সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


মাহে রামজানের মানসিক প্রস্তুতি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা ওলীউর রহমান

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে আবারো পবিত্র মাহে রামজান আমাদের মাঝে সমাগত। সাওম বা রোজা ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম একটি স্তম্ভ। আজ থেকে চৌদ্দশ বছর পূর্বে হিজরী দ্বিতীয় বর্ষে ১০ শাবান রোজা ফরজ হয়। পবিত্র কুরআনে মহান রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন- হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার। সূরা বাকারা; আয়াত-১৮৩

পবিত্র মাহে রামজান অত্যন্ত ফজিলতের মাস, পবিত্র কুরআন সহ অন্যান্য বড় বড় আসমানী কিতাবসমূহ এ মাসেই নাযিল হয়েছে। এ মাসে অন্য মাসের তুলনায় প্রত্যেকটি আমলের সত্তরগুণ বেশি সওয়াব প্রদান করা হয়। জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শৃঙ্খলিত করা হয় শয়তানকে।

"রামজান" শব্দটি পবিত্র কুরআনে রয়েছে। শব্দটি "রমজ" ধাতু থেকে নির্গত, যার অর্থ হলো- জ্বালিয়ে দেয়া। রামজান যেহেতু গোনাহ সমূহকে জ্বালিয়ে দেয় তাই রমজানকে রমজান হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। রোজাদারের সম্মান এবং মর্যাদা কতটুকু তা একটি হাদীস থেকে অনুমাণ করা যায়। রাসূল (সা.) বলেছেন-

জান্নাতে 'রাইয়ান' নামক একটি দরজা রয়েছে, এ দরজা দিয়ে কেয়ামত দিবসে কেবল রোজাদাররাই প্রবেশ করবে।" সহীহ বুখারী- ১/ হাদীস নং ১৭৮৬

এই গুরুত্বপূর্ণ মাসের কিছু প্রস্তুতি রয়েছে, আর সেই প্রস্তুতি শুধু আসবাব পত্র নয় বরং মানসিকভাবেও প্রস্তুতি গ্রহণ করারও দরকার রয়েছে। এই মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া রামজানের পরিপূর্ণ ছওয়াব পাওয়া যাবেনা। কিভাবে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে? তা আমরা এখন আলোচনা করব।

আমাদের বাড়ির আঙ্গিনায় যেভাবে প্রতিদিন আবর্জনা জমে ঠিক তেমনিভাবে আমাদের অন্তর ও কলবেও ছোট বড় বিভিন্ন গোনাহের আবর্জনা জমতে থাকে। আঙ্গিনার আবর্জনা পরিস্কার না করলে যেভাবে আঙ্গিনা বিস্রি হয়ে পড়ে, কলবের কালিমা দূর না করলেও কলব কালো হয়ে যায়। তাওবা ইস্তিগফারের মাধ্যমে কলবের কালি দূর করার একটি উত্তম সময় হলো মাহে রামজান। বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, এমন কিছু পাপকার্য রয়েছে যেগুলোর কারণে দোয়া-ইস্তিগফারও কবুল হয় না। যেমন হযরত মুআজ ইবনে জাবাল থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেন-
"আল্লাহ তায়ালা অর্ধ সাবানের রাতে (শবে বরাতে) সৃষ্টির দিকে (বিশেষ রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্ধেষ পোষণকারী ছাড়া বাকি সবাইকে ক্ষমা করে দেন।" - ইবনে হাব্বান

অন্য হাদীসে আছে রাসূল (সা.) বলেছেন, অর্ধ শাবানের রাতে মুশরিক, হিংসুক, আত্মীতার সম্পর্ক ছিন্নকারী, টাখনুর নিচে পাজা বা লুঙ্গি পরিধানকারী, মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান, মদ্যপায়ী, ব্যাভিচারী, অন্যায়ভাবে হত্যাকারী, অন্যায়ভাবে কর আদায়কারী, যাদুকর, গণক, গায়ক-গায়িকা, ফিতনাবাজ, ছবি অঙ্কনকারী ও নিন্দুককে আল্লাহ ক্ষমা করেননা।- বাইহাকী-৩/১৪০২, মুসনাদে আহমদ-২/১৭৬

তাই রামজান শরিফের ফজিলত এবং ছওয়াব পেতে হলে এইসব পাপ কাজগুলো আগে পরিহার করতে হবে। আর রামজানের পরিপূর্ণ ছওয়াব লাভের উদ্দেশ্যে এই অভ্যাসগুলো পরিহার করাই হলো মাহে রামজানের মানসিক প্রস্তুতি।

উপরুক্ত পাপ কাজগুলো ইচ্ছা করলে মানুষ যেকোন মুহুর্তেই পরিহার করতে পারে। তবে হিংসা-বিদ্ধেষ একটি মারাত্মক ঘৃণিত অভ্যাস যা মানুষ সহজে পরিহার করতে পারেনা। অনেক বড় বড় নেক আমল করা যায় কিন্তু হিংসা-বিদ্ধেষ মানুষ মন থেকে সহজে দূর করতে পারেনা। আর এই হিংসা এমন একটি ব্যাধি যা মানুষের নেক আমলসমূহ তো বটে দেশ-জাতি ও সমাজের শান্তি শৃঙ্খলাকেও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছার-খার করে দেয়। রাসূল (সা.) এরশাদ করেন " তোমরা অবশ্যই হিংসা থেকে বেঁচে থেকো। কারণ হিংসা নেক আমল সমূহকে এমনভাবে গ্রাস করে ফেলে যেভাবে আগুন লাকড়িকে গ্রাস করে ফেলে।" - সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৯০৫

হিংসা-বিদ্ধেষের বিপরিত হলো মমত্ববোধ, ভালবাসা, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি। এই গুণগুলো মানুষকে মহৎ করে, আল্লাহর কাছে প্রিয় করে। এ প্রসঙ্গে হাদীস থেকে একটি উদাহরণের উদ্ধৃতি দেয়া যায়। যেমন- হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) এক সাহাবী (হযরত সাআদ ইবনে আবি ওক্বাস- যিনি জান্নাতের সু-সংবাদ প্রাপ্ত দশ সাহাবীর একজন) কে পর পর তিন দিন জান্নাতী বলে ঘোষণা দিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) ঐ সাহাবীর ঘরে তিন রাত পর্যন্ত অবস্থান করলেন তাঁর আমল দেখার জন্য যে, তিনি কোন আমলের বিনিময়ে রাসূল (সা.) এর কাছ থেকে জান্নাতের সু-সংবাদ পেলেন। তিন রাত অবস্থান করে দেখলেন ঐ সাহাবী তেমন কোন আমল করেননা।

তিনি হতাশ হলেন যে, জান্নাতের সু-সংবাদের সাথে তো উনার আমলের মিল নেই। তিন দিন পরে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় প্রশ্ন করলেন যে, আপনি মূলত কি আমল করেন? যার দরুন জান্নাতের সু-সংবাদ পেলেন? সাহাবী (সাআদ ইবনে আবি ওক্বাস) বলেন, আমি কোন মুসলমানের প্রতি হিংসা-বিদ্ধেষ পোষণ করিনা।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, এটাই আপনার সেই মহৎ গুণ যার দরুন আপনি এই মর্যাদা (জান্নাতের সু-সংবাদ) পেয়েছেন। (সারসংক্ষেপ) মুসনাদে বাযযার, হাদীস; ১৯১৮, আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া- ৮/৭৪, আততারগীব ওয়াত তারহীব- ৫/২৭৮

সুতরাং হিংসা- বিদ্ধেষ, পরশ্রিকাতরতা মুক্ত জীবন ও আমলই আল্লাহর কাছে পছন্দনীয়। তাই মাহে রামজানকে সামনে রেখে আমরা হিংসা বিদ্ধেষ পরিহার করি, মানুষকে ক্ষমা করে দেই, পিতা-মাতার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেই, মানুষের হক পরিশোধ করে দেই, মদ্যপানকে জীবনের জন্য ভূলে যাই, পরনিন্দা ও মানুষের দোষচর্চা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেই, প্রতিবেশি ও আত্মীয়দের হক আদায় করে তাদের সাথে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সিলেট।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ