মুনতাসির বিল্লাহ।।
তােমরা যখন 'ইনা' (সুদের একটি প্রকার) পদ্ধতিতে বেচাকেনা করবে, গরুর লেজ ধরবে (চতুষ্পদ জন্তু লালন করবে), চাষাবাদে সন্তুষ্ট থাকবে অর্থাৎ জিহাদের সময় দুনিয়ার কাজে ব্যস্ত থাকবে এবং জিহাদ ছেড়ে দেবে, তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তােমাদের ওপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেবেন। যতক্ষণ তােমরা দ্বীনের দিকে ফিরে না আসবে, ততক্ষণ আল্লাহ এই লাঞ্ছনা দূর করবেন না (সুনানু আবি দাউদ)
আল্লাহর রাসুলের কথা কখনো মিথ্যা হয় না, যার জলজ্যান্ত প্রমাণ পেয়েছিল বাগদাদবাসী। তৎকালীন যুগে বাগদাদ ছিল সব থেকে বড় শহর, সব থেকে সুরক্ষিত শহর এবং জ্ঞান অর্জনের শ্রেষ্ঠ শহর। পুরো পৃথিবী থেকে যেখানে জ্ঞান অর্জনের জন্য আসতো লাখো জ্ঞানপিপাসুরা। যাকে বলা হয় জ্ঞানের শহর ‘যেমনটা বর্তমান ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের শহর’ আলেম-উলামা, দরস-তাদরিসের জন্য পৃথিবীখ্যাত ছিল। ইলমের কোনো কমতি ছিল না যে শহরে, বলা হয় পৃথিবীর সব থেকে বড় পাঠাগার ছিল বাগদাদে, যেখানে কয়েক মিলিয়ন কিতাব ছিল। হিসাব করলে, তখন স্পেনে কর্ডোভায় একটা পাঠাগার ছিল, যার কিতাব সংখ্যা ছিল তিন মিলিয়ন। ইতিহাস বলে, স্পেনের কর্ডোভার পাঠাগার তুলনায় বাগদাদ পাঠাগারের কাছে কিছুই না।
ভেবে দেখুন, তখনকার সেই হস্তলিপির যুগে কত কিতাব সেখানে সংগ্রহ করা হয়েছিল। যেখানে কয়েক হাজার কর্মচারী ছিল বইয়ের দেখাশোনা করার জন্য। এক দল অনুবাদক ছিল, বিভিন্ন ভাষা থেকে আরবি ভাষায় অনুবাদের জন্য। এক দল কর্মচারী রাখা ছিল, যারা উঁচু জায়গা থেকে পাঠককে বই নামিয়ে দিতো। একেক বিষয়ের কিতাবের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রুম ছিল। দূরের জ্ঞানপিপাসুদের জন্য ছিল থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা।
এতো এলেম, আলেম, বুজুর্গ সে শহরের থাকা সত্ত্বেও তাদের শেষ পরিণতি হয়েছে, কুকুরের মতো মার খেয়ে তারা ইতিহাস থেকে মুছে গিয়েছিল তাতারবাহিনীর কাছে। ধরে নিয়ে ছাগলের মতো জবাই করা হয়েছিল তাদের। অপমান লাঞ্ছনায় মুখ থুবড়ে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল মুসলিম আমির-উমারারা।
এই অপমান-লাঞ্ছনার কারণ ইতিহাস যে সাক্ষী দেয়, সেটিই নবির হাদিস। তারা ফরজ বিধান জিহাদ ছেড়ে দিয়ে অন্য সব কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বাগদাদবাসী কৃষিকাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য, রচনা-সংকলন এবং বিভিন্ন শিল্পকর্ম ইত্যাদি করত। এমনকি ইলম অর্জন ও করত। কিন্তু নিজেদের দায়িত্বের কথা, খোদাপ্রদত্ত বিধানের কথা ভুলে গিয়েছিল। ভোগবিলাস আর অহংকারী হয়ে উঠেছিল। এর ফলে তাদের ভাগ্যে লাঞ্ছনারকর মৃত্যু হয়েছিল। তাতারবাহিনীর কাছে মার খেয়ে তাদের বিশ্বাস এমন স্থানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, তখন নিজেরা বলাবলি করত, অতি শীঘ্রই ইমাম মাহাদি আসবে তাতারবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের সাহায্যের জন্য। তারা ভাবতো তাতারবাহিনী অপরাজেয়..।
এভাবে তাদের ইমান এমন স্থানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, তাতারবাহিনীর নাম শুনেই তারা অত্মসমর্পন করত। শহরের চাবি প্রতিনিধি পাঠিয়ে হালাকুখানের হাতে দিয়ে আসতো। বিপুলপরিমাণ সেনাবাহিনী এবং যোগ্য নেতা থাকা সত্ত্বেও ‘মুষ্টিমেয় যেসব মুজাহিদ তখনো জিহাদের পরে ছিল, তাদের আল্লাহ জান্নাত নসিব করুন’ তাদের ইমান দুর্বলতার কারণে পরাজয় মেনে নেই। ভোগবিলাসিতা, আর ক্ষমতার লোভ তাদের বীরত্বতাকে কাপুরুষতায় পরিণত করে।
এভাবে হালাকু খান একের পর এক ইসলামি রাষ্ট্রগুলো তছনছ করে দেয়। তার হাতেই দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয় ইসলামি খেলাফত। পরবর্তী সময়ে যদিও সাইফুদ্দিন কুতুয ও রুকনুদ্দিন বাইবার্সের হাতে হালাকু খানের পরাজয় হয়। তবুও তখনকার মুসলিমদের মুখে প্রসিদ্ধ হয়ে গিয়ছিল যে, হালাকু খান পরাজয়বরণ করেছেন এটা মিথ্যা কথা। যে এ কথা বলে, ধারণা করা হতো সে মিথ্যা বলছে।
অতীত মানুশকে শিক্ষা দেয়, আমরা সেই শিক্ষা না নিয়ে ‘ঢাকা মসজিদের শহর, মাদরাসার শহর, আলেম-ওলামাদের শহর’ বলে দায়িত্ব আর বিধান ভুলে গিয়ে অন্য ইবাদতে মগ্ন হয়ে গা এড়িয়ে চললে আমাদের পরিণতিও এর থেকে ভালো হবে না। যতক্ষণ না দ্বীনের পথে ফিরে আসব।
-কেএল