মাসউদুল কাদির
আমরা নানা কারণে লেখালেখি করে থাকি। কেউ কষ্ট পেলে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো লিখতে পারে। কবি নজরুল শত কষ্ট আর যাতনার মধ্যেও তিনি লিখতে পারতেন। কষ্টের কথা বলতে পারতেন কবিতায়, ছড়ায়, গল্পে। আবার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন জমিদার সন্তান। নিজেও জমিদারি করেছেন। বলা যায় তিনিও শান্তিতে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কষ্ট অতটা ছুঁয়ে যায়নি। কিন্তু তিনি দুই ভরে লিখতেন। তখনকার সামাজিক চিত্র দারুণভাবে উঠে এসেছে তার গল্পে, কবিতায়।
আমার দুঃখ কষ্টে থাকলে টেনশন থাকে। এই টেনশন কোনো কবিতার শিরোনাম দিতে পারি না। কোনো গল্পের শিরোনাম দিতে পারি না ‘যাতনা’ ‘কষ্ট’। অথচ লেখককে একই গল্পে দুটো জিনিসই তুলে আনতে হয়।
আমি নিজে কোনো দুঃখমনে সময় পার করলে কিছুই লিখতে পারি না। লেখা আসে না। এমন অনেকেই আছেন যারা লেখার জন্য একটা সময় খোঁজে বের করেন। এটা শোনেও আমার ভালো লাগে। আমি মাওলানা আমিনুল ইসলাম সাহেবর কথা জানি। তিনি দিনের একটা নির্ধারিত সময় লিখতেন। নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে লিখতেন। যা লিখে গেছেন তা আমাদের তরুণদের হিসাব কষতে অনেক কষ্ট হবে।
আমি এই চেষ্টাটা করলাম। দিনের একটা সময় নির্ধারণ করলাম, লিখবো। পারিনি। লেখা ওই সময়ে আর আসে না। হয়তো আগে আসে বা পরে। ওই সময় আমার হৃদয় থেকে আর প্রসব হয় না। নির্ধারিত সময়টা শুধুই পড়ে থাকে। কাজে লাগাতে পারি না।
আমরা জানি, কাজী নজরুল ইসলাম এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। শিশুবয়সে বাবা মারা যাওয়ায় তার অন্নবস্ত্রের যোগান দেয়াটা কঠিন হয়ে যায়। স্থানীয় এক মসজিদে মুয়াযযিন হিসেবেও কাজ করেন তিনি।
কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে ধারণা পান। এরপর সেনাবাহিনীতে কাজের সুযোগ আসে। এরপর ব্রিটিশ রাজত্বের বিরুদ্ধে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এরপরই তিনি রচনা করেন বিদ্রোহী কবিতা। পরে তিনি জেলে বন্দী হয়ে লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী। ভালোবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ কোনো কিছুই বাদ যায়নি তার লেখায়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ধনশালী অর্থবৈভবের চাকচিক্যময় একটা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আমার কাছে মনে হয়, তিনি সুখে থাকলেও তাকে ভূতে কিলায়নি। কারণ, তিনি লিখতে পেরিছিলেন। সুখের বাতিঘরে বসেও তার হাত থেকে প্রচুর পরিমাণ লেখা বেরিয়ে এসেছে।
তবে আমার কাছে মনে হয় তার জীবনের ছোটবেলার ভ্রমণ অনেক বেশি তাকে উৎসাহিত করেছে। সাহিত্য রচনায় তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাছাড়া সাধারণ মানুষের প্রকৃত অবস্থাটাও এই ভ্রমণের কারণে তিনি জানতে পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অথবা বোলপুর ও পানিহাটির বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন রবীন্দ্রনাথ। ওখান থেকে যে রবীন্দ্রনাথ খোরাক নিয়েছিলেন তা হলফ করেই বলা যায়।
আমরা এও জানি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭–১৯০৫) এবং মাতা ছিলেন সারদাসুন্দরী দেবী (১৮২৬–১৮৭৫)। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পিতামাতার চতুর্দশ সন্তান। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল ব্রাহ্ম আদিধর্ম মতবাদের প্রবক্তা। ১৮৭৫ সালে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের মা মারা যান।
পিতা দেবেন্দ্রনাথ দেশভ্রমণের উদ্দেশে বছরের অধিকাংশ সময় কলকাতার বাইরে কাটাতেন। তাই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হয়েও রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছিল ভৃত্যদের অনুশাসনে। শৈশবে রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন করে পড়াশোনা করেছিলেন। কিন্তু বিদ্যালয়-শিক্ষায় অনাগ্রহী হওয়ায় বাড়িতেই গৃহশিক্ষক রেখে তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
১৮৭৩ সালে এগারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কয়েক মাসের জন্য পিতার সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হন। প্রথমে তাঁরা আসেন শান্তিনিকেতনে। এরপর পাঞ্জাবের অমৃতসরে কিছুকাল কাটিয়ে শিখদের উপাসনা পদ্ধতি পরিদর্শন করেন। শেষে পুত্রকে নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ যান পাঞ্জাবেরই (অধুনা ভারতের হিমাচল প্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত) ডালহৌসি শৈলশহরের নিকট বক্রোটায়। এখানকার বক্রোটা বাংলোয় বসে রবীন্দ্রনাথ পিতার কাছ থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণ, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের নিয়মিত পাঠ নিতে শুরু করেন।
পথ চলতে চলতে রবীন্দ্র নাথ সত্যিকার অর্থেই জ্ঞানে ভাণ্ডার হয়ে ওঠেছিলেন। সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতেও লেখালেখিটা চালাতে পেরেছিলেন। এইটাই আমাদের হয়ে ওঠে না। হাতের কাজটাই কেবল চালিয়ে যাই। সেটা প্রকৃত লেখা হয়ে ওঠে না।
লেখক: সাংবাদিক ও ছড়াকার
-এএ