আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: একজন জানতে চেয়েছেন, আমাদের দেশে একটি গজল খুবই প্রসিদ্ধ সেটি হল, একদিন নবী মোস্তাফায়, রাস্তা দিয়া হাইটা যায়, হরিণ একটি বান্ধা ছিল গাছেরই তলায়।
আমাদের অনেক বক্তা ও খতীবরা খুবই হৃদয়স্পর্শী ভাষায় হরিণ সম্পর্কিত ঘটনাটি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত আলোচনা করতে গিয়ে করে থাকে।
ঘটনার বিবরণ এমন যে, একদিন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইরে বের হলে এক স্থানে একটি হরিণকে বন্দী দেখেতে পান। তখন হরিণটি নবীজীর কাছে আর্জি জানায় যে, তার দু’টি দুগ্ধপোষ্য বাচ্চা আছে। দুধ পান না করতে পারলে তারা মারা যাবে। তাই তাকে ছেড়ে দিতে আবেদন করে। দুধ পান করিয়ে আবার ফিরে আসার ওয়াদা করে।
নবীজী হরিণকে ছেড়ে দেন এবং নিজে উক্ত গাছ তলায় হরিণের যিম্মাদার হয়ে বসে থাকেন। তারপর হরিণ শিকারী এসে হরিণ ছেড়ে দেয়ায় নবীজীর সাথে দুর্ব্যবহার করে। অবশেষে হরিণটি তার বাচ্চাদের দুধ পান করিয়ে ফেরত আসে। তখন লোকটি মুসলমান হয়ে যায়। হরিণটিকেও লোকটি ছেড়ে দেয়।
কাছাকাছি এমন আগপর কমবেশি করে ঘটনাটি বলা হয়ে থাকে। দয়া করে এ ঘটনার সত্যাসত্যি জানালে কৃতজ্ঞ হবো।
উত্তর-
আবু নুয়াইম আলইসফাহানী তার দালায়েলুন নবুয়্যাহ এবং ইমাম বায়হাকী রহ: তার দালায়েলুন নবুয়্যাহ গ্রন্থে এবং ইমাম যুরকানী রহঃ তার মাওয়াহিবুল লাদিনিয়্যাতে উক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বায়হাকী তার সুনানুল কুবরা লিলবায়হাকীতে এবং আল্লামা মুনজিরী রহঃ তার তারগীব ওয়াত তারহীবের মাঝেও ঘটনাটি উদ্ধৃত করেছেন।
এছাড়া আরো অনেক গ্রন্থেই এ ঘটনা বিভিন্ন শব্দে বর্ণিত হয়েছে।
বিভিন্ন বর্ণনায় খানিক পরিবর্তিত বিবরণ পাওয়া যায়।
উক্ত ঘটনা সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনে কেরামের মন্তব্য হল:
১
মোল্লা আলী রহঃ বলেন,
حَدِيثُ تَسْلِيمُ الْغَزالَةِ اشْتُهِرَ عَلَى الأَلْسِنَةِ وَفِي الْمَدَائِحِ النَّبَوِيَّةِ قَالَ ابْنُ كَثِيرٍ وَلَيْسَ لَهُ أَصْلٌ وَمَنْ نَسَبَهُ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَدْ كَذَبَ
হরিণীর আনুগত্য সম্পর্কিত ঘটনাটি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসায় লোকমুখে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ইবনে কাসীর রহঃ বলেছেন: “এ ঘটনার কোনো ভিত্তি নেই। যে এটিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দিকে সম্বন্ধ করল সে মিথ্যা বলল।” [আল মাসনু’ ফী মারিফাতিল হাদিসিল মাউযু, পৃষ্ঠা নং ৮০]
২
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ বলেন:
وأما تسليم الغزالة فلم نجد له إسناداً لا من وجه قوي ولا من وجه ضعيف والله أعلم
আর হরিণী কর্তৃক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আনুগত্য প্রকাশের ঘটনার ব্যাপারে আমরা শক্তিশালী কিংবা দুর্বল কোনো সনদ (বর্ণনা সূত্র) পাইনি। আল্লাহ ভালো জানেন। [ফাতহুল বারী ৬/৮৭০]।
৩
ইমাম যাহাবী রহঃ ও উক্ত ঘটনাটি বাতিল হবার ইংগিত করেছেন। [মীযানুল ই’তিদাল-৬/১০৬, রাবী নং-৯৮৪১, ৯৪৩৪]
৪
ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ উক্ত হাদীসটির ক্ষেত্রে মন্তব্য করেছেন:
هذا موضوع
এটি বানোয়াট। [লিসানুল মীযান-৭/৩৮০, রাবী নং-৯৪৭১]
৫
ইমাম সাখাবী রহঃ বলেন:
حَدِيث: تَسْلِيمُ الْغَزَالَةِ، اشتهر على الألسنة، وفي المدائح النبوية، وليس له كما قاله ابن كثير أصل، ومن نسبه إلى النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فقد كذب
হরিণীর আনুগত্যের হাদীসটি নবীজীর প্রশংসায় লোকমুখে প্রসিদ্ধ। অথচ এটি যেমনটি ইবনে কাসীর রহঃ বলেছেন এর কোন ভিত্তি নেই। সুতরাং যে ব্যক্তি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে এ বর্ণনার নিসবত করবে, সে মিথ্যা বলল। [আল মাকাসিদুল হাসানাহ-১৮৪, বর্ণনা নং-৩৩১]
৬
আল্লামা আজলুনী রহঃ ও ইমাম সাখাবী রহঃ এর বক্তব্যটি হুবুহু সমর্থন করেন। [কাশফুল খাফা-১/৩৫২, বর্ণনা নং-৯৮৯]
৭
শায়েখ আব্দুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ রহঃ বলেন:
هي أحاديث ضعيفة واهية لا يصح الاعتماد عليها في إثبات ما هو خرق للعادة وإن كانت لتعدد طرقها لا يحكم الحديثي عليها بالوضع فإن إثبات مضمونها لا يقبل ولا يثبت إلا بالحديث الصحيح الرجيح ولدى النظر في أسانيدها يتبين أنها لا تخلو من مطاعن شديدة مردية فلا تغفل. وبالنظر في متونها يتبدّى تعارض شديد فيما بينها وفي الجمع بينها تعسف ظاهر
এ হাদীসগুলো জঈফ এবং আজগুবী। অস্বাভাবিক বিষয় প্রমাণে এর উপর নির্ভর করা যাবে না। যদিও তা অনেক সূত্রে বর্ণিত। তবু এটি হাদীস হওয়া প্রমাণিত হয় না। বিশুদ্ধ সনদের হাদীস ব্যতীত এমন বিষয় গ্রহণীয় এবং প্রমাণিত হয় না। আর এ সংক্রান্ত বর্ণনার সনদ পর্যালোচনা করে এটাই প্রকাশিত হয়েছে যে, এর কোনটিই মারাত্মক অভিযোগ থেকে খালি নয়। তাই অসতর্ক হওয়া যাবে না। আর এ বর্ণনাগুলোর মতনের পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, এর মাঝে প্রচুর পরস্পর বিরোধী বক্তব্য রয়েছে। মোটকথা এর মাঝে স্পষ্টই স্বেচ্ছাচারিতা বিদ্যমান। [মাসনূ ফী মাহরিফাতিল হাদীসিল মাওজূ-৮০]
মুহাদ্দিসীনে কেরামের উপরোক্ত বক্তব্য জানার পর আশা করি আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। হরিণীর দুগ্ধপান ও ফিরে আসা সম্পর্কিত ঘটনাটি বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। তাই এটিকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে নিসবত করে বর্ণনা করা জায়েজ নয়। সূত্র: আহলে হক মিডিয়া।
-কেএল