বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :

নবীন আলেমদের উদ্দেশ্যে যে নসিহত করলেন আল্লামা বাবুনগরী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

জুনাইদ আহমদ: এশিয়া বিখ্যাত প্রাচীনতম দ্বীনি শিক্ষাপীঠ আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ে হাদীসের সর্বোচ্চ বিশুদ্ধ কিতাব বুখারী শরীফের আখেরী সবক (সমাপনী পাঠদান) করেছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর, হাটহাজারী মাদরাসার শায়খুল হাদীস ও শিক্ষা পরিচালক আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী।
কোন ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই গতকাল ৮ ই মার্চ বাদ ইশা এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাদীসের দরসগাহ দারুল উলুম হাটহাজারীর দাওরায়ে হাদীস মিলনায়তনে (মাস্টার্স সমাপনী) দুই সহস্রাধিক নবীন আলেমকে বুখারী শরীফের শেষ সবকের পাঠদান ও যুগোপযোগী মূল্যবান নসিহত করেন তিনি।

বাদ ইশা হাদীসের মূল পাঠ শেষে সংক্ষিপ্ত আকারে সাহাবা যুগ থেকে শুরু করে সর্বযুগে হাদীস সংরক্ষণের ইতিহাস এবং উপমহাদেশে দরসে হাদীসের ইতিহাস তুলে ধরেন আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী।

হাদীসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানবজাতির কল্যাণ ও হেদায়াতের শাশ্বত ধর্ম ইসলাম কুরআন মাজীদ ও হাদিসে রাসুলের সমন্বয়ে। আল্লাহর কালাম পবিত্র কুরআন মাজীদের ব্যখ্যায় হাদিসে রাসূলের গুরুত্ব অপরিসীম। হাদিসে রাসূল ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ ৷ শুধু কুরআন দ্বারা ইসলামের যাবতীয় বিধিবিধান বুঝা সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআন বুঝতে হাদীসের প্রয়োজন। আরবী ভাষাভাষি সাহাবায়ে কেরামগণও পবিত্র কুরআনের সংক্ষিপ্ত রূপ বুঝতে হাদীসের সহযোগিতা নিয়েছেন।

আল্লামা বাবুনগরী বোখারী শরীফের গ্রন্থকার ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল আল বোখারী রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী ও বোখারী শরীফের গ্রহণযোগ্যতা উল্লেখ করে বোখারী শরীফের প্রথম কিতাব এবং শেষ কিতাব, প্রথম অধ্যায় ও শেষ অধ্যায়, প্রথম হাদীস, শেষ হাদীস, উভয় হাদীসের সনদ পরস্পরা ও রাবী বা বর্ণণাকারীর সামঞ্জস্যতা তুলে ধরেন।

দাওরায়ে হাদিসের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে আল্লামা বাবুনগরী বলেন, আপনারা দেশ ও জাতির কল্যাণে মুসলিম উম্মাহর ঈমান রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করবেন। বাতিলের মোকাবেলায় হকের আওয়াজ বুলন্দ রাখবেন। এবং বাতিলের সাথে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোনোভাবে আপোষ করবেন না। আপনারা কারা, আপনাদের দায়িত্ব আর কর্তব্য কী? এটা আপনাদের খুব ভালো করে বুঝতে হবে। আপনাদের সম্পর্ক অনেক উপরে। দারুল উলূম হাটহাজারী, দারুল উলূম দেওবন্দের সম্পর্ক রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিষ্ঠিত মক্কার দারে আরকাম আর মদীনার দারুসসুফফার সাথে। সে হিসেবে আপনাদের মূল শিকড় গেঁথে আছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে। আপনাদের ইতিহাস সোনালী ইতিহাস। আপনাদের পূর্বসূরিতে সাহাবায়ে কেরামের মোবারক জামাত রয়েছে। আরো রয়েছে তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন, আয়িম্মায়ে মুজতাহেদীন, ছালফে সালেহীন, মুহাদ্দিসীন এবং আকাবিরে দেওবন্দ ও আকাবিরে হাটহাজারির মকবুল জামাত। এসব সম্পর্ক আপনাদের সাথে থাকায় আপনাদের উপর এক মহান জিম্মাদারি অর্পিত হয়েছে।

হে আমার প্রিয় বিদায়ী ছাত্র ভাইয়েরা! ইসলাম, মুসলমান, দেশ ও জাতীর ক্লান্তিলগ্নে উম্মুল মাদারিস হাটহাজারী থেকে আপনারা আজ বিদায় নিতে যাচ্ছেন। মনে রাখবেন! জাতি চাতক পাখির ন্যায় আপনাদের অপেক্ষমান। সততা, ন্যায়নিষ্ঠা আর সাহসিকতার মাধ্যমে পিপাসিত ও তৃষ্ণার্ত এ জাতির যোগ্য নেতৃত্ব আপনাদেরই দিতে হবে। দিশেহারা এ জাতির ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সফলতার সঠিক পথ আপনাদেরই দেখাতে হবে।

আমার কলিজার টুকরা প্রিয় তালিবে ইলম ভাইয়েরা! পড়ালেখার দীর্ঘ একটি অধ্যায় সমাপ্ত করে আজ আপনারা বিদায়ী কাফেলা। বিদায়লগ্নে অত্যন্ত ব্যথা-ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আপনাদের উদ্দেশ্যে কিছু নসিহত ও দিকনির্দেশনা পেশ করছি। আপনাদের বর্ণিল কর্মজীবনে এই নসিহত সমূহ পাথেয় এবং মাইলফলক হবে, ইনশাআল্লাহ!

✍️ জীবনের সর্বক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসরণ করতে হবে। আকিদা এবং আমল উভয় ক্ষেত্রে। কারো রক্তচক্ষু কিংবা কোনো রকম লোভ-লালসা যেন আপনাদের এই পথ থেকে ফেরাতে না পারে। এই জামাতে থাকলে দারুল উলূম হাটহাজারির সনদ আপনাদের জন্য হবে। এই জামাত থেকে বের হয়ে গেলে আমার বা আমাদের পক্ষ থেকে ইলমে হাদীস প্রচার করতে আপনাদের জন্য কোনো ইযাযত নেই। সম্পূর্ণ সনদ এবং ইযাযত বাতিল হয়ে যাবে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাসূল্লাহ সা. এবং সাহাবায়ে কেরামের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে। তবেই আপনারা কামিয়াব হবেন দুনিয়া ও আখেরাতে।

✍️ এহসান ও তাযকিয়া তথা আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে হবে। এর অপর নাম হচ্ছে তরীকত। বাহ্যিক ইলমের সাথে আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করতে হবে। উলামায়ে দেওবন্দ এবং উলামায়ে হাটহাজারির একহাতে আছে শরীয়তের পাত্র। অপর হাতে আছে তরীকতের ঝাণ্ডা। তারা উভয় হাতে এসবের ব্যবহার করতে পারেন। এক হাতে শরীয়তের পাত্র আঁকড়ে ধরে আছে। অপর হাতে তরীকতের ঝাণ্ডা উড়াচ্ছে। এটা ওলামায়ে দেওবন্দ, ওলামায়ে হাটহাজারীর বৈশিষ্ট্য। দেওয়ানবাগী-কুতুববাগী, আটরশী-ভাণ্ডারী- তারা তরীকতের ঝাণ্ডার আঘাতে শরীয়তের পাত্র ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। শরীয়ত ছাড়া যেহেতু তরীকত হয় না, তাই তাদের কাছে শরীয়ত তো নেই-ই, তরীকতও নেই। তারা গোমরাহ! তাই কোনো একজন খাঁটি সুন্নাতি পীরে কামেলের হাতে বায়’আত হয়ে অন্তরের বিশুদ্ধতা অর্জনের জন্য পথনির্দেশিকা নিবেন।

✍️ দুনিয়ার যশ-খ্যাতি পায়ের নিচে রাখতে হবে। জীবনের প্রতিটি কাজ একমাত্র আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে করতে হবে।

✍️ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরতে হবে। ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন এবং আন্তর্জাতিক জীবনে নবীজির সুন্নাতকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
✍️ ফিরাকে বাতিলা তথা ভ্রান্ত জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বয়ান বক্তৃতা, লিখনীসহ সমূহ পদ্ধতিতে তাদের মোকাবেলা করতে হবে। বর্তমানে সবচে নিকৃষ্ট এবং ঘৃণিত ভ্রান্তদল হচ্ছে নাস্তিক্যবাদী সম্প্রদায়। তাদের প্রতিরোধে দুর্বার সংগ্রাম করতে হবে। তাদের প্রতিরোধ করার জন্য তাদের রচিত বইপুস্তক অধ্যয়ন করে ক্রুটিবিচ্যুতিগুলো খোঁজে বের করে দলিল ভিত্তিক এর সমূচিত জবাব দিতে হবে।

✍️ আপনারা মাদরাসার লাইনে খেদমত করবেন। দরস তাদরীস এটা হলো আপনাদের মূলকাজ। কারণ, বর্তমানে দরস ও তাদরীসের লাইনে যোগ্য আলেমের বড়ই অভাব। আপনাদের এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। নিজেদের এলাকায় কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করবেন। কওমি মাদরাসার গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে একেকটি কওমি মাদরাসা ঈমান আকিদা ও ইসলাম রক্ষার মজবুত দূর্গ। যে কোনভাবে দ্বীনি খেদমতে লেগে থাকবেন। ছোট্ট একটা নূরানী মক্তব অথবা হেফযখানায় হলেও দ্বীনি খেদমতে লেগে থাকবেন। কোনো মাদরাসায় খেদমতে গেলে নিজ থেকে কোনো কিতাব পড়ানোর আগ্রহ দেখাবেন না। কারণ, এতে বরকত থাকে না। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ যে কিতাব আপনাদের পড়াতে দিবেন, সেগুলোর দরস দেবেন। এবং প্রতিটি সবক মুতালা’আ করে পড়াবেন। মুতালা’আ ছাড়া পড়াবেন না।

✍️ ইসলাম বিরোধী শিক্ষানীতির মাধ্যমে আজ মুসলমানদের ঈমান ছিনিয়ে নেওয়ার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র চলছে। শিক্ষা সিলেবাসে ডারউইনের বিবর্তনবাদ ঢুকিয়ে ঈমান আকিদা বিনষ্ট করা হচ্ছে। এসব শিক্ষা সিলেবাস পরিবর্তন করে ইসলামি শিক্ষা সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আপনারা নবীন আলেমদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

✍️ দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করবেন। দাওয়াত ও তাবলীগের কাজের নেতৃত্ব আপনাদের দিতে হবে। বর্তমানে এই মেহনতে উলামায়ে কেরামের কমতি থাকায় সাধারণ মানুষ সহীহ দ্বীনের জ্ঞান কম পাচ্ছে। তাই এ কাজে আপনাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

✍️ আজকের যুগে মিডিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। মিডিয়া জগতে আজ নাস্তিক্যবাদী অপশক্তির আগ্রাসন। তাদের এই আস্ফালন রুখতে হবে। এজন্য আপনাদের শক্ত হাতে কলম ধরতে হবে। বর্তমান ইয়াহুদিবাদী মিডিয়ার মোকাবেলায় নিজেদের শক্তিশালী ইসলামি মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আজকের যুগে মিডিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।

✍️ সঠিক ইসলামি রাজনীতি করবেন। এটাও ইসলামের একটি শাখা। বর্তমানে নোংরা রাজনীতির চর্চা হচ্ছে। বর্তমানে রাজনীতি ইসলাম থেকে অনেক দূরে। তাই এগুলো রাজনীতি নয়, সন্ত্রাসবাদি কর্মকাণ্ডের ইন্ধনদাতা হয়ে গেছে বর্তমানের অপরাজনীতি। আপনারা সঠিক ইসলামী রাজনীতিও করবেন, যেন সমাজ থেকে সন্ত্রাসবাদ দূরীভূত হয়ে যায়।

✍️ যদি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তাহলে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ করবেন। জিহাদ সন্ত্রাস নয় আর সন্ত্রাস জিহাদ নয়। জিহাদ হচ্ছে সন্ত্রাস দমনের মাধ্যম। আজ সর্বত্র জিহাদের অপব্যাখ্যা করে মুসলমানদের সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদী সাজানোর অপচেষ্টা চলছে। জিহাদের অপব্যাখ্যা বন্ধে আপনাদের ভূমিকা রাখতে হবে, জিহাদের সঠিক ব্যখ্যা জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে।

এমডব্লিউ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ