ইয়াহইয়া বিন আবু বকর: যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় মানব নিধন ও ধ্বংসযজ্ঞের মহাতাণ্ডব চলছে। বিশ্বের সবচে বিধ্বস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হলো সিরিয়া। অবশ্য দেশটিকে বিশ্বের সবচে বড়ো ধ্বংসনগরী বলাই শ্রেয়। ২০১১ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝিতে স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে দেশটির জনগণ শান্তিমূলক বিক্ষোভ করার পর থেকেই জনগনের বিরুদ্ধে দমন, পীড়ন, হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা হয়। ফলে দেশটির নিপীড়িত জনগণ জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে বাধ্য হয়।
যেভাবে এই গৃহযুদ্ধের সূচনা: গৃহযুদ্ধের সূচনাটা জানতে হলে একটু পিছনের দিকে যেতে হয়। ১৯২৪ সালে সিরিয়া উসমানী খিলাফত থেকে আলাদা হওয়ার অল্পকিছু দিন পরেই ফ্রান্স সিরিয়া দখল করে নিয়েছিল। সিরিয়াতে সুন্নী ছিলো মোট জনসংখ্যার ৭৪ শতাংশ। শিয়া ১২শতাংশ। খ্রিস্টান ১০শতাংশ। কিন্তু বিস্ময়করভাবে দেশের সুন্নী জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে একেবারে সংখ্যালঘু শিয়া আলাবী সম্প্রদায়ের সাথে ফরাসীদের সখ্যতা গড়ে উঠে। তাদের দিয়েই তারা সিরিয়ার জাতীয় সেনাবাহিনী গঠন করে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন উচ্চ ও সরকারী পদে শিয়াদের নিয়ে আসে। পরবর্তীতে এদের হাতেই দেশের ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে ফরাসিরা চলে যায়। এরপর শিয়া সম্প্রদায় ক্ষমতায় চেপে বসে। আল আসাদ ১৯৭১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত শাসন করে মৃত্যুবরণ করার পর তার ছেলে বাশার আল আসাদ ক্ষমতায় আসে। ২০১৮ সালে তার ক্ষমতারোহণের দেড় যুগ পূর্ণ হয়েছে।
সে ক্ষমতায় আরোহণের পর থেকে নিয়ে তার বাপের মতো সুন্নি মুসলিমদের সর্বদা জুলুম নির্যাতনের মাধ্যমে কোনঠাসা করে রাখতো। তার এই জুলুম থেকে মুক্তি পেতেই ২০১১ সালে মার্চের মাঝামাঝিতে সিরিয়ার মানুষ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করে। কিন্ত বাশার আলআসাদ নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে ট্যাংক বাহিনী পাঠিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেদিন থেকেই ভয়াবহ এই গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। তবে নিপীড়িত জনগণ ও আসাদ বাহিনী ত্যাগ করা সু্ন্নি যোদ্ধারা জুলুমের বিরুদ্ধে মজবুতভাবে রুখে দাড়ায়। ফলে মাত্র কয়েকবছরের মধ্যে তারা দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ দখলে নিয়ে ফেলেছিলো। কিন্ত পরবর্তীতে রাশিয়া এসে এ যুদ্ধের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়, ফলে এ যুদ্ধ ভয়াবহ রুপ নেয়।
রাশিয়া, ইরান ও লেবাননের সামরিক শিয়াগোষ্ঠী হিজবুল্লার সহযোগিতায় বাশার আল আসাদ বিজিত অঞ্চলগুলো একে একে প্রায় সব পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। আর তখন থেকে জনগনের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে নৃসংসতা, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের লোমহর্ষক এক নতুন ইতিহাসের সূচনা হয়।
আলজাজিরার তথ্যানুসারে অভিশপ্ত এই যুদ্ধের শুরু থেকে নিয়ে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫লাখ ৮৪ হাজার লোক নিহত হয়েছে ৷ পঙ্গু হয়েছে ২০ লাখের বেশি। স্বামী হারিয়েছে লক্ষাধিক নারী ৷ ফলে তারা জীবন বাঁচাতে এক লুকমা আহারের জন্য হাড়ভাঙ্গা মেহনত করছে। বাধ্য হয়েছে শ্রমবাজারে নামতে। অধিকাংশ মানুষই মানবিক সহায়তার উপর নির্ভর হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ দশ বছরের যুদ্ধে স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের ধ্বংসাত্বক তাণ্ডবলীলায় ভিটা বাড়ি হারিয়ে লক্ষ লক্ষ পরিবার একটু নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে। ১২ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগছে। জীবন বাঁচাতে এক লুকমা আহারের জন্য তারা হন্যে হয়ে ফিরছে।
আরবী সংবাদপত্র আশ শারকুল আওসাতের তথ্যানুসারে বাশার আল আসাদ ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক লোক ও নারী শিশুদের নির্বিচারে হত্যার টার্গেট বানিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ এবং কলকারখানাগুলোর উপর টনকে টন বোমা মেরে মানুসসহ সেগুলোকে ধ্বংসস্তুুপে পরিণত করেছে। ফলে লাশ উদ্ধার করতে না পারায় সকল নিহতের সংখ্যা গননা সম্ভব হয়নি। নিহতের সংখ্যা ৫ লাখেরও বেশি হবে বলে ধারাণা করা হচ্ছে। এছাড়াও আল আসাদের কারাগারে নির্মম শাস্তিতে প্রাণ হারিয়েছে ৮৮ হাজারের চেয়ে বেশি মানুষ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস এবং মানবিক সহায়তা ও আর্থিক সংকটের কারণে সিরিয়ার বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোর সকল শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে কাজে নামতে বাধ্য হয়েছে।
গত শনিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) জাতিসংঘের ইউনিসেফ ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম ঘোষণা করে যে, যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় ২০২০ সালে ১২ মিলিয়ন ৪০ হাজার মানুষ ক্ষুধা নিবারণ পরিমাণ খাদ্য পায়নি। সম্প্রতি বছরে এই সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে সেখানে ৬০ শতাংশ মানুষ অনাহার ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
প্রায় দশ বছর ধরে চলমান যুদ্ধে অর্থনৈতিক ধ্বসের কারণে খাদ্যদ্রব্যর মূল্য উর্ধগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালের শুরু থেকেই দেশজুড়ে খাদ্যমূল্য যুদ্ধের পাঁচ বছর আগের তুলনায় ৩৩ গুণ বেশি বলে জানিয়েছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা।
জাতিসংঘের আনুমানিক একটা পরিসংখ্যান অনুযায়ী সিরিয়াতে যুদ্ধের শুরু থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত ক্ষেত খামার ও মানবিক ক্ষয়ক্ষতি বাদে শুধুমাত্র ভবন বিধ্বস্তেই ৪০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে৷ দেশটির ৬০ শতাংশ বাসিন্দা গৃহচ্যুত হয়েছে৷
জাতিসংঘের খাদ্যসংস্থার মুখপাত্র ‘জেসিকা লসন’ জানায়, সিরিয়ায় আগের চেয়ে ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হার তীব্র গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিষ ও তাদের নাগালের বাইরে। চলমান সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড ও ধংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, এবং এভাবে আর কয়েকবছর মানব নিধন ও ধ্বংসযজ্ঞ যদি চলতে থাকে, তবে দেশটি জনশূন্য হয়ে পড়বে বলে আশংকা করা হচ্ছে। অবশ্য জাতিসংঘ চাইলে মাত্র এক মিনিটেই দীর্ঘ এই যুদ্ধের ইতি টানতে পারে। তবে সে এটা করবেনা। তথ্যসূত্র: আলজাজিরা, আশ শারকুল আওসাত এবং আল আরাবিয়া নেট৷
এমডব্লিউ/