মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন।।
চলতি বছরের ২১ এপ্রিল থেকে ২০ মে, এই এক মাসে চলে গেলেন উপমহাদেশের শক্তিমান তিনজন লেখক। উর্দু সাহিত্যে তারা তিনজনই ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব। আরবি সাহিত্যেও তাদের রয়েছে বিশাল অবস্থান।
শুধু লেখকই নন, গবেষক ও চিন্তার নায়ক হিসেবেও তারা ছিলেন বিপুল সমাদৃত। কলমের এই তিন সিপাহসালার হলেন মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনি, মাওলানা আসির আদরাবি ও মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান। তাদের নিয়ে এখানে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলো-
আমাদের আরবকণ্ঠ নুর আলম খলিল আমিনি রহ.
মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনি আমার সরাসরি উস্তাদ এবং সাহিত্যের উস্তাদ। আমি নিজে তার কাছে আধুনিক গদ্যসাহিত্য পড়েছি। তিনি আমাদের দেওবন্দি জামাত অন্য ভাষায় কাসেমি কাফেলার সাহিত্যের সিপাহসালার ছিলেন।
আমরা তাকে বলতাম তিনি হলেন আমাদের জন্য একজন আদর্শ ও শতভাগ নির্ভরযোগ্য আরবকণ্ঠ। আমাদের পক্ষ হয়ে আমাদের চিন্তা আদর্শ বিশ্বাস ও কর্ম এসবকে তিনি সরাসরি, একেবারে রক্তে-মাংসে যারা আরব তাদের ভাষায় পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করেছেন। এটা আমাদের ইতিহাসে বিশেষ করে কাসেমি জামাতের ইতিহাসে একটি অনন্য উপমা।
বাংলাদেশে তিনি ওইভাবে আলোচিত নন, ঠিক যেভাবে আলোচিত হওয়ার দাবিদার। এটা দুই কারণে। একটি কারণ হলো আমাদের এখানে সেভাবে আরবি সাহিত্যের চর্চাটা নেই। আরেকটা বড় গ্যাপ হলো আমাদের তরুণদের মধ্যে শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত থাকবার যে প্রেরণা, এই প্রেরণাটার মধ্যেও কিছুটা ঢিলেঢালা ভাব আছে। ফলে মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনি রহ. এখানে যেভাবে আলোচিত হওয়া দরকার ঠিক সেভাবে আলোচিত হননি।
চিরায়ত সাহিত্য বলতে যা বোঝায় সেই রকমের সম্পদ হিসেবে তার আরবি ও উর্দু রচনাগুলো স্বীকৃত হচ্ছে। কী আরবি কী উর্দু দুই জায়গাতেই তার যে কলমের শক্তিটা এই শক্তি উভয় ভাষার সাহিত্যিক ও গবেষকরা সমানভাবে মুগ্ধতার সঙ্গে স্বীকার করেছেন।
আমি প্রথমে তার সৃষ্টিশীল কিছু রচনার কথা বলে রাখি। তিনি শিশুদের আরবি শেখানোর জন্য বই লিখেছেন ‘মিফতাহুল আরাবিয়া’ নামে। তার অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে আছে ‘মাতা তাকুনুল কিতাবাতু মুয়াসসিরাতান’, ‘তাআল্লামুল আরাবিয়াতা ফা ইন্নাহা মিন দীনিকুম’, ‘আস সাহাবা ওয়া মাকানাতুহুম ফিল ইসলাম’, ‘মুজতামাআতিনাল হাজিরাহ ওয়াত তরিকু ইলাল ইসলাম’, ‘ফালাস্তিন ফি ইন্তিজারি সালাহ উদ্দীন’, ‘আল মুসলিমুনা ফিল হিন্দ’, ‘আদ দাওয়াতুল ইসলামিয়া বাইনাল আমসি ওয়াল ইয়াউম’ ইত্যাদি।
উর্দু ভাষায় তার রচনাবলির মধ্যে আমি বিশেষভাবে নাম বলছি ‘ওহ কোহকান কি বাত’, তার নিজের লেকচার সমগ্র ‘হরফে শিরিন’, ‘মাউজুদা সালিবি সাহইউনি জাঙ্গ: হাকায়েক আওর দালায়েল’, ‘আলমে ইসলামিয়া কে খেলাফ হালিয়া জাঙ্গ’, ‘কেয়া ইসলাম পিছপা হো রাহা হ্যয়? ইত্যাদি।
তার সাহিত্যের ক্ষেত্রে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো উর্দু থেকে আরবিতে অনুবাদ। তিনি মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী, মাওলানা মনজুর নোমানির সান্নিধ্যে থেকেছেন।
বাইরের লোকদের মধ্যে তিনি মাওলানা মুফতি তাকি উসমানিকে অনুবাদ করেছেন। আর আমাদের মনীষীদের মধ্যে মাওলানা আশরাফ আলি থানভি রহ. এবং শাইখুল ইসলাম মাওলানা মাদানি রহ.-এর বয়ান ও লেখা তিনি নিজে আরবিতে অনুবাদ করে নিয়মিত ‘আদ দাঈ’ পত্রিকায় ছেপেছেন। এমনকি এ জাতীয় রচনাবলি থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ২৫টি। গ্রন্থের তরজমা ছাড়াও তিনি দুই শতাধিক রচনার তরজমা করেছেন। আর মিসর সৌদি আরবসহ বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রে প্রকাশিত তার প্রবন্ধের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।
নুর আলম খলিল আমিনির মৃত্যুর মাধ্যমে এই জায়গাটায় এমন একটা শূন্যতা সৃষ্টি হলো, আমাদের চোখের সামনে এই শূন্যতা পূরণ করবার মতো কোনো লোক আসবে মনে করি না। কেন মনে করি না? প্রত্যেক পরবর্তী মানুষ পূর্ববর্তী মানুষকে জানাশোনার বিচারে ছাড়িয়ে যাওয়া কোনো ব্যাপার না। কিন্তু চিন্তা আদর্শ আস্থা এবং ভালোবাসার জায়গায় বরাবরই যেটা দেখি প্রত্যেক পরবর্তী তাদের পূর্ববর্তীদের থেকে অনেক পেছনে থাকে।
নুর আলম খলিল আমিনি দারুল উলুম দেওবন্দ এবং সেখানকার সন্তানদের ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান চিন্তা এবং পৃথিবীর প্রতি তাদের যে দায়বোধ সেটা থেকে তাদের যে কর্ম ও অঙ্গীকার; আর এই অঙ্গীকার পূরণে তাদের যে ত্যাগএসব বিষয়কে যে আস্থা ও ভালোবাসার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন সেভাবে উপস্থাপনের মতো লোক এখনই চোখের সামনে কাউকে দেখি না। পরে হয়ত যোগ্য লোক আসবে, কিন্তু এমন প্রেমিক লোক আসবে না।
‘আদ দাঈ’ দারুল উলুম দেওবন্দের মুখপত্র। এই মুখপত্র ভাষা চিন্তা এবং আদর্শের ক্ষেত্রে শতভাগ আমাদের মুখপত্র। আমরা এখন ঠিক বলতে পারি না, আগামী দিনে ঠিক এসব বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে ‘আদ দাঈ’ আরব বিশ্বের কাছে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে পারবে কি না। গত ৩ মে ২০২১ তিনি পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। আমরা দোয়া করি, আল্লাহ তায়ালা আরবি ভাষার এই প্রেমিক সেবককে সাইয়েদুনা হজরত আলী রা. সাইয়েদুনা হজরত হাসসান রা.-এর সঙ্গে হাশর করেন।
বরিত লেখক প্রতিভা মাওলানা আসির আদরাবি রহ.
মাওলানা আসির আদরাবির পৈত্রিক নাম মাওলানা নিজামুদ্দীন। কিন্তু তিনি আসির আদরাবি নামে এতোটাই বিখ্যাত যে, মূল নামে তাকে কেউ চিনে না। জন্ম ১৯২৬ সালে, ইন্তেকাল করেছেন ২০২১ সালের ২০ মে। সেই হিসেবে তার বয়স ৯৪ বছর। দারুল উলুম দেওবন্দে পড়েননি, পড়েছেন দিল্লির শাহি মুরাদাবাদে। সেটার প্রতিষ্ঠাতাও হলেন মাওলানা কাসেম নানুতবি রহ.। শাহি মুরাদাবাদে পড়ে আমাদের ভারতের আলেমসমাজের মধ্যে লেখালেখির ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য দুজন মানুষ বিখ্যাত। একজন মাওলানা আসির আদরাবি, আরেকজন মাওলানা কাজি আতহার মোবারকপুরী।
মাওলানা আসির আদরাবি একাধারে একজন সক্রিয় রাজনীতিবিদ, জমিয়তের মাঠ পর্যায়ের সক্রিয় নেতা। আবার সাংবাদিক ও গবেষক লেখক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তিনি বেনারস থেকে প্রকাশিত ‘তরজুমানে ইসলাম’-এর সম্পাদক ছিলেন। পত্রিকাটি খুব মর্যাদাশীল গবেষণা পত্রিকা হিসেবে বিখ্যাত। আমাদের উলামায়ে কেরামের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য।
ভারতীয় আলেমসমাজের কাছে মাওলানা আসির আদরাবি খুবই মর্যাদাশীল এবং প্রতিষ্ঠিত মানিত বরেণ্য লেখক সাহিত্যিক ও গবেষক। তার রচনাবলি দেখলেও তার জায়গা ও চিন্তার ক্ষেত্র আমরা নির্ণয় করতে পারব। তার কয়েকটি বইয়ের নাম: ‘দারুল উলুম দেওবন্দ: ইহইয়ায়ে ইসলাম কি আজিম তাহরিক’, ‘মাআছিরে শাইখুল ইসলাম’, ‘তাহরিকে আজাদি আওর মুসলমান’, ‘হজরত শাইখুল হিন্দ: হায়াত আওর কারনামে’, ‘মাওলানা কাসেম নানুতবি: হায়াত আওর কারনামে’, ‘গারে হেরা সে গুম্বদে খাজরা তক’, এই বইটি আমি অনুবাদ করেছি ‘নুরের পর্বত থেকে সবুজ গম্বুজ’ নামে। তার আত্মজীবনী আছে ‘দাস্তানে না-তামাম’ নামে, যেটা বাংলা করলে দাঁড়ায় অসমাপ্ত আত্মজীবনী। ‘তারিখে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’ তার অনন্য রচনা।
আমরা যারা লেখালেখি চর্চা করি তারা তাকে যে কারণে পড়তে পারি এর একটি বড় কারণ হলো তার উর্দু অসামান্য প্রাঞ্জল, একেবারে সাদামাটা। শায়খুল হাদিস জাকারিয়া রহ.-এর মতো সাদামাটা। তবে ঠিক ওই রকমের সাদামাটা না।
বরং অলংকার-সমৃদ্ধ। কিন্তু অলংকারটা তিনি এতোটাই হজম করে ব্যবহার করেন তার অলংকার কাউকে দাঁড় করায় না, কাউকে ধাক্কা দেয় না। প্রাঞ্জল অলংকারপূর্ণ ভাষা।
একই সঙ্গে যে বিষয়টি তিনি বলতে চান সেই জায়গাটা তার কাছে খুব স্পষ্ট থাকে। ফলে দাবি করবার সময়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করেন না। একজন লেখকের দাবিটা কেমন হওয়া উচিত এর চমৎকার উদাহরণ তিনি। যেকোনো বিষয়কে যখন বিশ্লেষণ করেন তখন বিশ্লেষণটা মনে হয় না চাপিয়ে দিচ্ছেন।
একজন মানুষ একই সঙ্গে ময়দানের সৈনিক আবার একই সঙ্গে কলমের সৈনিক। ময়দানেরও সিপাহসালার আবার কলমেরও সিপাহসালার। একজন মানুষ ময়দানের সক্রিয় রাজনীতিতে গোটা ভারতে তোলপাড় সৃষ্টি করতে পারেন, ওই মানুষটা আবার বছরের পর বছর নিরিবিলি এইভাবে গবেষণা করছেন যে, সাহিত্য নিয়ে তার যে সমস্ত প্রবন্ধ আছে, কবিতা নিয়ে যে সমস্ত প্রবন্ধ আছেওইগুলো পড়লে বোঝা যায়, তিনি কবিতা লিখতেন। এটা এক অনন্য বৈশিষ্ট্য তার।
তিনি পূর্ণ বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু তারপরও তার যে কাজগুলো আছে সে কাজগুলো দেখলে পড়লে মনে হয় এতো গুছিয়ে, এতো সুশৃঙ্খলভাবে, এতোটা আস্থাপূর্ণ কাজ করবার মতো একজন লোককে হারিয়ে ফেললাম! বিষয়টা মনের গভীরে তীরের মতো বিঁধে।
মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান: যাঁকে পড়তে হবে সতর্কতার সঙ্গে
মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান খুবই প-িত ব্যক্তি। জন্ম ১০ অক্টোবর ১৯২৫, মৃত্যুবরণ করেছেন ২০২১ সালের ২১ এপ্রিলে। প্রায় ৯৬ বছর দুনিয়াতে কাটিয়েছেন।
এরকম মানুষও বোধহয় খুব কম যে, একই সঙ্গে অনেক বড় বড় গুণের অধিকারী। তিনি লেখক, আলোচক হিসেবেও খুব খ্যাতিমান মানুষ। এবং চিন্তাবিদ। ‘আর রিসালাহ’ নামক পত্রিকার তিনি আমরণ সম্পাদক ছিলেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার লেখা আর ওয়াজ দিয়েই পত্রিকাটা বের হতো। এবং বিপুলভাবে একটা পাঠকপ্রিয় পত্রিকা ছিল। শেষ সময়ে তিনি দিল্লিতে ইসলামিক সেন্টার নামে একটা প্রতিষ্ঠান করেন। তিনি এটার মহাপরিচালক ছিলেন। ওই জায়গা থেকে তিনি তার চিন্তা চেতনা বিতরণ করেছেন।
তাকে চেনবার প্রথম সূত্র ছিল মাওলানা মওদুদির চিন্তাধারাকে জানতে গিয়ে। আমাদের উস্তাদ মাওলানা নুর হোসাইন কাসেমী রহ. বলেছিলেন, ‘তাবির কি গলতি’ পড়ো। ‘তাবির কি গলতি’ হলো মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খানের অন্যতম রচনা। তিনি যৌবনে বন্ধু ছিলেন মাওলানা আবুল আলা মওদুদির।
জামায়াতে ইসলামীর রোকন ছিলেন। সম্ভবত শুরা সদস্যও ছিলেন। কিন্তু চিন্তার ক্ষেত্রে এসে মাওলানা মওদুদির সঙ্গে তার বিরাট বিরোধ হয়। কখনও সামনাসামনি বসে, কখনও পত্রালাপের মাধ্যমে দুজনের মধ্যে অনেক বিরোধ হয়। এসব বিরোধের পরে একটা সময় এসে মাওলানা মওদুদি তার সামনে আত্মসমর্পণ করেছেন যে, মাওলানা আমি আপনাকে বোঝাতে পারবো না, আপনার চিঠির জবাব দিতে পারবো না, আপনার মনে চাইলে থাকেন, আর মনে না চাইলে জামায়াতে ইসলামী থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারেন। এই পত্রাবলি ‘তাবির কি গলতি’র মধ্যে এসেছে।
মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খানের যে জটিলতার জায়গা সেটা একেবারে নির্দিষ্ট করে আমাদের উলামায়ে কেরাম ধরিয়ে দিয়েছেন। যেমন: ইবনে তাইমিয়ার রহ.-এর কিতাব ‘আস সা-রিমুল মাসলুল আলা শাতিমির রাসুল’ এর আলোচ্য বিষয় হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কেউ যদি মন্দ বলে গালি দেয় তাহলে সে ওয়াজিবুল কতল। এটা উম্মতের সর্বসম্মত মত।
মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান এটাকে অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, শাতিমুর রাসুল (রাসুলকে গালিদাতা)-কে কতল করা যাবে না। একইভাবে মাওলানা মওদুদি সাহেব যেমন তাকলিদের অস্বীকারকারী, তিনিও তাকলিদের অস্বীকারকারী। তাকলিদের মুনকির না হলে তো ইচ্ছামতো কথা বলা যায় না। ইচ্ছা মতো কথা বলতে গেলে দেখা যায় ফুকাহায়ে কেরাম জায়গায় জায়গায় হালাল হারাম নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ফলে মাওলানা মওদুদি সাহেব যেমন ফুকাহায়ে কেরামকে মুখস্থ ধোলাই দিয়েছেন, এই ধোলাইয়ের কাজটি মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খানও করেছেন।
খুব মজার একটি বিষয় হলো, কোনো ব্যক্তি ভালো বলতে পারলে তার ভাষা ও কলম যদি চালু হয় এবং সেই সঙ্গে সে যদি তার সালাফকে অস্বীকার করতে পারে, তাহলে আধুনিক লোক তাকে খুব তাড়াতাড়ি গ্রহণ করে। হয়তো এটাও একটা কারণ যে, মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান সারা পৃথিবীতে এতোটা দ্রুত আদৃত হয়েছেন। গর্ভাচেভের হাত থেকে তিনি পুরস্কার পেয়েছেন।
ভারতের বেসামরিক সর্বোচ্চ পুরস্কার পদ্মভূষণ সেটাও পেয়েছেন। এমনিতে শান্তির জন্য ভারতের লোকাল এবং রাষ্ট্রীয় অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। এরপরও তার কিছু ইতিবাচক দিক আছে।
এজন্য আমি আমাদের তরুণ প্রজন্ম যারা মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খানকে একজন বিরাট চিন্তক ও লেখক হিসেবে অনেকেই হয়তো পড়েন। সেই পড়ার জায়গাটাতে আমি মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খানের রচনাকে তিন ভাগে ভাগ করি। একটা জায়গা হলো যে রচনাগুলোতে তিনি ইসলামকে খালেস ধর্ম হিসেবে আলোচনার বিষয় বানিয়েছেন, সেই জায়গাগুলোতে একজন পরিপক্ক চিন্তা ও আদর্শের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি ছাড়া কারও জন্য পড়া নিরাপদ না। তাহলে তিনি কখন যে গোমরাহির শিকার হয়ে যাবেন সেটা নিজেই হয়তো বলতে পারবেন না।
আরেকটা জায়গা হলো, তিনি অন্যান্য জীবন-আদর্শ বিশেষ করে বিজ্ঞান ও আধুনিক আবিষ্কারের আলোকে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
এই জায়গাটায় আমি মনে করি তুলনামূলক ইসলামের সৌন্দর্য প্রতিষ্ঠিত করবার এই যে ম্যাজিকটা পৃথিবীর অনেকেই ইতিমধ্যে দেখিয়েছেন এবং এর প্রতি মুসলিম পাঠকদেরও এক রকমের একটা আগ্রহ আছে। এর দ্বারা অনেক সময় দেখা যায়, একজন সাধারণ মুসলমানের দিলে বিশ্বাসটা আরও শক্তিশালী হয়ে ফুটে উঠে। তো এই রকমের জায়গায় আমি মনে করি, যারা মেধাবী তারা এবং যারা লেখেন বলেন, তারা তাঁকে পড়তে পারেন।
আরেকটা জায়গা হলো মাঝামাঝি। যেখানে তিনি তুলনামূলক আলোচনা করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ এটাকেও আলোচনার বিষয় হিসেবে নেননি, একেবারে খালেস ধর্ম বিশ্বাস ও আকিদাও আলোচনার বিষয় বানাননি। কিন্তু আলোচনার বিষয় বানিয়েছেন তাহজিব তামাদ্দুনকে।
এই জায়গায় এসে অনেক সময় দেখা গেছে ওই যে তার একটা ঐক্যপ্রচেষ্টা, ওই যে একটা শান্তিবাদ, এই জায়গায় এসে কখন যে বিশ্বাসটাকেও নামিয়ে নিয়ে গেছেন অন্যদের স্তরে এই জায়গাটা খুবই সূক্ষ্ম ও শঙ্কার। এর কারণ হলো তিনি তার লেখার হাত এতোটাই পাকাতে পেরেছিলেন যে, তার সময়কার ভারত উপমহাদেশে সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান। মাওলানা মওদুদিও তার কলমের কাছে এক রকমের হেরে গেছেন। এই জায়গাটায় এসে আমি মনে করি যে কারও পক্ষে তাঁকে পড়াটা নিরাপদ না।
ইসলামের মধ্যে একজন মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো বিশ্বাসের জায়গা। তো এখানে বিশ্বাস স্খলিত হওয়ার ভয় থাকে, এজন্য যে কারও জন্যে মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খানকে পড়া আমরা সমীচীন ও সঙ্গত মনে করি না। তারপরও একজন লেখক হিসেবে মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান, তার গোত্রের মধ্যে আমরাও পড়ি। তার প্রতি তিনি যখন জীবিত ছিলেন তখন আমাদের শ্রদ্ধা ছিল। আমরা এখনও আল্লাহ তায়ালার কাছে এই দোয়া করব যে, তিনি জমহুরের পথ থেকে সরে গিয়ে যেসব কথা বলেছেন, যদি তিনি ভুল করে থাকেন তাহলে আল্লাহ তায়ালা যেন তাঁকে মাফ করে দেন এবং উম্মতকে যেন তার ওই সমস্ত ভুলভ্রান্তি থেকে হেফাজত করেন। আমিন।
অনুলিখন: শামসুদ্দীন সাদী
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন: লেখক, অনুবাদক ও মুহাদ্দিস
[লেখা ও লেখকের কথা প্রতিপাদ্য নিয়ে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক সাময়িকী ‘লেখকপত্র’ এর সৌজন্যে]