আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: যে হেলিকপ্টারটি সম্প্রতি বিধ্বস্ত হয়ে ভারতের প্রতিরক্ষা প্রধান বিপিন রাওয়াত নিহত হয়েছেন সেটি ভারতীয় বিমান বাহিনীর অন্যতম নির্ভরযোগ্য হেলিকপ্টার। শুধু সামরিক কর্মকর্তা নয়, ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীও এই এমআই-১৭ভি৫ হেলিকপ্টার ব্যবহার করে থাকেন।
জানা যায়, রাশিয়া থেকে এটি আমদানি করা হয়েছিল। তবে ভারতের জন্য বিশেষভাবে এর নকশা তৈরি করা হয়ছিল। এর আগের কয়েকটি উড়ানে এই হেলিকপ্টারে কোনোরকম অসুবিধা দেখা দেয়নি।
হেলিকপ্টারে কখনোই কোনো প্রযুক্তিগত ত্রুটির অভিযোগ ছিল না। ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রটোকল অনুসারে প্রতিবার ভিভিআইপি উড়ানের আগে হেলিকপ্টারের তিন দফায় পরীক্ষা করা হয়।
তারপর হেলিকপ্টারটি সিল করে দেয়া হয়। এই হেলিকপ্টারের দুইটি ইঞ্জিনই খারাপ হয়ে গেলে, সেটি নিরাপদে ধানখেতে নেমে আসতে পারে। এই হেলিকপ্টারে যে রাডার রয়েছে, তা দিয়ে চারপাশের ৬০০ কিলোমিটারে আবহাওয়া সম্পর্কে জানা যায়।
এমআই-১৭ভি৫ হেলিকপ্টারটি নজরদারি ও শত্রুর ওপর হামলা চালাতেও ব্যবহার করা হয়। এ হেলিকপ্টার থেকে ক্ষেপণাস্ত্র পর্যন্ত নিক্ষেপ করা যায়। মেশিনগানের মতো অস্ত্রও ব্যবহার করা হয় হেলিকপ্টারটিতে।
আরো জানা যায়, ১ হাজার ১০০ কিলোমিটার ওড়ার মতো জ্বালানি বহন করতে পারে হেলিকপ্টারটি। পাহাড়ি অঞ্চলে ওড়ার ক্ষেত্রে এটি বিশেষায়িত; যদিও গতকাল পাহাড়ি অঞ্চলেই এটি বিধ্বস্ত হয়েছে।
চার টন পর্যন্ত ওজন নিতে পারত এই হেলিকপ্টার। কোথায়ও আগুন লাগলে অগ্নিনির্বাপণে এটি ব্যবহার করা হতো। এটি তিন হাজার লিটার পানি বহন করতে পারে। ২০১৬ সালে উত্তরাখন্ডের বনে যখন আগুন লাগে, তা নির্বাপণে এটি ব্যবহার করা হয়েছিল।
এমআই-১৭ভি৫ হেলিকপ্টারের স্বয়ংক্রিয় ফ্লাইট ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থাৎ কোনো ফ্লাইটের পরিকল্পনা করে সেই তথ্য পেনড্রাইভের মাধ্যমে হেলিকপ্টারের কম্পিউটারে প্রবেশ করানো যায়। এরপর অটো পাইলট ও কম্পিউটার মিলে যাত্রীকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে এমআই-১৭ভি৫। এ জন্য ভারতের সামরিক কর্মকর্তাদের পছন্দের হেলিকপ্টার এটি।
এত কিছুর পরও হেলিকপ্টারটি কেন হুট করেই বিধ্বস্ত হল তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে রহস্যম্যয়তা। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, শুধু কি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই কপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়েছে? নাকি এর পেছনে কোনো নাশকতা রয়েছে? ঠিক কী কারণে মাঝ আকাশে অগ্নি সংযোগ হয়ে হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হল?
রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপত্র জাগো বাংলায়ও এমনই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। জাগো বাংলার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ‘এটা কি নেহাতই যান্ত্রিক ত্রুটি? যান্ত্রিক ত্রুটি হলে, হেলিকপ্টার পরীক্ষার সময় সিস্টেমে কেন ধরা পড়ল না? এমন কি ঘটনা ঘটল যাতে কার্যত ইঞ্জিন বিকল হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল? এত বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও কেন ভেসে থাকা গেল না?’
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার আসল কারণ খুঁজতে ইতিমধ্যেই ট্রাই সার্ভিস তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে ভারতের বিমান বাহিনী। তদন্তের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এয়ার মার্শাল মানবেন্দ্র সিং। তদন্ত দল গতকালই ওয়েলিংটনে পৌঁছে তদন্ত শুরু করে। আর এরই মধ্যে আজ সকালে বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারের ব্ল্যাক বক্স পেয়েছে তল্লাশি দল।
হেলিকপ্টারের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। উইং কমান্ডার আর ভরদ্বাজের নেতৃত্বে বিমানসেনা অফিসারদের একটি বিশেষ দল এই তল্লাশি অভিযান চালায় আজ সকালে। সেই সময়ই দুর্ঘটনাগ্রস্ত হেলিকপ্টারের ব্ল্যাকবক্স সহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ব্ল্যাক বক্সের থেকে অনেক অজানা তথ্য উঠে আসবে। এই বাক্সেই ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার ও ককপিট ভয়েস রেকর্ডার থাকে। এর থেকে জানা যেতে পারে যে কী কারণে এই হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হল। জানা যেতে পারে, ঠিক কী কারণে মাঝ আকাশে অগ্নি সংযোগ হয়ে হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হল।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সংসদকে বলেছেন যে, প্রতিরক্ষা প্রধান বিপিন রাওয়াতকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি অবতরণের ৭ মিনিট আগে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ হারায়। এবং বিধ্বস্ত হওয়ার আগে কোন বিপদ সংকেতও পাঠায়নি। হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মৃত জেনারেল বিপিন রাওয়াতের শেষকৃত্য হবে শুক্রবার। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তার দেহ দিল্লিতে পৌঁছাবে।
জেনারেল বিপিন রাওয়াত ছিলেন ভারতের প্রথম চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ। সেনা, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সম্মিলিত প্রধান। সাবেক সেনা প্রধান রাওয়াতকে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এই নতুন দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তিনি ১৯৭৮ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। জম্মু ও কাশ্মীর এবং চীনের সঙ্গে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখাতেও তিনি সেনার কম্যান্ডিং অফিসার ছিলেন।
বুধবার হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় তিনি ও তার স্ত্রী মারা যান। তাদের সঙ্গে মারা গেছেন আরো ১১ জন। দুর্ঘটনায় একমাত্র জীবীত ব্যক্তি হলেন বিমান বাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন বরুণ সিং। তিনি সুলুরে বিপিন রাওয়াতকে স্বাগত জানিয়ে ওয়েলিংটন নিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন।
-এটি