আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: গত নভেম্বরে এক ঠাণ্ডা রাত। ভারত শাসিত কাশ্মীরে নিহত হয়েছেন এমন দু’জন পুরুষের মৃতদেহ পৌঁছার জন্য অপেক্ষায় পরিবারের শোকাতুর সদস্যরা। মৃতদেহ ফিরে গেলে তারা দ্বিতীয়বার দাফন করবেন। নিহত আলতাফ ভাট ও মুদাসির গুলের মৃতদেহ নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা একবার দাফন করেছিলেন।
তারা বলেছিলেন, শ্রীনগর শহরে মিলিট্যান্টদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের সময় নিহত হয়েছেন এ দু’জন। তারা আরো দাবি করেছেন ওই মিলিট্যান্টদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল মুদাসির গুলের।
এ সময় আলতাফ ভাট ক্রসফায়ারে পড়েন। কিন' তাদের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, এ দু’জনকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এ খবর দিয়ে অনলাইন বিবিসি বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
এতে বলা হয়েছে, প্রতিবাদ হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ নিহতদের মৃতদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে তা আবার পরিবারের কাছে ফেরত দিতে রাজি হয়। এ উদ্যোগটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ওই অঞ্চলের জন্য এক বিরল ব্যাপার। কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা অভিযোগ তদন্ত করে দেখবে। এতে নিহতদের আত্ময়স্বজনদের মধ্যে সামান্য স্বস্তি ফিরেছে।
নিহত আলতাফ ভাটের বড়ভাই আবদুল মাজিদ ভাট প্রশ্ন করেন, গত ৩০ বছরে কেউই বিচার পায়নি। আমরা কিভাবে বিচার পাওয়ার আশা করতে পারি? দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অভিযোগ আনা হয়েছে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে।
কাশ্মীর একটি বিতর্কিত অঞ্চল। এর পুরোটাই নিজেদের বলে দাবি করে ভারত ও পাকিস্তান। তবে উভয় দেশই এর অংশবিশেষ নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত অংশে তিন দশকেরও বেশি সময় দেখা দিয়েছে সশস্ত্র বিদ্রোহ। এতে প্রাণ হারিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। এ সময়ে বেসামরিক লোকজনকে মিলিট্যান্ট হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ভারতীয় নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। এর মধ্য দিয়ে তারা সেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। অধিকারকর্মীরা বলেন, জম্মু ও কাশ্মীরকে ২০১৯ সালের আগস্টে ভারত দুটি কেন্দ্র শাসিত টেরিটোরিতে ভাগ করে। বাতিল করা হয় এর স্বায়ত্তশাসন। এর পর থেকেই সেখানকার পরিসি'তি আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
সম্প্রতি এক বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ২০১৯ সাল থেকে চলাচলে বিধিনিষেধ কার্যকর করতে গিয়ে অসংখ্য নিয়ম লঙ্ঘন ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েছে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। এর মধ্যে রয়েছে চেকপয়েন্টে নিয়মিত হয়রানি, অশোভন আচরণ, খেয়ালখুশি মতো আটক, নির্যাতন এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।
তবে এই অভিযোগ সব সময়ই প্রত্যাখ্যান করে আসছে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের সাবেক মহাপরিচালক কুলদ্বীপ খোড়া বলেছেন, সামান্য তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এনকাউন্টারে হত্যার মিথ্যা দাবি করে পরিবারগুলো। এতে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের কাজকে বৈধতা দেয়। কিন' অধিকারকর্মীরা বলেন, মৌলিক তথ্য নিয়ে লড়াই করছেন পরিবারগুলো।
২০১৭ সালে কাশ্মীরে হিউম্যান রাইটস কমিশনের কাছে একটি আবেদন জমা দেন অধিকারকর্মী মুহাম্মদ আহসান অন'। ১৯৮৯ সাল থেকে যেসব বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার বিস্তারিত তদন্তের আহ্বান জানান তিনি। ওই সময় থেকেই মূলত কাশ্মীরে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে সহিংস বিদ্রোহ দেখা দেয়। আবেদন করার এক বছর পরে জবাব পান মুহাম্মদ আহসান। এতে বলা হয়, ১৯৮৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৫০৬টি তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একটির তদন্ত শেষ হয়েছে।
২০২০ সালের জুলাইয়ে ভারতের সেনাবাহিনী ঘোষণা করে, তারা কাশ্মীরের দক্ষিণে সোপিয়ান জেলায় বন্দুকযুদ্ধে কট্টরপনি' তিন জঙ্গিকে হত্যা করেছে।
ওই বছরেই তাদেরকে দূরে কোনো এক স্থানে নিয়ে গোপনে দাফন করা হয়েছে। অর্থাৎ নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা মৃতদের লাশ করোনা মহামারিতে বিধিনিষেধের কথা উল্লেখ করে পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা বন্ধ করে দেয়। কিন' বিশেষজ্ঞরা বলেন অন্য কথা। তারা বলেছেন, নিহতদের দাফন অনুষ্ঠানে বিপুল পরিমাণ মানুষের উপসি'তি হতে পারে এবং তাতে পরিসি'তির মারাত্মক অবনতি ঘটতে পারে, এই আশঙ্কায় এমন পদক্ষেপ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এ ঘটনায় নিহত তিন ব্যক্তির ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তা তাদের পরিবার পর্যন্ত পেয়ে যায়। তারা দাবি করেন, নিহত এসব ব্যক্তি শ্রমিক। তারা নিখোঁজ ছিলেন।
এ নিয়ে ক্ষোভের মুখে সেনাবাহিনী প্রাথমিকভাবে তদন্ত করে। তাতে এই হত্যায় জড়িত ব্যক্তিরা সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইনের অতিরিক্ত প্রয়োগ করেছে। এটি এমন একটি আইন, যা সেনা সদস্যদেরকে কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই কাউকে গ্রেপ্তার করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কখনো কখনো গুলি করে হত্যার অনুমতিও দেয়া হয়েছে।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে একজন সেনা কর্মকর্তা এবং দু’জন বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপহরণ এবং হত্যার অভিযোগ দাখিল করে পুলিশ। বেসামরিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনী প্রক্রিয়া চলতে থাকে স্থানীয় আদালতে। কিন্তু সেনা কর্মকর্তা, যিনি মূল অভিযুক্ত, তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা স্পষ্ট নয়।
তার বিচার চলছিল সামরিক আদালতে, যেখানে বেসামরিক এবং সাংবাদিকদের প্রবেশের অনুমতি নেই। এই মামলার বিষয়ে সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ফলে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতিই শুধু একমাত্র চ্যালেঞ্জই নয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে একজন টিনেজারকে হত্যা করে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন তার আত্মীয়রা। জবাবে তাদের বিরুদ্ধে ‘আন ল’ফুল এক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্টে’র অধীনে মামলা হয়। এই মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে তার জামিন প্রায় অসম্ভব।
৪২ বছর বয়সী মুস্তাক আহমাদ ওয়ানি বলেছেন, তার ছেলে একজন স্কুলপড়ুয়া। তার মিলিট্যান্টদের সঙ্গে কোন যোগসূত্র নেই। মুস্তাক আহমাদ ওয়ানি তার বাড়ির কাছেই একটি কবর খুঁড়ে অপেক্ষায় আছেন। তিনি সন্তানের মৃতদেহ ফেরত চেয়েছেন, যাতে তাকে দাফন করতে পারেন।
শ্রীনগরের ক্ষেত্রে পুলিশ সম্প্রতি তথ্য পায় যে, একটি ভবনে অবস্থান করতে যাচ্ছে একজন মিলিট্যান্ট। আলতাফ ভাট ওই ভবনের মালিক এবং এখান থেকে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনা করছিলেন মুদাসির গুল।
জম্মু-কাশ্মীরের একজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, তারা ওই স্থাপনা তল্লাশি করে সেখানে কোনো মিলিট্যান্টকে খুঁজে পাননি। তিনি বলেছেন, আলতাফ ভাট, মুদাসির গুল এবং আমির ম্যাগ্রে নামে তিন ব্যক্তিকে ভবনটির উপরের তলায় রুমের তালাবদ্ধ দরজা খুলতে বাধ্য করা হয়। সন্দেহ ছিল যে, সেখানে মিলিট্যান্টরা আত্মগোপন করে থাকতে পারেন। এরপর ওই তিনজনের পিছু নেয় সশস্ত্র পুলিশ সদস্যরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এর ১৫ মিনিটের মধ্যে আমরা দুটি গুলির শব্দ পাই। আমাদের সদস্যরা প্রতিশোধ নিয়েছেন। এরপর রিভলবার হাতে নিয়ে একজন ওই ভবন থেকে দৌড়ে পালান। আমরা এ সময় তার দিকে গুলি ছুড়ি। পুলিশ পরে তাকে বিলাল ভাই নামে শনাক্ত করে। তিনি একজন বিদেশি মিলিট্যান্ট।
এই কর্মকর্তা আরো বলেন, তারা ওই ভবনের নিচের সিঁড়িতে ম্যাগ্রে এবং আলতাফ ভাটের মৃতদেহ দেখতে পান। এ সময় ম্যাগ্রের হাতে ছিল একটি রিভলবার। ম্যাগ্রের পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, তিনি নির্দোষ। তারা মৃতদেহ ফেরত চান। মুদাসির গুলের মৃতদেহ পাওয়া যায় ওই ভবনের উপরের তলায়। তবে এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একজন এমন বর্ণনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
তিনি বিবিসিকে বলেছেন, গুলি করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে সাদা পোশাকের লোকজন ওই স্থানটি ঘেরাও করে ফেলে। সাধারণ লোকজনকে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। তাদের মোবাইল ফোন নিয়ে নেয়।
তাদেরকে পাশের একটি দোকানে অবস্থান করতে বলে। এরপর আলতাফ ভাটকে তিনবার রুম থেকে ডেকে নেয়া হয়। তৃতীয় বার মুদাসির গুলকে নিজের সঙ্গে উপরের তলায় ডেকে নেন তিনি। ওই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, এরপরই আমরা গুলির শব্দ শুনতে পাই। তিনি প্রশ্ন রাখেন, কেন কোনো নিরাপত্তা গিয়ার ছাড়াই ওই ভবনের ভিতরে বেসামরিক মানুষকে প্রবেশ করানো হয়েছিল।
আবদুল মাজিদ ভাট বলেন, তার ভাইয়ের তিন বছর বয়সী একটি শিশু আছে। তার একটিই প্রশ্ন- আমার বাবাকে এনে দাও। কিন' তাকে আমি কোথা থেকে এনে দেবো?
-এটি