বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :

'ফোনালাপ ফাঁসে সাংবাদিক, বিটিআরসিসহ সবার সজাগ থাকা দরকার'

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা তদন্ত এবং ফোনে আড়িপাতা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে দাখিল করা রিট আবেদনের ওপর শুনানি সম্পন্ন হয়েছে সোমবার। আদালত আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর আদেশের জন্য দিন ধার্য করেছেন।

আদালত বলেছেন, ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে আড়িপাতা যেমন ঠিক না, তেমনি মিডিয়া সগৌরবে যেভাবে প্রচার করে এটাও কিন্তু ঠিক না। এজন্য সাংবাদিক, বিটিআরসিসহ সকলেরই সজাগ থাকা দরকার।

আদালত বলেন, এই ফোনালাপের কথোপকথন মিডিয়ায় প্রকাশের পর সংশ্লিস্ট ব্যক্তিকে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিন্তু এই ফোনালাপ কারা রেকর্ড করে? দুই পক্ষের মধ্যে যেকোনো এক পক্ষ করে থাকতে পারে, তৃতীয়পক্ষও করতে পারে। তৃতীয় পক্ষের কি লাভ, আমার মনে হয় বিটিআরসিকে এটা দেখা দরকার।

বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার আদেশের জন্য দিন ধার্য করেছেন।

এর আগে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন, বিটিআরসির পক্ষে ব্যারিস্টার খোন্দকার রেজা-ই-রাকিব এবং রিট আবেদনকারীপক্ষে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। এসময় আদালত উল্লেখিত অভিমত দেন।

শুনানিতে অ্যাডভোকেট শিশির মোহাম্মদ মনির বলেন, দেশে আইনের শাসন রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার জন্য একজন আইনজীবী আইনি কাঠামোর মধ্যে সব করতে পারে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল আইনে যখন একজন আইনজীবী শপথ নেন, এই শপথ অনুযায়ী একজন আইনজীবী দেশের স্বার্থে রিট আবেদন করতে পারেন। তিনি বলেন, বার কাউন্সিল আইন অনুযায়ী আইনগত প্রতিকার পাইয়ে দেওয়া দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা একজন আইনজীবীর শপথের অংশ। এখানে অ্যাটর্নি জেনারেল নিজেই বার কাউন্সিলের অংশ। সে কারণে একজন আইনজীবী রিট আবদেন করার অধিকার রাখেন। তিনি বলেন, এই রিট আবেদন করার আগে বিটিআরসিসহ সংশ্লিস্টদের আইনি নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। একারণে রিট আবেদন করা হয়েছে। বিটিআরসির আইনে ফোনালাপ ফাঁস হবার পর দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে প্রতিকার পাবার সুযোগ আছে সত্য। তিনি বলেন, আমাদের অভিযোগ কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার বিরুদ্ধে নয়। আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারের তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে যেকোনো নাগরিকের ফোনালাপ রেকর্ড করার সুযোগ আছে। এটা নিয়ে

আমাদের কোনো কথা নেই। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃংখলা রক্ষায় ফোনালাপ রেকর্ড করুক তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু যেকোনো নাগরিকের ব্যক্তিগত ফোনালাপ রেকর্ড ও ফাঁস করার আইনগত অধিকার কারো নেই। আমাদের বক্তব্য এখানেই। যদি রেকর্ড করা হয় তবে সেটা সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী হবে। সংবিধান অনুযায়ী ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষায় বিটিআরসিকে পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের বক্তব্য বিটিআরসি আইনের ৩০(চ) ধারা অনুযায়ী ফোনালাপ ফাঁস হবার আগেই বিটিআরসি ব্যবস্থা নিতে পারে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে ফোনালাপসহ যেসব ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে তার কিছু নজীর তুলে ধরে বলেন, এটা ফাঁস হবার আগেই বিটিআরসি ব্যবস্থা নিতে পারতো। এখনও পারে। কারণ মোবাইল অপারেটর কম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রন, পর্যবেক্ষন করার আইনগত ব্যবস্থা বিটিআরসির আছে। সেই ব্যবস্থায় ফোনালাপ ফাঁসও বন্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে বিটিআরসি। একারণে ফোনালাপ ফাঁস বন্ধে রুল জারির আবেদন করছি। একইসঙ্গে এরইমধ্যে যেসব ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে, সেসব ঘটনা সঙ্গে কারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে বিটিআরসি যেন তদন্ত করে সেই নির্দেশনা চাচ্ছি।

শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, যারা রিট আবেদন করেছেন, তারা আইনজীবী। তারা নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। একারণে তাদের এই রিট আবেদন করার আইনগত এখতিয়ার নেই। তিনি বলেন, কারো ফোনালাপ ফাঁস হলে তিনি বিটিআরসি আইন অনুযায়ী প্রতিকার চেয়ে ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় আইনেই মামলা করতে পারেন। ক্ষতিপূরণ চাওয়ার সুযোগ আছে। প্রতিকার পাওয়ার সুনির্দিস্ট আইন থাকায় জনস্বার্থে রিট আবেদন করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এই মামলায় যেসব উদাহরণ দেওয়া হয়েছে তাদের কেউই কোনো অভিযোগ করেনি। তিনি বলেন, ১৯৯৯ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ ও একজন বিচারকের ফোনালাপ ফাঁস করে মানবজমিন পত্রিকা রিপোর্ট প্রকাশ করে। এরপর তা নিয়ে মামলা হয়। ওই মামলায় পত্রিকার প্রকাশক, সম্পাদক প্রতিবেদকের সাজা হয়। এই মামলা আপিল বিভাগে বিচারাধীন। সুতরাং যদি কারো ফোনালাপ ফাঁসও হয় তবে তা মিডিয়া প্রকাশ করতে পারে না। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও জনশৃংখলার স্বার্থে ফোনালাপ রেকর্ড করার সুযোগ আছে।

ব্যারিস্টার খোন্দকার রেজা-ই-রাকিব অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য সমর্থন করে বলেন, আইনে যদি সুযোগ না থাকতো তবেই সংবিধান অনুযায়ী এই রিট আবেদন করার সুযোগ থাকতো। যেহেতু আইনে সুনির্দিষ্ট বিধান আছে, তাই রিট আবেদন করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, কেউ যদি সংক্ষুব্ধ হন তবে তিনি বিটিআরসির কাছে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করতে পারেন। এখানে রিট আবেদনকারী কেউই সেটা করেনি। তাই রিট আবেদন চলতে পারে না। এসময় তিনি ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে বিভিন্ন কনটেন্ট সরানোরর বিষয়ে বিটিআরসির সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অন্য একটি বেঞ্চ(হাইকোর্ট) ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে কনটেন্ট সরানোর নির্দেশ দেন। আপিল বিভাগ থেকেও প্রধান বিচারপতি সংক্রান্ত একটি পোস্ট সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এরমধ্যে প্রধান বিচারপতি সংক্রান্ত পোস্টটি সরানো গেছে। বাকীগুলোতে আমরা কিছু করতে পারিনি। সেখানে আমাদের হাত নেই। আপত্তিকর কিছু সরানোর বিষয়ে আমাদের কারো সক্ষমতা নেই। ফেসবুক বা ইউটিউব কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হয়। তাদের বলতে হয়। এরপর তারা যদি সরাতে চায় তবেই কেবল সেটা সম্ভব। এখানে বিটিআরসি নিজে নিজে কিছুই করতে পারে না।

এই শুনানিকালে আদালত বলেন, কেউ যদি ফোনে আড়ি পাতে, কেউ যদি রেকর্ড করে এটা চিহ্নিত করার বিষয় আছে। তৃতীয় পক্ষ যদি কেউ রেকর্ড করে বিভিন্ন মিডিয়ায় দেয়, আর মিডিয়া যদি সেটা প্রচার করে, এক্ষেত্রে কিন্তু মিডিয়ারও একটা ভূমিকা আছে। আদালত বলেন, সম্প্রতি আমি একটা মিডিয়ার প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে কিছু কিছু রিপোর্টগুলো এত বেশি হাইলাইট করে প্রচার করা হয় কেন, তা জানতে চাইলাম। উনাদের (সাংবাদিকদের) কাছ থেকে যে বক্তব্যটা পেলাম সেটা হল, কিছু কিছু খবর প্রচার হওয়ার পর যখন তারা (গণমাধ্যম) এটা (প্রচারিত খবর) ফেসবুক বা ইউটিউবে দেয় তখন এটাতে লাইক পড়ে, শেয়ার হয়। এতে নাকি লাখ লাখ টাকা আয় হয়। এ বিষয়টা কিন্তু অনেক সময় এ ধরনের নিউজগুলো (অডিও-ভিডিও ফাঁসের) প্রচারের পিছনে কাজ করে। আজকাল নানা ধরনের টিভি হয়েছে, ঘরে ঘরে অনলাইন(আইপি) টিভি। এসবের লাইসেন্সও নাই। এই সমস্যাগুলো আছে। যখন এ ধরনের নিউজ মিডিয়ায় প্রচারিত হয়, এসব খবর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত করে।

গত আট বছরে দেশে যেসব ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে তার তদন্ত এবং ফোনে আড়িপাতা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে গত ১০ আগস্ট রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবী। রিট আবেদনকারীরা হলেন-অ্যাডভোকেট রেজওয়ানা ফেরদৌস, উত্তম কুমার বনিক, শাহ নাবিলা কাশফী, ফরহাদ আহমেদ সিদ্দীকী, মোহাম্মদ নওয়াব আলী, মোহাম্মদ ইবরাহিম খলিল, মুস্তাফিজুর রহমান, জি এম মুজাহিদুর রহমান (মুন্না), ইমরুল কায়েস ও একরামুল কবির। রিট আবেদনে ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সচিব, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক সচিব, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের(বিটিআরসি) চেয়ারম্যানকে বিবাদী করা হয়েছে।

এর আগে আড়িপাতা প্রতিরোধে এবং ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা তদন্তে পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) গত ২২ জুন আইনি নোটিশ দেওয়া হয়। নোটিশের জবাব না পেয়ে রিট আবেদন দাখিল করা হয়।

রিট আবেদনে বলা হয়েছে, সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী চিঠিপত্র ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা সংরক্ষণ নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। এছাড়াও ২০১১ সালের ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি অ্যাক্ট-২০০১ এর ৩০(চ) ধারা অনুযায়ী টেলিযোগাযোগের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংরক্ষণ নিশ্চিত করা এই কমিশনের দায়িত্ব। কিন্তু ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা অহরহ ঘটলেও বিটিআরসি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।

-এএ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ