সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ইতিহাসের আয়নায় ‘শাবান’ মাস

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।মুফতি গোলাম রাজ্জাক কাসেমী।।

হিজরি বর্ষপঞ্জির অষ্টম মাস ‘শাবান’। ইসলামণ্ডপূর্ব যুগ থেকে অন্য মাসগুলোর মতো এ নাম ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শাবান শব্দের একটি অর্থ হলো বিভক্ত হওয়া। যেহেতু রজব মাসে নিষিদ্ধতার কারণে যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে বিরত থাকার পর শাবানে আরব গোত্রগুলো যুদ্ধবিগ্রহের জন্য দলে দলে বিভক্ত হতো, তাই এই মাসকে ‘শাবান’ নামকরণ করা হয়।

শাবান ইসলামের একটি মর্যাদাপূর্ণ মাস। এই মাসে আমলনামাগুলো মহান আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। নবীজি (সা.) শাবানের বেশির ভাগ সময় রোজা রাখতেন। মা আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) কখনো কখনো ধারাবাহিকভাবে রোজা রাখতেন। আমরা বলতাম, তিনি মনে হয় আর কখনো রোজা ছাড়বেন না। আবার কখনো এভাবে রোজা রাখা ছেড়ে দিতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি মনে হয় আর কখনো (নফল) রোজা রাখবেন না। রমজান ছাড়া অন্য কোনো মাসে আমি রাসুল (সা.)-কে পুরো মাস রোজা রাখতে দেখিনি। আর শাবান মাসের মতো অন্য কোনো মাসে এত অধিক (নফল) রোজা রাখতে আমি রাসুল (সা.)-কে দেখিনি।’ (বোখারি : ১৯৬৯)।

শাবানে নবীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা : রাসুল (সা.) মদিনায় আগমনের ১৬ কিংবা ১৭ মাসের মাথায় শাবান মাসে বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে কাবা শরিফের দিকে কিবলা পরিবর্তন করা হয়। দ্বিতীয় হিজরির শাবানেই রোজা ফরজ হয়। এ মাসেই মহান

সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। মদিনায় হিজরতের পর মুহাজিরদের মধ্যে তিনিই ইসলামের প্রথম নবজাতক।

২ শাবান ২ হিজরিতে তার জন্ম। জ্ঞান-প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ একটি সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত ঘরে তিনি বেড়ে ওঠেন। তার বাবা বিখ্যাত সাহাবি জুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রা.)। মা আসমা বিনতে আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। খালা উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.)। তিনি নির্ভীক ও দুঃসাহসী ছিলেন। ৬৪ হিজরিতে মুয়াবিয়া ইবনে এজিদের ইন্তেকালের পর খেলাফতের প্রার্থী হন।

৩ শাবান ৪ হিজরি মোতাবেক ৯ জানুয়ারি ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দে মদিনা মুনাওয়ারায় ইমাম হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। হাসান ও হুসাইন (রা.) ছিলেন নবীজির কলিজার টুকরা। মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ানের ইন্তেকালের পর ইমাম হুসাইন (রা.) খেলাফতের প্রার্থী হন। এদিকে মুয়াবিয়া (রা.)-এর ছেলে এজিদ খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ইমাম হুসাইন (রা.) তাকে খলিফাতুল মুসলিমিন হিসেবে মেনে নিতে সম্মত হননি। পরিণামে কারবালার ঐতিহাসিক ঘটনায় তিনি শাহাদত বরণ করেন।

পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ হিজরির শাবান মাসে বনু মুসতালিকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদিও এ যুদ্ধটি এতটা বিস্তৃত ও দীর্ঘতর ছিল না; কিন্তু এতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যার ফলে ইসলামি সমাজে অশান্তি ও অস্থিরতা বিরাজ করতে থাকে এবং মুনাফেকদের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। পাশাপাশি কিছু বিচক্ষণ আইনও প্রণয়ন করা হয়, যার ফলে ইসলামি সমাজ সম্মান, মর্যাদা ও পরিশুদ্ধতার এক বিশেষ রূপ লাভ করে। প্রথমে যুদ্ধ-সম্পর্কিত আলোচনা করা যাক, তারপর ঘটনাগুলো নিয়ে। যুদ্ধ বিশারদের মতে পঞ্চম হিজরির শাবান মাসে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ইবনে ইসহাকের মতে ষষ্ঠ হিজরিতে।

যুদ্ধের প্রেক্ষাপট : বনু মুসতালিকের প্রধান হারিছ ইবনে আবি জিরারের নেতৃত্বে বনু মুসতালিক ও তার অন্যান্য আরব মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার সংবাদ পেয়ে রাসুল (সা.) ঘটনার তদন্তের জন্য বুরাইদা বিন হাসিব আল-আসলামিকে পাঠান। বুরাইদা (রা.) হারিছ ইবনে আবি জিরারের সঙ্গে কৌশলে সাক্ষাৎ করে কথাবার্তা বলে ঘটনার ওয়াকিবহাল হয়ে ফিরে এসে নবীজিকে জানান। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পর রাসুল (সা.) সাহাবিদের প্রস্তুত করে ২ শাবান দ্রুত বেরিয়ে পড়েন। তার সঙ্গে মুনাফেকদের একটি দলও বের হয়, যারা এর আগে কোনো যুদ্ধে অংশ নেয়নি। এ সময় মদিনার শাসনভার জায়েদ ইবনে হারেস (রা.)-কে কারো মতে আবু জর (রা.) কে কেউ বলেন, নুমাইলা ইবনে আবদুল্লাহ আল্লাইসিকে অর্পণ করেন। মুসলিম সেনাবাহিনীর সংবাদ সংগ্রহের জন্য হারিছ ইবনে আবি জিরার একজন গুপ্তচর নিয়োগ করেছিল। মুসলমানরা তাকে পাকড়াও করে হত্যা করে।

হারিছ ইবনে আবি জিরার তার দলবলসহ যখন রাসুল (সা.) এর পথে পৌঁছে, তখন তাকে হত্যা করা হয়। ফলে তারা প্রচ- ভয় পায় এবং তাদের সঙ্গে থাকা আরব মিত্ররা কেটে পড়ে। রাসুল (সা.) মুরাইসি কূপের কাছে পৌঁছালে বনু মুসতালিকের লোকজন যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। নবীজি (সা.) তখন সাহাবিদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করান। মুহাজিরদের পতাকা ছিল আবু বকর (রা.) এর সঙ্গে আর আনছারদের পতাকা ছিল সাদ ইবনে উবাদাহ (রা.) এর সঙ্গে।

সাহাবায়ে কেরাম কিছুক্ষণ তির নিক্ষেপ করার পর নবীজির নির্দেশে একযোগে হামলা চালালে মুসলমানরা বিজয়ী হয় এবং মুশরিকরা পরাজয় বরণ করে। তাদের কেউ কেউ নিহত হয়। স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি বন্দি করা হয় এবং গবাদিপশু ও বকরিগুলো মুসলমানদের হস্তগত হয়।

যুদ্ধ বিশারদদের মতে, মুসলমানদের থেকে শুধু একজন নিহত হয়, তাও হয়েছে আনসারি কর্তৃক শত্রু ধারণা করে ভুলবশত। তবে ইবনুল কাইয়ুম (রহ.) এটিকে ভ্রম উল্লেখ করে বলেন, তাদের মধ্যে কোনো যুদ্ধই হয়নি। রাসুল (সা.) তো যে সময় লোকজন তাদের পশুদের পানি পান করাচ্ছিল তখন তাদের ওপর অতর্কিত হামলা করে সন্তান-সন্ততি ও ধনসম্পদ হস্তগত করেন। যেমন সহিহ হাদিসে এসেছে, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বনু মুসতালিকের ওপর অতর্কিত হামলা করেন, যখন তাদের পশুদের পানি পান করানো হচ্ছিল। তিনি তাদের যোদ্ধাদের হত্যা করেন এবং বাকিদের বন্দি করেন...।’ (মুসলিম : ১৭৩০)।

এ যুদ্ধে বনু মুসতালিক গোত্রের সর্দারের মেয়ে জুওয়াইরিয়া বিনতে হারেস বন্দি হয়ে সাবেত ইবনে কায়সের ভাগে পড়ে। রাসুল (সা.) তার সঙ্গে চুক্তি করে তার মুক্তিপণ আদায় করে তাকে বিবাহ করে নেন। মুসলমানরা এ বিবাহের কারণে বনু মুসতালিকের ১০০ জন বন্দিকে এ বলে আজাদ করেন যে, এরা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর শ্বশুর বংশের লোক। এই যুদ্ধের আলোচিত ঘটনাগুলো ঘটেছিল মূলত মুনাফেক-সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ইন্ধনে।

বনু মুসতালিক যুদ্ধে মুনাফেকদের ভূমিকা : বনু মুসতালিক যুদ্ধে বের হওয়া মুনাফেকদের অবস্থা ছিল তেমন যেমনটা আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরাআনে এরশাদ করেছেন, ‘যদি তোমাদের সঙ্গে তারা বের হতো, তবে তোমাদের অনিষ্ট ছাড়া আর কিছু বৃদ্ধি করত না, আর অশ্ব ছুটাত তোমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশে।’ (সুরা তওবা : ৪৭)।

মূলত অনিষ্ট-অনুসন্ধানী মুনাফেকরা অনিষ্টার ফন্দি করে বেড়ায়। তারপর মুসলমানদের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা ও নবীজির বিরুদ্ধে জঘন্য প্রচারণা ছড়িয়ে দেয়। কোরআনে সে সম্পর্কে ঈষৎ বর্ণনা রয়েছে,

‘আমরা যদি মদিনায় প্রত্যাবর্তন করি, তবে সেখান থেকে সম্মানীয়রা অবশ্যই হীনদের বহিষ্কার করবে।’ (সুরা মুনাফিকুন : ৮)।

শাবান মাসেই ঐতিহাসিক ইফকের ঘটনা ঘটে। আল্লাহতায়ালা সুরা নুরে সে ঘটনা উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘যারা মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে, তারা তোমাদেরই একটি দল। তোমরা একে নিজেদের জন্য খারাপ মনে করো না; বরং এটা তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। তাদের প্রত্যেকের জন্য ততটুকু আছে যতটুকু সে গুনাহ করেছে এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে, তার জন্য রয়েছে বিরাট শাস্তি।’ (সুরা নুর : ১১)।

(লেখাটি জর্ডানের জাতীয় পত্রিকা আল-ওয়াতানে প্রকাশিত মুহাম্মদ জাহের আবিদের প্রবন্ধের অনুবাদ)

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ