কাউসার লাবীব
সাব-এডিটর
গতকাল বুধবার ভোরে সিলেট-বিয়ানীবাজার-জকিগঞ্জ সড়কের গোলাপগঞ্জ উপজেলার হেতিমগঞ্জে পশ্চিমবাজার মোল্লাগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ট্রাকের সাথে মাইক্রোবাসের ধাক্কায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় চার জন নিহত হন। নিহত চারজনের মধ্যে তিনজন মাইক্রোবাসের যাত্রী। অপরজন পথচারী শিশু।
প্রাথমিকভাবে সিলেটের গোলাপগঞ্জ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৪ জনের মধ্যে ৩ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা হলেন- জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার চারখাই ইউনিয়নের বারইগ্রামের মৃত কুনু মিয়ার ছেলে রাজন আহমদ (২২), একই গ্রামের আব্দুল জলিলের ছেলে ও দুর্ঘটনা কবলিত মাইক্রোবাসের চালক সুনাম আহমদ (২৬) এবং গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের রফিপুর গ্রামের মঞ্জু মিয়ার শিশু পুত্র হাসান আহমদ (৭)। কিন্তু অপর ব্যক্তি পুড়ে প্রায় কয়লা হয়ে যাওয়া বিকেল পর্যন্ত পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছিল না।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ভোরে গোলাপগঞ্জের হেতিমগঞ্জ পশ্চিম বাজার এলাকার মোল্লাগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন স্থানে একটি পণ্যবাহী ট্রাককে পেছন দিকে সজোরে ধাক্কা দেয় যাত্রীবাহী একটি মাইক্রোবাস। এতে মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন লেগে যায়। এতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান ৪ জন। মাইক্রোবাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে পাশ্ববর্তী কলোনিতে গিয়ে পড়লে শিশু হাসান মারা যায়। দুর্ঘটনার পরপর স্থানীয়রা ৯৯৯ এ কল দেন। খবর পেয়ে গোলাপগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস এসে মরদেহ উদ্ধার করে।
ঘটনাস্থলে থাকা গোলাপগঞ্জ মডেল থানার উপপরিদর্শক হেলাল উদ্দিন দুর্ঘটনায় ৪ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, নিহত ৪ জনের মধ্যে রাজন, সুনাম ও শিশু হাসানের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। অন্য একজনের পরিচয় এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তার পরিবার লাশ শনাক্ত করতে ওসমানী হাসপাতালে গেছেন।
দীর্ঘক্ষণ পর এ মৃতব্যক্তির পরিচয় মেলে। তিনি প্রথিত যশা তরুণ আলেম মুফতি রেজাউল করীম আবরার এর আপন চাচাতো ভাই মারজান (২০)। তিনি সিলেটের জামেয়া হাতিমিয়া হাফিজিয়া শিবগঞ্জ মাদ্রাসায় হেফজ শেষ করার পর পরিবারের হাল ধরতে বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ একটি হিফজুল কোরআন বিভাগে শিক্ষাকতা করছিলেন।
হাফেজ মারজানের মর্মান্তিক মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে মুফতি রেজাউল করীম আবরার তার নিজস্ব ফেসবুক একাউন্টে লিখেন, আমার চাচাতো ভাই মারজান সকালে ঢাকা থেকে সিলেট ফিরছিল। ভোরে থেমে থাকা মালবাহী ট্রাকের সাথে ধাক্কা খেয়ে তাকে বহনকারী গাড়িতে আগুন ধরে যায়। তার লাশ এমনভাবে পুড়েছে যে, এখন আর লাশ শনাক্ত করার কোন সূরত নেই।
চাচা এবং অন্যান্য আত্মীয়- স্বজনরা পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া অঙ্গার নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছেন। রাতেই তাকে দাফন করা হবে।
মুফতি রেজাউল করীম আবরার লিখেন, চাচার বড় ছেলে ছিল মারজান। বয়স হয়েছিল কুড়ি বছরের মতো। একেবারে সহজ সরল ছিল। অল্প বয়সেই আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আল্লাহ আমার স্নেহের ছোট ভাই মারজানকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন। চাচা, চাচিসহ সকলকে ধৈর্যধারণের তাওফিক দান করুন। মালিক, আমাদের প্রিয় মারজানকে আপনার হাওয়ালা করলাম। আপনি তার এবং তার পরিবারের অভিভাবক হয়ে যান।
চাচাতো ভাইয়ের মৃত্যুতে শোকে কাতর মুফতি রেজাউল করীম আবরার লিখেন, ছোট ভাই মারজানকে খুব মনে পড়ছে৷ নম্র, ভদ্র এবং খুব বিনয়ী ছিল৷ কুড়ি বছরের ছোট জীবনে কয়েকবার রমজানে মসজিদে এতেকাফও করেছিল৷ আজ মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল৷ সুরমা নদীর তীরে আমাদের গ্রামের নির্জন মাকবারায় তাকে দাফন করা হয়েছে এশার নামাজের পর৷ মারজানের শরীর এত বেশি পুড়েছিল যে, কাফন পরানো এবং গোসল করানোর সুযোগ ছিল না৷ কোনমতে কাফন দিয়ে ঢেকে তায়াম্মুম করিয়ে তাকে চির বিদায় জানানো হয়েছে৷ তার মৃত্যু পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছি সন্ধ্যার পর৷ তখন আর ফ্লাইটেও জানাজায় শরিক হওয়া সম্ভব না৷ মৃত্যুর হিম শীতল বাতাস কেন জানি বারবার আমাকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যার পর থেকে৷
শোকে কাতর মুফতি রেজাউল করীম আবরার আরো লিখেন, ঢাকার এক প্রান্ত থেকে মনটা বারবার গ্রামের বাড়িতে ছুটে যাচ্ছে৷ আমি দেখতে পাচ্ছি আমাদের চাচা মাওলানা মুখতার সাহেবের চোখের পানি এবং কলজেপোঁড়া আর্তনাদ৷ বড় ছেলে মাত্র সংসারের হাল ধরা শুরু করেছিল৷ নারায়ণগঞ্জে একটি হেফজখানায় সে খেদমত করত৷ গতকাল দুই মাসের বেতন পেয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়েছিল ৷ তার মা ভোর রাতে উঠে খাবার রান্না করে ছেলের অপেক্ষা করছিলেন। আহ! ছেলের অক্ষত লাশটাও দেখতে পারলেন না তারা।
সর্বশেষ তিনি লিখেন, নিজেকে খুব অসহায় লাগছে৷ ও দয়াময় মালিক! আমাদের মারজানকে আপনার হাওয়ালা করলাম৷ আপনি তাদের পরিবারকে উত্তম বদলা দান করুন৷ সকলকে ধৈর্যধারণের তাওফিক দান করুন৷