কয়েকশ’ বছর ধরে জাতির খেদমত করছে দীনি শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান কওমি মাদরাসা। স্বাধীনতা, দেশ ও দশের জন্য কওমিয়ানদের অবদান অনস্বীকার্য। তাইতো তারা জায়গা করে নিয়েছে মানুষের হৃদয়ে। হৃদয়ের গহীনে। এসব কারণে যখন কওমির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হয়; তা আঘাত করে ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রাণে। সম্প্রতি বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কায়সার আহমেদ গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কওমি মাদরাসার বিষয়ে কিছু কথা বলেন; যা ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে আপত্তিকর। তাই তার কথাগুলোর বাস্তবতা কতটুকু তা খতিয়ে দেখতে আওয়ার ইসলামের সাব-এডিটর কাউসার লাবীব কথা বলেছেন প্রথিতযশা আলেমেদ্বীন, লেখক, সাংবাদিক মাওলানা ওবায়দুর রহমান খান নদভীর সঙ্গে।
বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কায়সার আহমেদ বলেন, ‘কওমি মাদরাসায় কী পড়ানো হয় তা ঠিকভাবে প্রকাশ করা হয় না।’ এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
তিনি কী বলতে গিয়ে কী বলেছেন সেটা তাকে জিজ্ঞেস করা উচিত। তিনি একটি বোর্ডের চেয়ারম্যান। আমি বিশ্বাস করি না যে, তার মতো একজন লোক এমন কথা বলতে পারেন। তবে যদি তিনি বলে থাকেন তাহলে আমি বলব, কওমি মাদরাসায় কী পড়ানো হয় তা প্রকাশ করা হয় না বিষয়টি এমন নয়। বরং আমি বলব তিনি কওমি মাদরাসার সিলেবাস কিংবা শিক্ষা বিষয়ে অজ্ঞ। না হয় এমন কথা তিনি বলতেন না।
আসলে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কী পড়ানো হয় তা প্রকাশিত নাকি অপ্রকাশিত? গোপনীয় নাকি সবার সামনে উন্মোচিত? এ বিষয়টি কিভাবে নির্ধারণ করা হবে? সেটি তিনি যদি নির্ধারণ করে দিতেন তাহলে ভালো হতো। বুয়েটে কেউ গিয়ে যদি বলে এখানে যা পড়ানো হয় তা গোপনীয়: সাধারণ মানুষ তা জানেনা। তাহলে তাকে সাধারণত অজ্ঞই বলতে হবে। এমনিভাবে কেউ যদি মেডিকেল কলেজে গিয়ে কথা বলে যে, এখানে কী পড়ানো হয় তা সাধারণ মানুষের কাছে সুস্পষ্ট নয়। এটাও একটি অজ্ঞের মত কথা।
আসলে একটি শিক্ষাসিলেবাসে কি পড়ানো হয় কি পড়ানো হয় না। সেটি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই জানা যায়। তবে সে বিষয়টি বুঝতে হলে অবশ্যই সে ধারা শিক্ষা সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। না হয় এমন কিছু কথা বেরিয়ে আসবে, যা অযাচিত।
তিনি বলেন, ‘কওমি মাদরাসায় পড়ে যখন কেউ চাকরি পায় না; তখন মানুষ আলিয়া ও কওমিকে গুলিয়ে ফেলে। ধারণা করে সামগ্রিকভাবেই মাদরাসায় পড়লে চাকরি পাওয়া না।’ তার এ মন্তব্যটি কতটুকু সত্য বলে মনে করেন?
এটা হতে পারে। কেননা সাধারণ মানুষের মাঝে অনেকেই এমন আছেন। যারা এখনো কওমি ও আলিয়ার পার্থক্যটা বুঝে উঠতে পারেননি। তারা মাদ্রাসা বললে সামগ্রিকভাবেই মাদ্রাসাকে বুঝে। সেখানে আলিয়া ও থাকতে পারে কওমিও থাকতে পারে। তাই তার কথার কিছু বাস্তবতা ও আছে বলে আমি মনে করি।
তবে কওমি ছাত্ররারা কোথাও বেকার আছে; এটা আমি বিশ্বাস করি না। তাছাড়া কওমির ছাত্ররা তো চাকরি খোঁজে না। বরং ২০/৩০ জনকে নিজেই চাকরি দেয়। অন্যকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়। নিজস্বভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। সরকারের বোঝা হয় না।
বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কায়সার আহমেদ আরো বলেন, ‘গণিত, ইংরেজি , বিজ্ঞান না পড়ার কারণে কওমির ছাত্ররা চাকরি পান না।’ আসলে কওমি মাদরাসার পড়ুয়ারা কত পার্সেন্ট বেকার বলে মনে করেন?
এটা একটা হাস্যকর কথা। গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞান পরেও কতজন চাকরি না পেয়ে পথে পথে ঘুরছে। জুতার তলা ক্ষয় করছে। বগলের নিচে ফাইল রাখতে রাখতে ঘা করে ফেলেছে। এমন অসংখ্য প্রমাণ আমার কাছে আছে। যারা বাংলা, ইংরেজি, গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান পড়ছে তারাইতো চাকরি পাচ্ছে না। তাহলে কওমি মাদ্রাসার বিষয়টি কেন আসবে!
তাছাড়া আলিয়া মাদরাসায় বাংলা, ইংরেজি, গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান- এসব বিষয়ে নিচের দিকে থাকলেও সেখানে এগুলো নিয়ে অনার্স, মাস্টার্স করার সুযোগ নেই৷ কোরআন, হাদিস, ফিকাহ- এসব বিষয়ের ওপর অনার্স- মাস্টার্স করানো হয়৷ বাস্তবতায় তো দেখা যাচ্ছে, তিনি যে বিষয় না থাকার কথা বলে চাকরির ক্ষেত্রে কওমিকে ছোট করে দেখলেন। উপরের পর্যায়ে গিয়ে তাদের কাছেও সেগুলো নেই।
আসলে একটি বিষয় আমাদের বুঝতে হবে, কওমি মাদরাসায় যারা পড়ে তারা উচ্চ গণিত তাদের কতটা দরকার। তারা ইমামতি করে; ইমামতিতে কি গণিত লাগে! বিজ্ঞান লাগে! ভূগোল লাগে! কওমির ছাত্ররা করছে, সে কাজের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছুই কওমি মাদ্রাসায় বিদ্যমান। বেশ ভালো ভালোভাবেই বিদ্যমান।
মানুষ যেখানে পড়ছে। যে বিষয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে স্পেশালিস্ট হবে এটাই স্বাভাবিক। যেমন আলিয়া প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা ইংরেজি গণিত পদার্থবিজ্ঞান থাকলেও, অনার্স করতে হয় কিন্তু কোরান, হাদিস, ফিকহ নিয়ে। এটাকে আমি আলিয়ার কমতি বলবো না। আসলে যেলোক যে অঙ্গনে আছে, সেটি নিয়ে ভালোবেসে ভালোভাবে কাজ করা উচিত।
বুয়েট থেকে ডাক্তার হওয়া আবশ্যক নয়। মেডিকেল কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ার বের হওয়া আবশ্যক নয়। তেমনিভাবে মাদরাসা থেকে গণিতবিদ, ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার এগুলো হওয়াও আবশ্যক বলে আমি মনে করি না।
আসলে একজন বোর্ডের চেয়ারম্যানের জানা থাকা উচিত তার কাজটা কি। তার তো এই কাজ নয় যে, বসে বসে আরেক বোর্ডের দোষ বের করবে। কিংবা মিডিয়ার সামনে এগুলো প্রকাশ করে তুললে। কওমির বিষয়ে তার জানার কমতি থাকলে, কওমির অঙ্গনে আসতে পারতেন। কারো সঙ্গে কথা বলে নিজের অজ্ঞতাকে দূর করতে পারতেন।
তবে তাদের মাদরাসায় পড়ে কত ছেলে চাকরি না পেয়ে পথে পথে ঘুরে সেটি সবার কাছে এখন স্পষ্ট। কওমি মাদরাসা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এটি ২শ’ বছরের বেশি সময় ধরে সরকারি কোন ফান্ড ছাড়া জনমানুষের সমর্থনে এগিয়ে চলছে। জনসাধারণ যদি মাদ্রাসা সম্পর্কে কিছুই না বুঝিতো। তাদের যদি কোনো উপকার না হত; তাহলে তারা ২শ’ বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রেখেছে কেন?
আমি বলবো, কওমি তো সরকারী সহযোগিতা ছাড়া ২শ’ বছর চলল। আলিয়া সরকারী সহযোগিতা ছাড়া পারলে দুইবছর চলে দেখাক আমাদের। দেখি তাদেরকে জনগণ টিকিয়ে রাখে কী না। তারা যে তা পারবে না সেটা আমরা সবাই জানি। আসলে এটা আমি তাদের কমতি মনে করব না। তারা চলছে এ ধারায়। তাই সবাই সবার ধারায় চলা উচিত। নিজেদের কাজ কে গতিশীল করা উচিত।
বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কায়সার আহমেদ বলেছেন, সামগ্রিকভাবে কওমি মাদরাসা আলিয়া মাদরাসা থেকে কতটা পিছিয়ে বলে আপনি মনে করেন?
কোন কোন বিষয়ে উনারা এগিয়ে, আবার কিছু কিছু বিষয় আমরা। দুটি বিষয়ের সমন্বয় করে চলতে পারলে ভালো। কে এগিয়ে কে পিছিয়ে এরকম প্রশ্ন না করে নিজেদের কাজে মনোযোগী হয়ে, কাজের গতি বাড়ানো উচিত।
তবে আমি একটা কথা বলবো। আমাদের দেশের জেনারেল শিক্ষা উন্নত বিশ্বের তুলনায় কোন অবস্থানে আছে সেটা আমাদের দেখা উচিত। যদি আমি বিশ্বের শিক্ষার তুলনায় আমাদের জেনারেল শিক্ষাকে দাঁড় করাই, তাহলে এর মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সবারই জানা। আর এক্ষেত্রে আলিয়া মাদ্রাসার অবস্থান কি তা সবার কাছেই স্পষ্ট। তাদের শিক্ষার মান নিয়ে আমার ভাঙ্গিয়ে কিছু বলতে হবেনা।
অন্যদিকে আমি কওমি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার কথা যদি বলি, বিশ্ব দরবারে কওমি মাদরাসা এদেশের জেনারেল শিক্ষার তুলনায় অনেক এগিয়ে। গত ২০/২৫ বছর ধরে আমরা বিশ্বসেরা হাফেজ তৈরি করছি। আমাদের ছেলেরা বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে পুরো বিশ্বের কাছে। আমাদের দেশের ছেলেরা পবিত্র কাবায়ও ইমামতি করার যোগ্যতা রাখে। ইলম এবং আমলের দিকে থেকে বিশ্বের তুলনায় আমরা পিছিয়ে নেই। আমাদের এখানে বিশ্বসেরা মুফতি তৈরি হচ্ছে। মুহাদ্দিস তৈরি হচ্ছে। ইমাম তৈরি হচ্ছে। মোহাদ্দিস তৈরি হচ্ছে। তাই কে এগিয়ে কে পিছিয়ে তা কাজে প্রমাণ করবে।
-এটি