তোফায়েল গাজালি।।
মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের ৬ দফা দাবির পক্ষে আলেম ওলামা ও সর্বসাধারণ মানুষের সমর্থন আদায়ের জন্য চষে বেড়িয়েছেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। মুক্তিযুদ্ধের সংকটকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সকাল হতো মাওলানার তেলাওয়াতে। রেডিও পাকিস্তান থেকে প্রচারিত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সব ষড়যন্ত্রের সমোচিত জবাব দিতেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বসে।
তিনি বঙ্গবন্ধুর একান্ত আস্থাভাজন হিসেবে সব মহলে ছিলেন ব্যাপক পরিচিত। ফলে ৭ মার্চের ভাষণের আগে বঙ্গবন্ধুর আদেশেই তিনি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন। মুক্তিযুদ্ধে আলেমদের অবদনা জানতে সম্প্রতি হাজির হয়েছিলাম মাওলানার শ্যামলীর বাসভবনে। দু’ঘণ্টার বেশি সময় ধরে দীর্ঘ আলাপচারিতার চুম্বকাংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হল।
মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন- মাওলানা! আপনি যেহেতু ৬ দফা সমর্থন করেন তাহলে আলেম সমাজকে নিয়ে এর পক্ষে অগ্রসর হওয়া যায় না! আমি বললাম অবশ্যই যাবে। তখন আলেমরা ৬ দফার বিরোধিতা করেছিলেন।
আমি ৬ দফার পক্ষে জনমত তৈরির জন্য মাওলানা অলিউর রহমানের কাছে গেলাম। তাকে বললাম, চাচা ৬ দফায় কি ইসলামবিরোধী কিছু আছে? তিনি ৬ দফা পড়ে বললেন, এখানে ইসলামবিরোধী কিছু নেই। মাওলানা অলিউর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসায় এলাম, বঙ্গবন্ধু তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। তাকে নিয়ে আওয়ামী ওলামা পার্টি করলাম।
সঙ্গে ছিলেন নোয়াখালীর মাওলানা রুহুল আমিন, মাওলানা খাইরুল ইসলাম যশোরী ও মাওলানা বেলায়াত। সংগঠনের পক্ষ থেকে মাওলানা অলিউর রহমানের লেখা ‘শরিয়তের দৃষ্টিতে ছয়দফা’ বই বের করলাম। দেশব্যাপী প্রচার করতে শুরু করলাম। সারা দেশে ব্যাপক সাড়া পড়ল। এভাবে আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা অব্যাহত রাখলাম।
২৫ মার্চ রাতের ঘটনা। রাতে আওয়ামী লীগের অফিসে ছিলাম। আমি বেশিরভাগ সময় আওয়ামী লীগের অফিসে থাকতাম। বঙ্গবন্ধু আমার জন্য অফিসে থকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। গভীর রাতে চারদিক থেকে গুলির আওয়াজ আসছিল। ভাগ্য ভালো সে দিন রাতে পাকবাহিনী আওয়ামী লীগের অফিসে আক্রমণ করেনি।
সকাল সাড়ে আটটার দিকে পার্টি অফিসের কাছে নূরুর হোটেলে নাস্তা করতে গেলাম। পরোটা খেতে খেতে খবর শুনছিলাম- আকাশ বাণীর খবর পড়ছিলেন দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম শিরোনাম ছিল- ‘পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঢাকা শহরে রাস্তায় রাস্তায় হামলা চলছে।’
এমন সময় পাকবাহিনী হোটেলের দরজায় বন্দুক দিয়ে জোরে আঘাত করে বলল- ‘নিকলো শুয়োর কে বাচ্চে’। আমি পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে লেবার পার্টির অফিসের টয়লেটে ঢুকলাম। ২ ঘণ্টা পর অফিসের পিয়ন ওয়াহাব এসে বলল, হুজুর আপনার সব কিছু পাক সেনারা পুড়িয়ে দিয়েছে।
সেখান থেকে কমলাপুর জালালাবাদ বোডিংয়ে উঠলাম। দুই দিন থেকে চলে গেলাম মাওলানা অলিউর রহমানের কাছে। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বহু কষ্টে আমার গ্রামের বাড়ি সিলেটে এলাম। বাড়িতে আসার পর আত্মীয়স্বজনরা বলল বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না।
রাতে এক মসজিদে ঘুমিয়ে ভোরবেলা বড় ভাই মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদীকে সঙ্গে নিয়ে ডাউকি সীমান্ত দিয়ে শিলং পৌঁছলাম। বিএসএফ বাবু অক্ষয় কুমার দাস আমাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে যাওয়ার পর মুক্তিবাহিনী গঠিত হল। ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে একটি বাসায় বসে আমরা বক্তব্য রেকর্ড করতাম। বিকালে টেপ রেকর্ড ভারতীয় বিএসএফরা নিয়ে রেডিওতে প্রচার করত। এ ভাবে ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে নিজেকে জড়িত রেখেছি।
আমি একজন আলেম মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায় অনেক আলেম মুক্তিযুদ্ধে বিরাট অবদান রেখে গেছেন। তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা দরকার।