আবদুল্লাহ তামিম: হজের ইবাদত শরীরিক ও আর্থিক। তাই খুব সঠিকভাবে এ ইবাদত আদায় করতে সঠিকভাবে করতে হয়। হজই একমাত্র ইবাদত, যার নিয়ত করার সময়ই আল্লাহ তায়ালার কাছে সহজতা ও কবুলের দোয়া করা হয়।
অন্যান্য ইবাদত থেকে হজের আমলটি যে কঠিন তা এ থেকেই স্পষ্ট। তাই গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করতে অালোচনা করা হলো।
১. ইহরামের দুই রাকাত নামাযের জন্য এহরাম বিলম্বিত করা
এহরাম বাঁধার আগে দুই রাকাত নামায পড়ার নিয়ম আছে। তাই অনেককে দেখা যায়, এই দুই রাকাত নামাযের সুযোগ না পাওয়ার কারণে এহরাম বিলম্বিত করতে থাকেন। এমনকি এ নামায পড়তে না পারার কারণে কেউ কেউ এহরাম ছাড়াই মীকাতের ভেতরে পর্যন্ত চলে যান।
অথচ এহরাম ছাড়া মীকাত অতিক্রম করা জায়েয নয়। তারা যেহেতু ইহরামের আগে দুই রাকাত নামায আদায়কে জরুরি মনে করেন, তাই তারা এমনটি করে থাকেন। অথচ ইহরামের আগে নামায পড়া সকল মাযহাবেই মুস্তাহাব, জরুরি কিছু নয়।
পক্ষান্তরে এহরাম ছাড়া মীকাত অতিক্রম করা নাজায়েয। সুতরাং ইহরামের আগে নামাযের সুযোগ পেলে তো তা আদায় করা চাই। কিন্তু, সুযোগ না পেলে সে কারণে এহরাম বাঁধাকে বিলম্বিত করবেন না।
২. এহরাম বাঁধার নিয়ম সংক্রান্ত ভুলভ্রান্তি
অনেকে মনে করে থাকেন, ইহরামের কাপড় পরে নামায পড়ার পর নিয়ত করলেই এহরাম সম্পন্ন হয়ে যায়। এ ধারণা ভুল। এগুলো দ্বারা এহরাম সম্পন্ন হয় না।
নিয়ত আরবিতে করা হোক বা বাংলাতে, সশব্দে করা হোক বা মনে মনে এর দ্বারা এহরাম সম্পন্ন হয় না; বরং নিয়তের পর তালবিয়া পড়লে এহরাম পূর্ণ হয়। অতএব বোঝা গেল, এহরাম সম্পন্ন হয় দুই বসার সমন্বয়ে— ১. হজ বা উমরার নিয়ত করা ও ২. তালবিয়া পড়া।
৩. মক্কাগামীদের জন্য জেদ্দায় এহরাম বাঁধা
কেউ কেউ আগে থেকেই এহরাম বাঁধা ঝামেলা মনে করেন এবং ভাবেন যে, এহরাম বেঁধে নিলেই তো ইহরামের নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়ে যাবে। বিমান যেহেতু জেদ্দায় অবতরণ করবে, তাই জেদ্দায় এহরাম বাঁধার ইচ্ছায় এহরামকে বিলম্বিত করেন।
অথচ মীকাতের বাইরের হাজীদের জন্য এহরাম ব্যতীত মীকাত অতিক্রম করা জায়েয নেই। উপমহাদেশ থেকে গমনকারী হাজীদের জন্য মীকাত হলো কারনুল-মানাযিল ও যাতু ইরক যা অতিক্রম করেই জেদ্দায় যেতে হয়।
যদি কেউ বিনা ইহরামে মীকাত অতিক্রম করে তবে তার জন্য পুনরায় মীকাতে ফিরে এসে এহরাম বেঁধে যাওয়া জরুরি। যদি তা না করেন তবে দম ওয়াজিব হবে।
যেহেতু বিমানে থাকা অবস্থায় মীকাতের জায়গা নির্ধারণ করা কঠিন বা ওই সময় ঘুমিয়ে পড়া, অন্যমনষ্ক থাকা ইত্যাদি হতে পারে। তাই বিমানে চড়ার আগে কিংবা বিমানে উঠেই এহরাম বেঁধে নেয়ার কথা বলা হয়।
৪. সেলাইবিহীন কাপড় বা চপ্পলের জন্য এহরামে বিলম্ব
কেউ কেউ ইহরামের কাপড় না পরে বিমানে উঠে যান। অথবা মদিনা থেকে গাড়িতে উঠে পড়েন। এরপর যখন গাড়ি বা বিমানের মধ্যে পরিধানের কাপড় বদলিয়ে ইহরামের কাপড় পরা কষ্টকর হয় কিংবা কাপড় লাগেজে থেকে যায়।
তখন তারা সেলাইবিহীন কাপড় পরতে না পারার কারণে এহরাম বিলম্বিত করতে থাকেন। এমনকি এহরাম ছাড়া মীকাত অতিক্রম করে ফেলেন। ফলে দম ওয়াজিব হয়ে যায়।
অথচ মীকাত অতিক্রমের আগে সেলাইযুক্ত কাপড়ের অবস্থায়ই যদি এহরাম বেঁধে নিতেন এবং গাড়ি বা বিমান থেকে অবতরণের পরেই ইহরামের কাপড় পরে নিতেন, তবে তার অন্যায়টা দম ওয়াজিব হওয়ার মতো বড় হতো না।
এহরাম অবস্থায় এ কয়েক ঘণ্টা (১২ ঘণ্টার কম) সেলাই করা কাপড় পরে থাকার কারণে একটি পূর্ণ সদকা ফিতর আদায় করে দিলেই চলতো।
৫. ইহরামের কাপড় পরিবর্তন করা যাবে না
কেউ কেউ মনে করেন, যে কাপড়ে এহরাম বাঁধা হয়েছে, সে কাপড় হালাল (এহরাম শেষ) হওয়ার আগ পর্যন্ত বদলানো যাবে না। এটা একটা ভুল ধারণা। ওই কাপড় নাপাক না হলেও বদলানো যাবে।
৬. তাওয়াফের সময় ছাড়াও ইযতিবা করা
অনেককে দেখা যায়, ইহরামের প্রথম থেকেই ইযতিবা (বাম কাঁধের উপর চাদর রেখে ডান বগলের নিচ দিয়ে নিয়ে পরিধান করা) করে থাকে এবং হালাল হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থায় থাকাকে শরয়ী হুকুম মনে করেন। এটি ভুল।
এভাবে নামায পড়লে নামায মাকরূহ হবে। আবার কেউ কেউ তাওয়াফের সময় ইযতিবা করেন এবং এ অবস্থায় সায়ীও করে থাকেন এবং তাওয়াফের মতো সাঈতেও তা করা শরয়ী বিধান মনে করেন।
অথচ সাঈতে ইযতিবার বিধান নেই। এমনকি সকল তাওয়াফেও এটি সুন্নত নয় বরং যে তাওয়াফের পর সাঈ করতে হয় শুধু সেই তাওয়াফেই ইযতিবা করতে হয়। সুতরাং নফল তাওয়াফে ইযতিবা নেই। কেন না নফল তাওয়াফের পর সাঈ নেই।
৭. তামাত্তুকারীর একত্রে হজ ও উমরার ইহরামের নিয়তে তালবিয়া পড়া
কোনো কোনো তামাত্তু হজকারী প্রথমে এহরাম বাঁধার সময় একত্রে হজ ও উমরার নিয়ত করে ফেলেন। এ ভুলটি ব্যালটি হাজীদের ক্ষেত্রে বেশি হতে দেখা যায়। কেন না, তারা প্রায় নিজেরাই পরস্পর দেখাদেখি করে এহরাম বেঁধে থাকেন।
হজে-তামাত্তুর ক্ষেত্রে নিয়ম হলো, প্রথমে শুধু উমরার নিয়ত করবেন। বাইতুল্লাহ পৌঁছে উমরার কাজ সেরে হালাল হবেন। তারপর আবার হজের সময় হজের নিয়তে এহরাম বাঁধবেন।
৮. এহরাম অবস্থায় নারীদের চেহারা খোলা রাখা
এহরাম অবস্থায়ও নারীদের চেহারার পর্দা করা জরুরি। যেহেতু নারী-পুরুষ সকলের জন্যই এ অবস্থায় চেহারায় কাপড় লাগানো নিষেধ, তাই অনেক মহিলা মনে করেন, এহরাম বাঁধার পর চেহারা খোলা রাখতে হবে। চেহারার পর্দা করা যাবে না।
ফলে পর্দানশীন মা-বোনদের অনেককেই পুরো হজের সফরে এহরাম অবস্থায় চেহারা খুলে চলাফেরা করতে দেখা যায়। অথচ এ ধারণা ঠিক নয়।
চেহারায় কাপড়ের স্পর্শ ছাড়াও চেহারার পর্দা করা সম্ভব। এজন্য আজকাল ক্যাপ পাওয়া যায়, যা পরিধান করলে মুখের পর্দাও হয়ে যায়, আবার মুখে কাপড় না লাগানোর উপরও আমল হয়ে যায়।
প্রকাশ থাকে, ক্যাপের উপর দিয়ে নেকাব পরিধান করলে বাতাসে কিংবা চলাফেরার সময় অনেক ক্ষেত্রে নেকাবের কাপড় চেহারায় লেগে যায়।
এতে অনেকে বিব্রত হন যে, না জানি এহরাম পরিপন্থী হয়ে গেল কি না। কিন্তু, মাসআলা হলো, এত অল্প সময় লাগলে কোনো অসুবিধা হয় না। তাই এই পন্থা অবলম্বন করে হলেও চেহারার পর্দা করা জরুরি।
৯. এহরাম অবস্থায় বাইতুল্লাহ স্পর্শ করা
বাইতুল্লাহর দেয়ালে ও গিলাফে নিচ থেকে প্রায় ৭/৮ ফুট পরিমাণ চতুর্দিকেই সুগন্ধি লাগানো থাকে। তাই যে কোনো অংশে হাত লাগানোর মাধ্যমে সুগন্ধি লেগে যায়, যা এহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ।
মুমিন বান্দা যখন বিরাট ত্যাগ-তিতীক্ষার পর বাইতুল্লাহ শরিফের একেবারে নিকটে পৌঁছে যান, তখন আবেগের বশবর্তী হয়ে ইহরামের অবস্থার কথা ভুলে গিয়ে বাইতুল্লাহয় হাত লাগান, আলিঙ্গন করেন। ফলে এহরাম অবস্থায় অঙ্গ প্রত্যঙ্গে সুগন্ধি লেগে যায়।
তাই এহরাম অবস্থায় গিলাফে বা কাবা ঘরে হাত দিবেন না। এ সময় আবেগের বশবর্তী না হয়ে হুঁশকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। একটু সতর্ক হলেই এ বড় ভুল থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব।
১০. বাইতুল্লাহর যত্রতত্র চুম্বন, স্পর্শ ও আলিঙ্গন করা
অনেককে বাইতুল্লাহর কোনো স্থান ফাঁকা পেলেই গিলাফ ধরতে, দেয়ালে চুমু দিতে, সীনা লাগাতে ও স্পর্শ করতে দেখা যায়। অথচ বাইতুল্লাহর সব স্থান স্পর্শ করা বা চুমু খাওয়া ছওয়াবের কাজ নয়।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে কেবল সীমিত কিছু স্থান স্পর্শ করা আর কিছু ক্ষেত্রে চুমু খাওয়ার কথা বর্ণিত আছে।
যা নিম্নরূপ: ১.হাজরে আসওয়াদ। হাজরে আসওয়াদকে স্পর্শ করা, চুমু খাওয়া হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। ২. রুকনে ইয়ামানী। বাইতুল্লাহর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ হলো রুকনে ইয়ামানী।
এই কোণে ডান হাত বা উভয় হাত দ্বারা স্পর্শ করা সুন্নত। কেউ কেউ চুমু খাওয়ার কথাও বলেছেন। ৩. মুলতাজাম। এটি হাজরে আসওয়াদ থেকে বাইতুল্লাহর দরজা পর্যন্ত স্থান।
এখানে সীনা, গাল ও উভয় হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে দু’আ করার কথা হাদিসে বর্ণিত আছে। ৪. কাবাঘরের দরজার চৌকাঠ ধরা এবং দু’আ করা।
ধর্মীয় যে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করুন ইসলাম প্রতিদিন বিভাগে