীনতা আমাদের জাতীয় সম্পদ, জাতীয় অর্জন।

৭১ -এর মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের গর্ব ও অহঙ্কার। যে কোন দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির জন্য জাতি, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের ঐক্যবদ্ধ ও সমবেত অংশ গ্রহনের প্রয়োজন পড়ে।

সবার স্বত:স্ফূর্ত প্রয়াস এবং সর্ব্বোচ্চ সংগ্রাম-সাধনা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা না থাকলে পরাধীনতার নাকপাশ ছিন্ন করে একটি দেশ স্বাধীনতার শীর্ষ শিখরে আরোহণ করতে পারে না। কিন্তু চরম পরিতাপের বিষয় যে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে সকল পেশাজীবি মানুষের কথা উৎকীর্ণ থাকলেও আলেম ওলামাদের অপার অবদানের প্রসঙ্গটি বৈষম্যমূলকভাবে উপেক্ষিত হয়েছে।

অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেম ওলামাদের অবদান অনস্বীকার্য। স্বাধীনতার টকটকে লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার লক্ষ্যে আলেমদের রক্তের দাম এতো ঠুনকো নয় যে, কেউ তা অস্বীকার করলে তাদের আত্মদানের অবদান ম্লান হয়ে যাবে।

এক শ্রেণীর মানুষের নিকট আলেম ওলামা মানেই ৭১ সালের পরাজিত শক্তি। তারা মনে করেন ওলামায়ে কেরাম বলতেই রাজাকার, আল-বদর। মুক্তিযুদ্ধে ওলামায়ে কেরামের ভূমিকা নিয়ে জাতির মনে সংশয় ও সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়াই তাদের সাধারন অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। বাংলাদেশের সকল ওলামা মাশায়েখদের প্রতি স্বাধীনতা বিরোধীর খেতাব জুড়ে দেয়া গর্হীত অন্যায়।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী হিসেবে তাদের সকলকে চিহিৃত করা আলেমদের প্রতি এক অযাচিত আচরণ। যাচাই বাছাই ছাড়া অনাচারের দায় কারো উপর চাপিয়ে দেয়ার পরিনাম শুভ হয় না। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী আলেম প্রজন্ম, যাদের জন্মই মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাধীন বাংলাদেশে, তাদেরকে রাজাকার বলাটা শুধু অন্যায় নয়, পাপও। কেন দাড়ি-টুপি ও লেবাস-পোশাকের জন্য আলেমদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মনে করা হয়? এগুলো স্বাধীনতা বিরোধী প্রতীক নয়।

১৯৭১ সালে জীবিত আলেমদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিলেন যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। অনুসন্ধানে এমনও আলেমের সন্ধান পাওয়া যায় যারা মুক্তিসেনাদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। এছাড়াও আরো অনেক আলেম রয়েছেন যারা স্বাধীনতার জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করেছেন, স্বাধীনতার পক্ষে ফতওয়া দিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। বাংলাদেশের সর্বত্র বিছিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকা এসব মুক্তিযোদ্ধা আলেমদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য নয়। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের তালিকা হওয়া অপরিহার্য। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েক জন নিম্নরুপ,

মাওলানা ভাসানী
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে অমর একটি নাম মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। মাওলানা ভাসানীর শিক্ষক সিরাজগঞ্জ মাদরাসার প্রধান মাওলানা আব্দুল বাকী তাকে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তিনি শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহ. এর সহচার্য লাভে ধন্য হন এবং শাহ ওয়ালিউল্লাহ মহাদ্দিস দেহলভী রহ. এর রাজনৈতিক চিন্তাধারার সাথে পরিচিত হন। ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় মাওলানা ভাসানী তার ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি না দিলে দেশে ‘ফরাসী বিপ্লব’ করার হুমকি দেন।

মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ
মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ ১৯২৩ সালে দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হয়ে এক বছর সেখানে অধ্যয়নে রত থাকেন। সেখানে থেকে তিনি খুব নিকট থেকে দেওবন্দী আলেমদের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেন এবং তার ভেতর জালেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার স্পৃহা জন্ম নেয়। তিনি ছিলেন বিজ্ঞ সংগঠক ও যোদ্ধা। তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নির্দেশে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে দীর্ঘ সফর করে সেখানে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জল করেন এবং তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ওআইসির সদস্য পদ লাভ করে।

মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী
১৯৪৭ সালে বৃটিশরা পাক-ভারত বিভক্ত করে চলে যাওয়ার পর নেতারা যখন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রাপ্তির সাফল্যে তুষ্ট, তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একজন আলেম পূর্ব-পশ্চিমের বিভক্তিকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি প্রকাশ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে থাকেন এবং এ ভূখন্ডের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তোলেন। তিনি হলেন মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী। ১৯৪৭ সালে ইংরেজ কর্তৃক ভারত বিভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তদানীন্তন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সেক্রেটারী মাওলানা আবুল কাসেম, বেঙ্গল কংগ্রেস পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা কিরণ শংকর রায় স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবী তোলান আগেই মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী তার প্রচারপত্রের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা কায়েমের দাবী পেশ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের সময় মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী মুক্তিকামি জনগণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেন।

মাওলানা অলিউর রহমান
১৯৬৬ সালে মাওলানা ওলিউর রহমানের হাত ধরেই আওয়ামী ওলামা পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যখন ৬ দফা পেশ করেন তখন অনেকেই এই ৬ দফাকে ইসলাম বিরোধী বলে প্রচার করলে মাওলানা অলিউর রহমান ‘ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে ৬ দফা’ শীর্ষক গ্রন্থ রচনা করে ৬ দফা যে ইসলাম বিরোধী ছিল না তা প্রমাণ করেন। ১৯৬৯ সালে সিলেটের আলীয়া মাদরাসায় আওয়ামী ওলামা পার্টির ব্যানারে যে জনসভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে মাওলানা অলিউর রহমান সভাপতিত্ব করেন। এ জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। এতে আরো উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ৪ নেতাসহ জেনারেল উসমানী। মাওলানা অলিউর রহমান ‘স্বতন্ত্র ধর্ম দপ্তর: একটি জাতীয় প্রয়োজন’ শীর্ষক বই লিখে একটি মুসলিম দেশের যে আলাদা একটি ধর্মমন্ত্রনালয় থাকা প্রয়োজন তা তুলে ধরেন। ১৯৭১ সালে মাওলানা অলিউর রহমান নিজেকে আড়াল করে ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে চলে যান। সেখানে তাকে চিনে ফেললে তিনি ঢাকার লালবাগে হাজী শাহাবুদ্দিনের বাসায় আত্মগোপন করেন। ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনি হানাদার বাহিনী কর্তৃক ধৃত হয়ে ১৪ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে তার ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। হানাদার বাহিনী বেওনেট দ্বারা তাকে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করেছিল। ১৯৭২ সালে প্রণীত শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকায় মাওলানা অলিউর রহমানের নাম রয়েছে।

মুফতি আমিমুল ইহসান
১৯৭১ সালে মুফতি আমিমুল ইহসান পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ফতওয়া দিয়েছিলেন। ফলে ইয়াহয়া সরকার তাকে জোর করে সৌদী আরবে পাঠিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি বাংলাদেশে ফিরে এলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাকে বাইতুল মোকাররমের ভতীব নিযুক্ত করেন।

মাওলানা হাফেজ্জী হুজুর
১৯৭১ সালে মাওলানা মুহাম্মাদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এ দেশের মজলুমদের এগিয়ে আসতে জাতির উদ্দেশ্যে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, “এ যুদ্ধ ইসলাম আর কুফরীর যুদ্ধ নয়, এটা জালেম আর মজলুমের যুদ্ধ। পাকিস্তানীরা জালেম।” তার এ ঘোষণা শুনে অনেক আলেম মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন।

মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী
১৯৭১ সালে মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। তিনি বলেন, “আমি তখন হাফেজ্জী হুজুর এবং শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের ছাত্র, লালবাগ মাদরাসায় পড়ি। যুদ্ধ শুরুর পর মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা বড় ছাত্ররা হাফেজ্জী হুজুরকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ যুদ্ধে আমাদের ভূমিকা কি হতে পারে? হুজুর বললেন, অবশ্যই জালেমের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আমি কি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারব? হুজুর বললেন, অবশ্যই অংশ নিতে পারবে। এরপর আমি গেরিলা প্রশিক্ষণে ভর্তি হয়ে গেলাম এবং যুদ্ধে অংশ গ্রহন করলাম।

মাওলানা উবায়দুল্লাহ জালালাবাদী
মাওলানা উবায়দুল্লাহ জালালাবাদী বলেন, তখন ৬ দফাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে টালমাটাল অবস্থা। ৬ দফার সমর্থনে ফুসে উঠেছে চারিদিক। তখন এদেশে কতিপয় ধর্মীয় দল ৬ দফার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগে। তারা প্রচার করে ৬ দফা কর্মসূচি ইসলাম পরিপন্থী। এমনি সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সিলেটে এলেন। তার সাথে দেখা হলো, পরিচয় হলো। তিনি ঢাকায় গেলে তার সাথে দেখা করতে বলেন। ঢকায় এসে তার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের রোডের বাড়িতে আমি দেখা করি। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ৬ দফায় ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু আছে কিনা? আমি বললাম, আপনি ৬ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙ্গালীর ন্যায্য অধিকারের দাবী জানিয়েছেন। এটা ইসলাম পরিপন্থী তো নয়, বরং সহায়ক।

এরপর থেকে শুরু, মাওলানা উবায়দুল্লাহ জালালাবাদী নিজেকে এগিয়ে নিলেন। গড়ে তুললেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আলেমদের জনমত। তিনি নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন মুক্তিযুদ্ধের মহান আন্দোলনে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল আতাউল গনী উসমানীকে যুদ্ধকালীন সঙ্গ দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনে অসামান্য অবদান রেখেছেন মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী।

মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী
মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী বলেন, মাওলানা জাফর আহমদ উসমানী, যিনি ১৯৪৭ সালে ঢাকায় প্রথম স্বাধীন পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলণ করেন, মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী, যিনি ১৯৪৭ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বপ্রথম স্বাধীন পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলণ করেন, তাদেরসহ প্রখ্যাত আলেমদের মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ওয়াদা করেছিলেন, পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র হবে। তিনি আলেমদের সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। ফলে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা এমন রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে পারি না। এ সময়ের মাঝে আমার ছোট ভাই উবায়দুল্লাহ জালালাবাদী আমার শিক্ষক মাওলানা অলিউর রহমানের সাথে আওয়ামী ওলামা পার্টি গঠন করেন। আমি আমার শিক্ষকের সাথে দেখা করে সাহস যুগিয়ে বললাম, আপনি এগিয়ে যান, আমি আপনাকে সাহায্য করব।”

মাওলানা তাজুল ইসলাম
বিবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী কাওমি শিক্ষানিকেতন জামিয়া ইউনিসিয়ার মুহতামিম ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ফতওয়া দিয়েছিলেন। বিবাড়িয়া জেলার অনেক বড় বড় আলেম তার ফতওয়ার প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন।

মাওলানা কাসিমুদ্দিন
পাবনার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে দাওরা হাদীস পাশ করা মাওলানা কাসিমুদ্দিন, যিনি রাজাকার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছেন।

জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া
চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার অন্তর্গত জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া মাদরাসা মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন নিশ্চিত হয় পটিয়া মাদরাসার আলেমরা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছেন, তখনই পটিয়া মাদরাসার উপর জঙ্গি বিমান দিয়ে হামলা শুরু করে। এই বোমা বর্ষণে পটিয়া মাদরাসার মুহতামিম আল্লামা দানেশ ও কারী মাওলানা জেবুল হাসানসহ অনেকেই শহীদ হন। পটিয়া মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ ১৯৭১ সালে স্পষ্ট ফতওয়া দিয়েছিলেন যে, “আমরা মজলুম, আর পাকিস্তানীরা জালেম। জালেমের বিরুদ্ধে লড়াইরত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা ফরয।” মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহর কাছে মুক্তিযোদ্ধারা দোয়া নিতে আসতেন।

যশোর রেল ষ্টেশন মাদরাসা
সে সময় যশোর রেল ষ্টেশন মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন দেওবন্দ ফারেগ মাওলানা আবুল হাসান যশোরী। তিনি পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করায় মুক্তিযোদ্ধারা তার রেল ষ্টেশন মাদরাসায় আশ্রয় নিতেন। মাওলানা আবুল হাসান যশোরীর কিছু ছাত্রও যারা তখন দাওরা হাদীস পড়তেন, তারাও মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিলেন। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী খবর পেয়ে ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল রাতের আধারে পাক আর্মি অতর্কিত মাদরাসায় আক্রমন করে। এতে ২১ জন শহীদ হন। এদের মধ্যে মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা হাবিবুর রহমান, দাওরা হাদীসের ৫ জন ছাত্র এবং বাকিরা রাতের বেলায় আশ্রয় নেয়া মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন মাওলানা আবুল হাসান যশোরী গুলিবিদ্ধ হন। ঐ ২১ জন মুক্তিযোদ্ধার লাশ মাদরাসার প্রাঙ্গনেই কবর দেয়া হয়। আজো যশোর রেল ষ্টেশন মাদরাসায় সেই ২১ জন মুক্তিযোদ্ধার কবর রয়েছে। ১৯৯৩ সালে মাওলানা আবুল হাসান যশোরী ইন্তেকাল করেন। তার কবরও ঐ ২১ জন মুক্তিযোদ্ধার সাথে যশোর শহরের রেল ষ্টেশন মাদরাসার আঙিনায়।

ভারতের আলেমদের ভূমিকা
ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ কেন্দ্রিক আলেমদের সংগঠন ‘জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ’ এর নেতৃবৃন্দ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনেক ফতওয়া, বিবৃতি দিয়েছেন। ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর সিপাহসালার শাইখুল ইসলাম সাইয়েদ হুসাইদ আহমদ মাদানী রহ. এর সুযোগ্য সন্তান ভারতীয় কেন্দ্রিয় পার্লামেন্ট মেম্বার এবং জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের সংগ্রামী সভাপতি মাওলানা সাইয়েদ আসআদ মাদানী, পশ্চিমবঙ্গ জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের সভাপতি মাওলানা মুহাম্মাদ তাহের প্রমূখ বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে বার বার ছুটে গিয়েছেন, নগত অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দেশে বিদেশে জনমত সৃষ্টিতে তারা জোরালো ভূমিকা রেখেছেন।

পাকিস্তানের আলেমদের ভূমিকা
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা তারেক ওয়াহিদ বাট তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সভাপতি আল্লামা মুফতি মাহমুদ সাহেবের বক্তব্য সব সময় বাঙালী মুসলমানদের পক্ষে ছিল। এ কথার সত্যতা পাওয়া যায় সিলেটের জকিগঞ্জ এলাকার মাওলানা আব্দুস সালামের কথায়। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমি করাচি ইউসুফ বিন্নুরী মাদরাসার ছাত্র। একদিন মুফতি মাহমুদ মাদরাসায় এলে একজন তাকে শেখ মুজিব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, গাদ্দারকে তো গ্রেফতার করা হয়েছে, তাকে কি এখনো হত্যা করা হয়নি? এ কথা শুনে মুফতি মাহমুদ অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বলেন, শেখ মুজিব গাদ্দার নন, তিনি একজন সুন্নি মুসলমান। প্রত্যেক মুসলমানের জানমালের হেফাজত করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অপরিহার্য।

মুফতি মাহমুদ ১৯৭১ সালের ১৩ মার্চ তার এক বক্তব্যে স্পষ্ট ভাষায় ইয়াহয়া-ভুট্টুর নীতিকে ভুল আখ্যা দিয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে শেখ মুজিবর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানিয়ে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য আহবান জানানো প্রেসিডেন্টের অবশ্য কর্তব্য।

বিভিন্ন তথ্যঅনুসন্ধানে জানা যায় যে, এ দেশের আলেম সমাজ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে এবং এ দেশের স্বাধীনচেতা মানুষকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করনে অনেক কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে মাওলানা আব্দুল মতিন চৌধুরী সিলেট, মাওলানা হাবিবুল্লাহ সিলেট, মাওলানা লুৎফর রহমান সিলেট, শাইখুল হাদীস মাওলানা কাজি মুতাসিম বিল্লাহ, শাইখুল হাদীস মাওলানা তাজাম্মুল আলী সিলেট, মাওলানা আরিফ রাব্বানী ময়মনসিংহ, মুফতি নূরুল্লাহ বিবাড়িয়া, মাওলানা শামসুদ্দিন কাসেমী ঢাকা, মাওলানা মোস্তফা আজাদ ঢাকা প্রমুখ আলেমের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

লেখক: মুহতামিম, মাদরাসা দারুন নাঈম, পোরশা, নওগাঁ।

কেএল/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ