মুফতী এনায়েত কবীর।। অর্থনীতি। জাগতিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে জন্ম নিয়েছে অনেক মতবাদ। চমকপ্রদ দর্শন আর থিউরি। শুনানো হয়েছে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম দার্শনিক তত্ত্ব। হয়েছে বিস্তর গবেষণা আর বিশ্লেষণ। তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত আর যুক্তি প্রমাণ। লেখা হয়েছে বড় বড় গ্রন্থ।
তৈরি হয়েছে অর্থনৈতিক গবেষণার বিরাট বিরাট বিভাগ। প্রতিবছরই পেশ করা হয়েছে উচ্চাবিলাসী ও জনকল্যাণমুখী উন্নয়ন বাজেট। দেখানো হয়েছে বিভিন্ন সূচক, জরিপ ও পরিসংখ্যান।
সাথে আছে এমডিজি, এসডিজিসহ টেকসই অর্থনীতির মাধ্যমে বিশ্ব বদলের বিভিন্ন কৌশলপত্র। কিন্তু এত কিছুর পরও কি অর্থশাস্ত্রের মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে? উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সোনার হরিণের দেখা কি পাওয়া গেছে? টেকসই অর্থনীতি নামক সুখ পাখির নাগাল কি পাওয়া গেছে? মানুষের জীবনে কি এসেছে স্বচ্ছলতার সুবাতাস? উত্তর শুধু নেতিবাচকই নয় বরং চরম হতাশাজনক। জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত কয়েকটি শিরোনামই এর উজ্জল প্রমাণ।
পৃথিবীতে এখনও একশ ত্রিশ কোটি মানুষ দারিদ্রের চরম কশাঘাতে মানবেতর জীবন কাটায়। সমকাল ১.৬.১৫ ঈ। বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের মধ্যে প্রতিদিন চার কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। নয়া দিগন্ত ২৯.৭.২০১৩ ঈ.। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৫ ঈ. অনুযায়ী বাংলাদেশের মাথাপিছু ঋণ ২৮০৫৬ টাকা।
কারেন্ট অ্যাফেয়াস। বাংলাদেশের শতকরা ৪৮ জন মানুষ দারিদ্র্রসীমার নিচে বসবাস করে। প্রফেসরস এম সি কিউ রিভিউ : জুন,২০১৫ ঈ.। বিশ্বের অর্ধেক সম্পদ এক শতাংশ লোকের হাতে কুক্ষিগত। প্রথম আলো, ১৬.১০.১৫ঈ.। বাংলাদেশের অর্থনীতি কুয়াশাচ্ছন্ন। যুগান্তর ২১.১০.১৫ঈ.। অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী অ্যাঙ্গাস ডিটনের মতে, এখনকার বিশ্ব অর্থনীতি হল আত্নহত্যার অর্থনীতি। -প্রথম আলো ১৬.১০.১৫ঈ.।
অথচ বহুমুখী উন্নয়ন আর খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের অনেক কথাই শুনা যাচ্ছে প্রতিদিন। প্রশ্ন জাগে, অর্থনৈতিক মুক্তির কোনো উপায় কি তাহলে নেই? টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের নেই কি কোন আলোকিত দিক-দর্শন? পরীক্ষিত সফল কোন আদর্শ বা বলিষ্ঠ নীতিমালা? এসব প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক। হ্যাঁ, ইসলামে আছে এসবের সমাধান। ইসলামেই আছে টেকসই অর্থনীতির সফল স্বপ্নপথ।
ইসলামী অর্থব্যবস্থা: পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
কোন আবেগ বা উচ্ছ্বাসে নয়। কোন বাড়িয়ে বলাও নয়। বাস্তব কথা। স্বপ্নকেও হার মানাবে এমন এক টেকসই অর্থনীতি উপহার দিয়েছে ইসলাম। সে অর্থব্যবস্থার বাস্তবায়ন যখন হয়েছিল তখন গরীব মানুষরা টাকা খুঁজত না বরং টাকাই গরীব খুঁজত।
কিন্তু গরীব পাওয়া যেত না।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন ঘোষণা করলেন, হে লোকসকল, তোমরা দান-খায়রাত করতে থাক। কারণ, এমন দিন আসবে যখন তোমরা দান করার জন্য ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু টাকা নেয়ার জন্য কেউ এগিয়ে আসবে না। তুমি যাকেই দান করতে চাইবে, সে বলবে, আপনি গতকাল এলেই ভালো করতেন। আমি হয়ত তখন তা গ্রহণ করতে পারতাম। কিন্তু আজ আর আমার দরকার নেই। সহীহ বুখারী : হাদীস নং-১৪১১ # সহীহ মুসলিম : হাদীস নং-১০১১।
অবাক বিশ্ব! এমন অর্থব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এই পৃথিবীতে? হ্যাঁ, খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে এমনই একটি স্বপ্নীল সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। প্রসিদ্ধ কিতাব আল বিদায়া ওয়ান নিহায়ায় আছে, তখন অবস্থা এমন হয়েছিলো যে, শহর থেকে শহর ঘুরেও কোন অভাবী মানুষ পাওয়া যেত না। দানের টাকা নিয়ে গরীব খোঁজা হত।
কিন্তু দানের টাকা নেয়ার মত কোন গরীব পাওয়া যেত না। সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ অনাবিল সুখ ও স্বচ্ছলতায় দিন কাটাত। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৫/৬৪।
মানবসমাজ আর কখনো এমন টেকসই অর্থনীতির মুখ দেখেনি। দৃঢ়চিত্তে বলতে পারি, টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে ইসলামী অর্থব্যবস্থার দিকে। আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত অর্থব্যবস্থার দিকে। বিকল্প কোন পথে তা সম্ভব নয়। একথা এখন চরম বিরুদ্ধবাদীরাও স্বীকার করেন।
লেনিনের আক্ষেপ
ভারতের প্রখ্যাত স্বাধীনতাকামী নেতা ছিলেন মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি রহ.। তিনি একবার রাশিয়া সফরে যান। সেখানে যাওয়ার পর লেনিনের সাথে তার সাক্ষাত হয়। সেই সাক্ষাতের বিবরণ দিয়ে মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি রহ. বলেন, রাশিয়ায় অবস্থানকালে লেনিনের সাথে একবার আমার সাক্ষাৎ হয়। কথা প্রসঙ্গে আমি সূরা আলে ইমরানের ২১৯ নং আয়াত - يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنفِقُونَ قُلْ الْعَفْوَ. বিশ্লেষণ করি।
তখন লেনিন খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, আরো আগে যদি কুরআনের এই সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতাম, তাহলে আমাদের কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কোন দরকারই ছিল না। ইসলামে শ্রমিকের অধিকার, আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ রচিত, পৃষ্ঠা -৩০
ইসলামী অর্থদর্শনের বিবরণের আগে অন্যান্য অর্থব্যবস্থা সর্ম্পকে অতিসংক্ষেপে কিছু কথা তুলে ধরা হল।
সমাজবাদী অর্থব্যবস্থা: এখন শুধু স্মৃতি
সমাজবাদী অর্থব্যবস্থা ব্যক্তি মালিকানাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে। এই অর্থব্যবস্থায় কেউই কোন জমি বা কলকারখানার মালিক হতে পারে না।
সবকিছুই থাকে সরকারের মালিকানায়। কোন জমিতে ধান চাষ হবে, আর কোনটায় গম, সবই নির্ধারণ করে দেয় সরকার। উৎপাদিত সম্পদের মালিকানাও সরকারের। বণ্টনও করে সরকার। আর জমি বা কারখানায় যারা কাজ করে তাদেরকে দেয়া হয় পারিশ্রমিক। এছাড়া এই ব্যবস্থায় সব মানুষের একই ধরণের জীবন উপকরণের কথা বলা হয়।
সমাজবাদের কুফল
সমাজবাদী অর্থব্যবস্থায় যেভাবে ব্যক্তি মালিকানার টুটি চেপে ধরা হয়েছে তা সম্পূর্ণ স্বভাববিরোধী। এতে করে সমাজে নেমে আসে স্থবিরতার কালো মেঘ। চারদিকে সৃষ্টি হয় অচলাবস্থা। ব্যক্তি মালিকানা না থাকার ফলে কর্ম উদ্দীপনায় ভাটা দেখা দেয় । কর্মচাঞ্চল্যে এসে যায় অলসতা ও চরম অনীহা। প্রত্যেকে ভাবতে শুরু করে, আমার মানসিক ও শারীরিক শক্তি ব্যয় করে যা পাব, কাজ না করলেও তো তাই পাব। তা থেকে আমি বঞ্চিত হব না। সুতরাং অধিক কাজ বা পরিশ্রম করে কি লাভ?
সমাজবাদী অর্থব্যবস্থায় জীবনোপকরণের সমতার যে দাবী করা হয়, তাও অযৌক্তিক। কারণ, একেক জনের শারীরিক, মেধাগত যোগ্যতা একেক রকম। তাই জীবনোপকরণের পার্থক্য হওয়াটাও স্বাভাবিক।
পুঁজিবাদ: দুষ্ট লোকের সৃষ্ট মত পুঁজিবাদের মূল বক্তব্য হল অবাধ ব্যক্তি মালিকানা। এই অর্থ ব্যবস্থায় ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও লাগামহীন ছেড়ে দেয়া হয়। মালিকদের খেয়াল খুশিই এখানে সবকিছু। যার ফলে সে মুনাফার স্বার্থে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। মানবিকতার কোনই স্থান নেই এই অর্থব্যবস্থায়।
পুঁজিবাদের কুফল
পুঁজিবাদ মানুষকে নির্দয় ও নিষ্ঠুর করে তোলে। হাজারো পণ্যের সম্ভার সে ধ্বংস করে দিতে পারে অনায়াসে। লাখো ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকারেও কাঁপে না তার অন্তর। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হলেই বরং কাঁপে তাদের অন্তর। কারণ মুনাফার অংশ কমে যায় যদি। তাই তারা লাখো মানুষকে ভুখা রেখে উৎপাদিত পণ্য জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিতেও দ্বিধাবোধ করে না।
ব্রাজিলে একবার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হল। তা দেখে পুঁজিপতিরা আতংকিত হয়ে ওঠে। তারা পরামর্শে বসে, এই বাম্পার ফলন রোধে কি করা যায়? তখন মাটিতে পুঁেত ফেলা বা সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়ার মতামত আসে।
কিন্তুু মাটিতে পুঁততে গেলে অনেক জায়গা লাগবে। সমুদ্রে ডুবালে মৎস সম্পদের ক্ষতি হবে বলে তা আর করা হয়নি। পরে সেগুলো পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়। এতে প্রায় দু’লাখ পাউন্ড তেল ব্যয় হয়েছিল। ইসলামে শ্রমিকের অধিকার. পৃষ্ঠা, ২১. আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ রচিত।
পুঁজিবাদীরা কম মজুরীতে শ্রমিক পাওয়ার আশায় পরিকল্পিতভাবে বেকারত্ব সৃষ্টি করে। মানুষকে দরিদ্্র, অসহায় ও সর্বহারা করে রাখার এক জঘন্য ইচ্ছায় মেতে ওঠে। পুঁজিবাদের ‘মা বাপ’ পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব ম্যাডেভিলের ভাষায়, গরীবদের থেকে কাজ নেয়ার একটি মাত্র পথ, আর তা হল এদেরকে দরিদ্র থাকতে দাও, এদেরকে পরনির্ভরশীল করে তোল।
ইসলামে শ্রমিকের অধিকার. পৃষ্ঠা ২৩. আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ রচিত এছাড়া পুঁজিবাদে টাকা উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল হারাম বা চারিত্রিক কোন বিধি নিষেধ নেই।
সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, জুয়া, ছিনতাই, কালোবাজারি, মজুতদারী, খাদ্যে ভেজাল মেশানো, ওজনে কম দেয়াসহ যে কোন ঘৃণ্য কায়দায় টাকা কামানো এই অর্থব্যবস্থায় দোষের কিছু নয়। এমন উগ্র স্বাধীনতার ফলে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে যায় পাপ পংকিলতার আধাঁর গলিতে। সৃষ্টি হয় এক পাশবিক সমাজ ব্যবস্থা
-এটি