আন্তর্জাতিক ডেস্ক: অত্যান্ত একটি পরিতাপের খবর, একটি শোক সংবাদ, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচারকারী তুরস্কের বিশিষ্ট আলেম শায়খ নেয়ামাতুল্লাহ তুর্কি ইন্তেকাল করেছেন।
ইসলাম প্রচারে তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ঘুরে বেরিয়েছেন। গতকাল শুক্রবার (৩০ জুলাই) তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল প্রায় ৯০ বছর।
তুরস্ক, সৌদি ও জাপানে দীর্ঘ অবস্থান: শায়খ নেয়ামাতুল্লাহ তুর্কি আনুমানিক ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দির একজন প্রাজ্ঞ আলেম ও দায়ি। উসমানি সম্রাজ্যের শেষ সুলতান আবদুল হামিদের শাসনামলে অনেক আলেমের কাছে তিনি শিক্ষা অর্জন করেন। তিনি মদিনায় ১৫ বছর একটি মসজিদের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মক্কার জাবালে হেরা প্রান্তরের আন নুর মসজিদের ইমাম হিসেবে ১৫ বছর দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত সুলতান আহমদ মসজিদসহ অনেক মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ঘুরে ঘুরে ৫৫টির বেশি দেশে ইসলাম প্রচারে সফর: ইউরোপ ও এশিয়ার ৫৫ টিরও বেশি দেশে তিনি ইসলাম প্রসারে সফর করেছেন। সেখানকার ভাষায় ইসলামের পরিচিতিমূলক ছোট কার্ড ও বই প্রস্তুত করে সব সময় নিজের পকেটে এসব বই রাখতেন আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে তা বিতরণ করতেন। সব স্থানে সব শ্রেণীর লোকদের মধ্যে ইসলামের বাণী পৌঁছে দিতে তিনি প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব।
মদশালা থেকে ইসলামের পথে: নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষের কাছে বিচিত্র পদ্ধতিতে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরতেন তিনি। এমনকি থাইল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের মদের বার থেকে অসংখ্য নেশাগ্রস্ত মানুষকে মসজিদে আঙিনায় নিয়ে আনেন তিনি। মানুষের কাছে সহজভাবে হাসিমাখা মুখে ইসলামের কথা বর্ণনা করা ছিল তুর্কি এ আলেমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
চীনে ২০ হাজার কোরআনের কপি প্রেরণ: ১৯৮১ সালে চীন সরকারের অনুমতিক্রমে দেশটিতে ২০ হাজারের বেশি পবিত্র কোরআনের কপি পাঠিয়েছেন। তাছাড়া সাইবেরিয়াসহ রাশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রার মধ্যেও শুধুমাত্র সাদা জুব্বা পরে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। শীত-গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমে তিনি শুধুমাত্র সাদা রঙের জুব্বা পরে মানুষকে দাওয়াত দিতেন।
টোকিওতে ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা: শায়খ নেয়ামাতুল্লাহ জাপানে ১৫ বছর অবস্থান করেন। এ সময় রাজধানী টোকিওতে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রসারে একটি ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। জাপান, কোরিয়া ও ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের হাজার-হাজার লোক তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন।
জাপানের ইসলামিক সেন্টারের প্রধান ড. সালেহ সামেরি বর্ণনা করেন, শায়খ নেয়াতুল্লাহ জাপানে ১৪ বছরের বেশি অবস্থান করেন। এ সময় তিনি উত্তর-দক্ষিণ প্রান্তর চষে বেরিয়ে অসংখ্য মসজিদ ও মাদরাসা স্থাপন করেন।
তাঁর ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর দাওয়াতে অসংখ্য মানুষ সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রতিদিন ইসলামের পরিচিতিমূলক ছোট বইয়ের শত শত কপি বিতরণ করতেন। সকাল-সন্ধা মানুষের ইসলামিক সেন্টারে এসে তার কথা শুনত। পথে বাজারে, স্কুল-কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলতে-ফিরতে তিনি ইসলামের দিকে মানুষকে ডাকতেন।’
সব মানুষের জন্য কল্যাণ কামনা: ‘রাতেরবেলা টোকিওর কেন্দ্রীয় মসজিদে তিনি মানুষকে নামাজের জন্য ডেকে আনতেন। কারো সঙ্গে তার কোনো বিরোধ-বৈরি মনোভাব ছিল না। সব মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে নিমগ্ন থাকতেন। সবার কাছে তিনি অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তি। তিনি কারো প্রতি অভিশাপ বা বদদোয়া করতেন না। বরং সবার জন্য কল্যাণের দোয়া করতেন। তিনি দোয়ায় বলতেন, ‘হে আল্লাহ, ইসলামের শত্রুদের হেদায়াত দিন। ইসলামের শত্রুদের বিদ্বেষকে উমর (রা.), খালিদ (রা.), ইকরামা (রা.)-এর মতো পরিবর্তন করে ইসলামের সহযোগী হিসেবে কবুল করুন।’
ভিয়েনার মদশালা থেকে ইসলামের পথে: মক্কার আন নুর মসজিদে দায়িত্ব পালনকালে এক লোক শায়খকে সালাম প্রদান করে তাঁর কপালে চুমু দেন। যেন শায়খ তার দীর্ঘদিনের পরিচিত। এরপর লোকটি হেসে বলল, শায়খ, আমি ওই তরুণদের একজন, যাদের আপনি অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার একটি মদের বারে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। আপনার কথা শুনে আমি জীবন পরিবর্তনের তাওবা করেছি এবং সব সময় আপনার জন্য দোয়া করেছি।
জার্মানির মদশালা থেকে ফেরার ঘটনা : ১৯৭৯ সালে শায়খ নেয়ামতুল্লাহ জার্মানির রাজধানী বার্লিনের একটি মসজিদ যান। তিনি স্থানীয় তুর্কিদের বাকি মুসলিমদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, আপনি আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। আমরা পুরো সময় আপনার কথা শুনব। কিন্তু বার বার জিজ্ঞেস করায় বাকিরা মদের বারে আছে বলে জানানো হলো।
শায়খ স্থানীয় একজনকে নিয়ে বারে যান। প্রায় ৪০ জন এর পরিচালনা করে। শায়খ সবাইকে উদ্দেশ্যকরে বললেন, ‘হে মুজাহিদগণ, আসসসালামু আলাইকুম।’ মুজাহিদ বলায় সবাই একে অপরের দিকে তাকাল। শায়খ বললেন, ‘আপনারা তিন কারণে মুজাহিদ।’
‘প্রথম কারণ : জার্মানিতে আপনারা ইসলামী নাম ধারণ করে চলাফেরা করেন। যা মানুষকে ইসলামের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। দ্বিতীয় কারণ : আপনারা নিজ পরিবারের রুজি-রোজগারের জন্য জার্মানিতে এসেছেন। এটাও জিহাদের অংশ। তৃতীয় কারণ : আপনাদের পূর্বপুরুষ উসমানীয়রা মুজাহিদ ছিলেন। আপনারা তাদের উত্তরসূরী।’
অতঃপর শায়খ বলেন, আমি মদিনা থেকে আপনাদের জন্য একটি সুসংবাদ নিয়ে এসেছি। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বলবে লা ইলাহা ইল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ এরপর তিনি তাদের ইসলামের পথে ফিরতে উৎসাহিত করে কোরআন ও হাদিসের অনেক কথা বলেন। ৪০ জনের সবাই ইসলামী অনুশাসন মেনে জীবন যাপন শুরু করেন।
তিন বছর পর শায়খ একদিন মসজিদে নববিতে বসা ছিলেন। পাগরি মাথায় এক তুর্কি এসে জিজ্ঞেস করল, শায়খ আপনি আমাকে চেনেন? তিনি বললেন, কেন চিনব না। তুমি হয়ত তুরস্কের বড় কোনো ইমাম বা আলেম হয়ে থাকবে! লোকটি বলল, শায়খ, হাজার বছর গেলেও আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি বার্লিনের মদের বারের শেষ ব্যক্তি।
নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মদশালা থেকে দুজন লোক আমাকে মসজিদে নিয়ে যায়। আপনি আমার মাথা স্পর্শ করে বলেছিলেন, ‘আপনার মূল্য আল্লাহর কাছে অনেক বেশি। তিনি আপনাকে তাঁর ঘরের জন্য কবুল করেছেন।’ আমি নেশাগ্রস্ত হলেও আপনার কথা বুঝতে পারি। এরপর নিজের জীবন পরিবর্তন করে নিয়মিত নামাজ আদায় শুরু করি। সস্ত্রীক ওমরাহ পালন করে ফের আপনার সান্নিধ্যে এসেছি। সূত্র: ইকনা
-এটি