সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
সৌদির সেবা কোম্পানির সঙ্গে হজ এজেন্সির চুক্তির নির্দেশনা মহেশখালী থানার বিশেষ অভিযানে পরোয়ানাভুক্ত ১১ জন আসামি গ্রেফতার বৃষ্টির সময় কাবা প্রাঙ্গণে নামাজ আদায় ওমরা পালনকারীদের নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট গ্রাহকদের মূলধন ফেরত পাওয়ার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন মাওলানা আতহার আলীকে বাদ দিয়ে জাতীয় ইতিহাস রচিত হতে পারে না: ধর্ম উপদেষ্টা জরুরি সভা ডাকল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কক্সবাজারে উৎসবমুখর পরিবেশে রোপা আমন ধান কাটা শুরু চাঁদপুর হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় জামিয়া ইসলামিয়া দারুস সুন্নাহর সাফল্য বগুড়ায় আন্দোলনে নিহত রিপনের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত

সম্রাট আকবরই বাংলা সালের প্রবর্তক

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: বাংলা সাল বা বঙ্গাব্দ কে প্রতর্বন করছিলেন তা নিয়ে ভারতীয় কয়েকটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিতর্ক তুললেও বাংলাদেশে গবেষক ও ইতিহাসবিদরা একমত যে এর সূচনা হয়েছিল সম্রাট আকবরের হাতেই।

তারা বলছেন যে গৌড়ের প্রাচীন হিন্দু রাজা শশাঙ্ক নন, বরং মুঘল সম্রাট আকবরই বাংলা সাল বা বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করেছিলেন।

অনেক ইতিহাসবিদ ও নৃতাত্ত্বিক অবশ্য এও মনে করেন যে বাঙালিদের মধ্যে কৃষির সূচনা থেকেই বাংলা সালের উদ্ভব। কিন্তু ঠিক কবে বা কখন তা শুরু হয়েছে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায়নি।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে বঙ্গাব্দ’র প্রবর্তক হিসেবে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা গৌড়ের প্রাচীন রাজা শশাঙ্ককে তুলে ধরতে চেষ্টা করছেন, যা নিয়ে ওই দেশেই ভিন্নমত রয়েছে।

ইতিহাসবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন জানাচ্ছেন, সুপরিচিত ভারতীয় বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের ড. অমর্ত্য সেন পর্যন্ত অনেক বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ ও নৃতত্ত্ববিদ সম্রাট আকবরকেই বাংলা সালের প্রবর্তক হিসেবে মেনে নিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক বিবিসি বাংলাকে বলেন, ইতিহাস বিবেচনায় মুঘল সম্রাট আকবরই বাংলা সাল বা বঙ্গাব্দের উদ্ভাবক।

‘১৯৫৪ সালে ভারতীয় পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির প্রধান ড. মেঘনাদ সাহা অঙ্ক কষে নিশ্চিত ঘোষণা করেছিলেন যে সম্রাট আকবরই বাংলা সালের প্রবর্তক। পরে উড়িষ্যার ইতিহাসবিদ কাশীপ্রসাদ জয়সোবাল এ মতকে সমর্থন করেছিলেন।’

‘আমিও মনে করি, ইতিহাসের অভিমত হলো সম্রাট আকবরই ফসলী সাল হিসেবে বাংলা সাল চালু করেছিলেন।’

অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, হিজরী সালকে সৌর বছরে পরিণত করে বাংলা সাল চালু করা হয়েছিল, এবং সম্রাট আকবর যা চেয়েছিলেন তা হলো রাজস্ব প্রশাসনের সংকট দূর করা।

আর তার এই প্রয়াসের মধ্য দিয়েই বাংলা সালের উদ্ভব হলো।

বাংলা সাল নিয়ে চার অভিমত

এই বাংলা সালই বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ও কৃষিখাতে সবসময় নানা উপলক্ষে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অর্থাৎ ফসল থেকে আরম্ভ করে ব্যবসা - সব কাজেই এর গুরুত্ব অপরিসীম।

এখনো অধিকাংশ জায়গায় দোকান ভাড়া কিংবা ব্যবসার হিসেব-নিকেশ করার ভিত্তি হলো ৩০ চৈত্র কিংবা পহেলা বৈশাখ।

বাংলাদেশে বাংলা সালের শেষ দিন ৩০ চৈত্র তারিখে চৈত্র সংক্রান্তি আর বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখে নববর্ষ এই কারণেই ঘটা করে পালিত হয়ে আসছে দীর্ঘকাল ধরে।

অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন জানান, বাংলা সাল কে চালু করেছিলেন তা নিয়ে ইতিহাসে চারটি অভিমত আছে।

একটি হচ্ছে তিব্বতের রাজা স্রং সন (ইনি ৬০০ খ্রিস্টাব্দের কিছু আগে রাজা হন এবং মধ্যভারত ও পূর্ব ভারত জয় করেন) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন, কারণ ওই সময় বাংলার উত্তরাঞ্চলের অনেকটাই তিব্বতি সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত ছিল।

আর বাঙ্গালা শব্দটি তিব্বতি শব্দ বনস থেকে এসেছে, যার অর্থ ভেজা মাটি, যা আসলেই বাংলাদেশ।

দ্বিতীয় অভিমত হলো, শশাঙ্ক - যিনি বাংলা অঞ্চলে একজন স্বাধীন রাজা ছিলেন - বঙ্গাব্দ চালু করেন। তৃতীয় অভিমতে বলা হয়, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বাংলা সনের প্রবর্তক। আর সর্বশেষ অভিমত হলো সম্রাট আকবর ছিলেন বঙ্গাব্দের প্রবর্তক।

পরে ইতিহাস ও গণিতবিদদের বেশিরভাগই তাদের পর্যালোচনা থেকে বলেছেন যে সম্রাট আকবরই বাংলা সালের প্রবর্তক, বলেন অধ্যাপক হোসেন।

প্রায় একই অভিমত দিয়েছেন মরহুম গবেষক শামসুজ্জামান খান। বাংলা একাডেমির এই সাবেক মহাপরিচালক তার বইয়েও বাংলা সালের প্রবর্তন নিয়ে বিস্তারিত তথ্য দেয়ার চেষ্টা করেছেন।

তিনি লিখেছেন, পণ্ডিত ও ঐতিহাসিকরা যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে পরোক্ষ প্রমাণ ও অনুমানের মাধ্যমে বাংলা সালের প্রবর্তক হিসেবে চারজন সম্রাট, রাজা বা সুলতানের নাম সামনে নিয়ে এসেছেন।

তারা হলেন মোগল সম্রাট আকবর, সুলতান হোসেন শাহ, রাজা শশাঙ্ক এবং তিব্বতি রাজা স্রং সন ।

এদের মধ্যে অমর্ত্য সেনসহ অধিকাংশ পণ্ডিত সম্রাট আকবরকেই বাংলা সালের প্রবর্তক মনে করেন বলে লিখেছেন শামসুজ্জামান খান।

সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন হিজরী সাল ছিল ৯৬৩ এবং বাংলা সালও ছিল ৯৬৩ বঙ্গাব্দ।

দেশ শাসনের ২৯তম বছরে হিজরী ৯৯২ সালে তিনি পঞ্জিকা সংস্কারে হাত দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।

শামসুজ্জামান খান লিখেছেন, ‘আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায়, সম্রাট এমন একটি ত্রুটিমুক্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত সৌর সালের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্যই আদর্শ হবে। বাংলা সালের মধ্যে তার সে আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছিল।’

ওই লেখায় তিনি আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়েছেন।

‘আকবর বহুদিন ধরে হিন্দুস্থানের বিভিন্ন অঞ্চলে (দিন গণনার) সমস্যা সহজ করে দেয়ার জন্য এক নতুন বছর ও মাস গণনাক্রম প্রবর্তন করতে ইচ্ছুক ছিলেন। তিনি হিজরী অব্দ ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন। আমীর ফয়জুল্লাহ শিরাজীর প্রচেষ্টায় এ অব্দের প্রবর্তন হলো।’

ঢাকায় বাংলা একাডেমির ফোকলোর বিভাগের উপপরিচালক ড. আমিনুর রহমান সুলতান বলছেন, বাঙালি বরাবরই পার্বণপ্রিয় জাতি। কিন্তু সম্রাট আকবরের আগে অর্থাৎ শশাঙ্ক থেকে আকবর পর্যন্ত সময়ে পার্বণের তেমন উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না।

তবে সম্রাট আকবরের পরে ময়মনসিংহ গীতিকায় কিন্তু পহেলা বৈশাখ বা নতুন বছরের প্রভাব দেখা যায় বলে জানান তিনি।

বাংলা সাল নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের দাবি

ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী আরএসএস ও তাদের অনুসারী সংগঠনগুলো পশ্চিমবঙ্গে জোরালো প্রচার ও ‘সচেতনতা অভিযান’ শুরু করেছে এই বলে যে মুঘল সম্রাট আকবর নন, বরং গৌড়ের প্রাচীন হিন্দু রাজা শশাঙ্কই যে বাংলা সাল বা ‘বঙ্গাব্দ’ প্রবর্তন করেছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের তাত্ত্বিক নেতা ও পরিচিত মুখ জিষ্ণু বসু এমন যুক্তি দেন যে আকবরের জীবদ্দশায় তিনি বাংলার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কখনোই পাননি, ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধ জিতে মুঘলরা প্রথম বাংলা দখল করলেও তারপরও বহু বছর ধরে যুদ্ধ চলেছিল।

‘আর বেছে বেছে সেই অস্থির বাংলাতেই আকবর একটা নতুন সাল চালু করবেন, সেটা খুব অস্বাভাবিক,’ বলেছিলেন ড. বসু।

ঢাকায় বাংলা একাডেমির ড. আমিনুর রহমান সুলতান মনে করেন, বাংলা সালের সূচনা নিয়ে বিতর্কটি তোলা হয়েছে কারণ পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুত্ববাদীরা রাজা শশাঙ্ককেই এর প্রবর্তক হিসেবে দেখাতে চান।

‘এটা আসলে আকবরই শুরু করেছিলেন। অমর্ত্য সেন ও অধ্যাপক পবিত্র সরকারের মতো লেখক ও গবেষকরা দেখিয়েছেন যে সম্রাট আকবরের সময় থেকেই বাংলা সালের প্রবর্তন হয়েছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

বাংলা সাল ও কৃষির হিসেব-নিকেশ

গবেষক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলা অঞ্চল তখন হিজরী সালে পরিচালিত হতো। কিন্তু বাংলা ছিল কৃষিপ্রধান, ফলে খাজনা দেয়াসহ নানা কাজে বছরের শুরুটা হিসেব করতে সমস্যা হতো।

এ কারণেই সম্রাট আকবর তখন বাংলা সাল প্রবর্তন করেছেন, পহেলা বৈশাখ দিয়ে যার শুরু।

বাংলা সাল নিয়ে গবেষণা করা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষক শারমিন রেজওয়ানা জানান, রাজা শশাঙ্ক যেটা করেছিলেন সেটা শতাব্দ। আর সম্রাট আকবর যে সাল চালু করেছিলেন সেটি বঙ্গাব্দ এবং এটি ছিল কৃষকদের কর দেয়ার সাথে সম্পর্কিত।

‘তখন কর দেয়ার সময়ে ফসল উঠতো না। ফলে কৃষকদের কর দিতে সমস্যা হতো। সে কারণেই সম্রাট আকবর পহেলা বৈশাখের প্রথা প্রচলন করেন। আর শশাঙ্কের শতাব্দের সাথে বাংলা সালের সাথে মিলও খুব কম,’ বলছিলেন তিনি।

তবে বাংলা সাল নিয়ে যত বিতর্কই হোক না কেন বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের প্রয়াস ছিল দীর্ঘদিন ধরে।

ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর সূচনা করেছিলেন। পরে সরকার বাংলা একাডেমির মাধ্যমে সেটি বাস্তবায়ন করে।

বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারে বাংলা একাডেমি সাম্প্রতিক সময়ে যে কমিটি করেছিলো তার একজন সদস্য ছিলেন অপরেশ কুমার ব্যানার্জি। তিনি জানান, আগে বাংলায় বছরের শুরু হতো অগ্রহায়ণ দিয়ে, কারণ তখন কৃষকের ঘরে ফসল আসতো।

কিন্তু খাজনা আদায়সহ নানা কিছু চিন্তা করেই বাংলা সাল পহেলা বৈশাখ থেকে নির্ধারণ করা হয়, তিনি বলেন।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাথে জড়িত ঐতিহাসিক দিবসগুলোকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে সমন্বয় করতে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে বাংলা ক্যালেন্ডার পরিবর্তন করা হয়েছে।

অপরেশ কুমার ব্যানার্জি বলেন, ‘বাংলা পঞ্জিকা সমন্বয় করার ফলে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে (গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের বিপরীতে) বাংলা তারিখ আর পরিবর্তিত হবে না।’

তবে এই পরিবর্তন কেবল বাংলাদেশের জন্যই করা হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে বাংলা একটি অন্যতম সরকারি ভাষা, সেখানে এই পরিবর্তন গ্রহণ করা হয়নি।

সূত্র: বিবিসি।

এনটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ