আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: দুই বছর আগে, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরের সাংবিধানিক বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে ভারতীয় সরকার। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও ৩৫ (ক) নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিলের মধ্য দিয়ে স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশের মর্যাদা বাতিল করে অঞ্চলটিকে পুরোপুরো কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত শাসনের অধীনে নিয়ে আসা হয়। সংবিধানের এই ধারা ও অনুচ্ছেদের মাধ্যমে অঞ্চলটির স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ও স্থানীয় বাসিন্দাদের বিশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিলো।
বিগত সাত দশকে ৩৭০ ধারার বলেই নিজেদের জন্য আলাদা সংবিধান, পতাকা ও দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা চালু ছিল অঞ্চলটির। ভারতের অন্য প্রদেশের ব্যতিক্রম হিসেবে জম্মু ও কাশ্মির ভারতীয় পার্লামেন্টের থেকে পৃথক হয়ে নিজেদের জন্য স্বাধীনভাবে আইন তৈরির ক্ষমতা ছিলো সাবেক এই প্রদেশটির।
ভারতীয় সংবিধানের ৩৫ (ক) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চলের বাইরের লোকেরা এ এলাকার কোনো জমি কিনতে পারতো না বা সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করতে পারতো না। এর মাধ্যমে ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ অঞ্চলটির জনসংখ্যার ভারসাম্যকে বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করা হতো।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে এ অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা ৬৮.৩১ শতাংশ আর হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ২৮.৪৩ শতাংশ।
বর্তমানে এ অঞ্চলটিকে জম্মু-কাশ্মির আর লাদাখ নামে দুইটি আলাদা অংশে ভাগ করে সরাসরি কেন্দ্র থেকে শাসন করা হচ্ছে। হিমালয়ের কোলের এই উপত্যকায় যোগাযোগের রাশ টেনে ধরে কঠোর সামরিক উপায়ে শাসন চালানো হচ্ছে।
এই অঞ্চলের মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশ্বাস তৈরি হয়েছে, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট তারিখে চালু করা বিভিন্ন নতুন আইনের মাধ্যমে সরকার এই অঞ্চলের জনসংখ্যার ভারসাম্য পরিবর্তন করতে চাচ্ছে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে জম্মু ও কাশ্মিরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করছে।
দুই বছরে জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চলে যে পরিবর্তন হয়েছে তা নিম্নরূপ,
কাশ্মিরের নাগরিকত্ব ও বসবাস আইন
ভারতীয় সংবিধানের ৩৫ (ক) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চলের বাইরের লোকেরা এ এলাকার কোনো জমি কিনতে পারতো না বা সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করতে পারতো না। এর মাধ্যমে ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ অঞ্চলটির জনসংখ্যাকে বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করা হতো।
বর্তমানে ভারত ওই আইন বাতিল করে যে সকল ভারতীয় কাশ্মিরে ১৫ বছরের জন্য বাস করছে, তাদের জমি কেনা ও সরকারি চাকরির সুযোগ দিচ্ছে। যে সকল ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা এ অঞ্চলে ১০ বছর ধরে অবস্থান করছে তাদেরও একই ধরনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এ সকল শর্ত পূরণকারী ভারতীয়দের সন্তানরাও এ সকল সুবিধা নিতে পারছেন। জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চলে অবস্থান না করলেও তারা এ সুবিধা পাবেন।
কাশ্মিরে বাস করা কাশ্মিরী-অকাশ্মিরী সব বাসিন্দাই অঞ্চলটিতে সরকারি চাকরি, ব্যবসা ও জমি-সম্পত্তি কেনার সুযোগ পাচ্ছেন।
কৌশলগত জমি অধিগ্রহণ
ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চলে দেশটির সেনাবাহিনী 'কৌশলগত গুরুত্ব' বিবেচনায় যেকোনো জমি অধিগ্রহণের আইন করা হয়েছে। কাশ্মিরে নিযুক্ত ভারতীয় সামরিক ও আধাসামরিক যেকোনো জমিই 'কৌশলগত গুরুত্ব' বিবেচনা করলে বর্তমানে তা দখল করে নিতে পারবে।
শিল্প কর্পোরেশন স্থাপন
জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চলে শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করেছে ভারত সরকার। সাথে সাথে কাশ্মিরের 'উন্নয়নের' জন্য যে কোনো জমি দখলের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তাদের দখল কাজে কোনো ভারতীয় আদালত বাধা দিতে পারবে না। তাদেরকে সাহায্য করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন বাধ্য। এমনকি তাদের দখল করা জমি তারা অন্য ভারতীয়দের দিয়েও দিতে পারবে।
স্থানীয় কাশ্মিরিদের ভয় এভাবে তাদের জমি দখল করে সরকার এখানে ‘হিন্দু বসতি’ স্থাপন করবে।
খনিজ সম্পদের অধিকার
কাশ্মিরে বিভিন্ন খনিজ সম্পদের উত্তোলনের ব্যবসার ভার্চুয়াল টেন্ডারে অংশ নিতে পারেন না কোনো কাশ্মিরী। পুরো অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্নতার সুযোগে অন্য ভারতীয়রা তাদের উচ্চ গতির ইন্টারনেট সুবিধার কল্যাণে লুফে নেন বরাদ্দ টেন্ডার।
সরকারি কর্মচারীদের বরখাস্ত
কাশ্মিরে ভারতীয় পুলিশের হাতে এমন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে তারা চাইলে তদন্তের মাধ্যমে যে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করতে পারবে। আবার ওই চাকরিতে ফিরতে বরখাস্ত কর্মচারীকে আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে।
দাপ্তরিক ভাষার পরিবর্তন
জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চলে বিগত এক শ' ৩১ বছরে একমাত্র সরকারি ভাষা ছিল উর্দু। বর্তমানে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে উর্দুর সাথে সাথে হিন্দি, ডোগরি, ইংরেজি ও কাশ্মিরী ভাষাকে এ অঞ্চলের সরকারি ভাষা করা হয়েছে।
সরকারি ছুটির তালিকা থেকে কাশ্মিরি দিবসগুলো বাদ
১৩ জুলাইয়ের কাশ্মির দিবস ও ৫ ডিসেম্বর তারিখে প্রখ্যাত কাশ্মিরী নেতা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর জন্মদিনসহ বিভিন্ন সরকারি ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
গণমাধ্যম নীতি
কাশ্মিরে নতুন এক গণমাধ্যম নীতি চালু করেছে ভারত। এর মাধ্যমে ভারতীয় সরকারের গণমাধ্যম নীতির বাইরে কোনো ধরনের সংবাদ প্রকাশ করা যাবে না। ভারতীয় সরকারে গণমাধ্যম নীতির বাইরে কোনো সংবাদ প্রকাশ করা হলে তাকে মিথ্যা সংবাদ বলা হবে।
এছাড়া ভারতীয় সরকারের গণমাধ্যম নীতির বাইরে সংবাদ প্রকাশের দায়ে সংবাদপত্রগুলোর বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করা হবে। সরকারি নীতির বাইরে সংবাদ প্রচারে সাংবাদিকদের ‘উগ্রবাদ বিরোধী আইনের’ আওতায় মামলা দেয়া হচ্ছে।
রাজধানী বদল নীতি বাদ
পূর্বে জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চলে দুইটি রাজধানী ছিল। শ্রীনগর ও জুম্মুতে ছয় মাস পরপর রাজধানী বদল করা হতো। এখন এ নীতিটি বদল করা হয়েছে।
সরকারি চাকরি প্রাপ্তিতে তদন্ত
ভারতে কাশ্মিরি মুসলিমদের চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সিআইডির ইতিবাচক তদন্ত প্রতিবেদন থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে চাকরি আবেদনকারীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার, আত্মীয়-স্বজনের রাজনৈতিক পরিচয়, পাঁচ বছরে ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নাম্বার, মামলা ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিয়ে তদন্ত করা হবে।
আন্দোলনকারীদের কোনো পাসপোর্ট দেয়া হবে না
যারা ভারতীয় সরকারের নীতির বিরোধীতা করে কাশ্মিরে আন্দোলন করছেন তাদেরকে কোনো পাসপোর্ট দেয়া হবে না বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার।
জেলা উন্নয়ন কাউন্সিল
কাশ্মির অঞ্চলের ক্ষেত্রে ভারতের সরকার সংবিধান ও আইন পরিবর্তন করে তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় সরকার গঠন করেছে। এর মাধ্যমে জেলা ও গ্রাম পর্যায়ের সরকারকে শক্তিশালী করা হয়েছে।
এ নীতির মাধ্যমে এমন নীতি নেয়া হয়েছে যাতে নির্বাচিত এমপিরা তাদের পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পরবেন না। এ বিষয়ে ভারতপন্থী কাশ্মিরি রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী নায়িম আখতার বলেন, ভারত সরকার এমনভাবে বিরাজনীতিকরণ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে যাতে করে
কেন্দ্রীয়ভাবে জনগণের প্রতিনিধিদের কিছু বলার থাকবে না। ক্ষমতাকে এমনভাবে ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করা হয়েছে, এ কারণে কেউ জানে না যে কে আসলে কোন ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করছে।
সম্পদের কর
ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের নগর এলাকার জমি ও বাড়ির ওপর কর ধার্য করতে পারবে স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু, গত ৩০ বছরের রাজনৈতিক
অস্থিরতা আর ২০১৯ সালের আগস্ট মাসের ৫ তারিখে থেকে চলমান লকডাউনের কারণে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। ব্যবসায়ীরা শত শত কোটি মার্কিন ডলাররের লোকসানে আছেন। এ অবস্থায় স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা সম্পদের কর দেয়ার নীতিকে এক ধরনের অত্যাচার হিসেবে দেখছেন।
ভারতীয় পতাকা
সকল সরকারি ভবনে ভারতের পতাকা উত্তোলন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ওয়াকফ বিভাগ
ওয়াকফ বিভাগের সাধারণ দেখভালের দায়িত্ব স্থানীয় ওয়াকফ বোর্ডের থাকলেও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের কাছে দেয়া হয়েছে।
সরকার গত বছর ঘোষণা করেছে যে শিয়া ও সুন্নিদের জন্য আলাদাভাবে ওয়াকফ বোর্ড গঠন করা হয়েছে।
কাশ্মিরের সংসদীয় আসনের সীমানা নতুন করে নির্ধারণ
ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের সংসদীয় আসনের সীমানা নতুন করে নির্ধারণ করছে দেশটির সরকার। এমনভাবে এসব সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ করা হচ্ছে যাতে করে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল থেকে বেশি এমপি নির্বাচিত হন। এ কারণে স্থানীয় মুসলিমরা ভয় পাচ্ছেন যে ভারতীয় সরকারের এ সকল পদক্ষেপের মাধ্যমে কাশ্মির উপত্যকা ও অন্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার এমপিদের ক্ষমতাকে বিনষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সূত্র: ইয়েনি শাফাক
এনটি