মুহিব্বুল্লাহ মামুন
আওয়ার ইসলাম
প্রতি বছর রহমত, মাগফিরাত ও মুক্তির সুমহান বার্তা নিয়ে মুসলিম উম্মাহর মাঝে আগমন করে রমজান মাস। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর জন্যই পবিত্র রমজানের পুরো মাস সিয়াম পালন করা ফরজ। মাহে রমজানের মর্যাদাকে কাজে লাগিয়ে কদর রাত প্রাপ্তির সুনিশ্চিত প্রত্যাশায় সর্বোপরি মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভের জন্য রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফকে সুন্নাত করা হয়েছে।
শরিয়তের পরিভাষায় যেই মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাত সহকারে নিয়মিত আদায় করা হয় এমন মসজিদে মহান আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিয়ত সহকারে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং ইতিকাফ করেছেন এবং ইতিকাফ করার জন্য সাহাবাদেরকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘মসজিদ মুত্তাকিদের ঘর। যে ব্যক্তি ইবাদতের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করবে আল্লাহ তাঁর প্রতি শান্তি ও রহমত নাজিল করবেন এবং পুলসিরাত পার-পূর্বক বেহেশতে পৌঁছানোর জিম্মাদার হবেন’।
রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ সুন্নতে মুআক্কদায়ে কিফায়া। তথা পুরো এলাকার উপর সুন্নত। তবে একজন ব্যক্তিও তা আদায় করলে আদায় হয়ে যাবে। শেষ দশকের ইতিকাফে বসতে হলে বিশে রমজানের সূর্য অস্ত যাবার আগেই মসজিদে প্রবেশ করতে হবে।
যদি সূর্য ডুবার এক সেকেন্ড পরেও কেউ মসজিদে ইতিকাফের নিয়তে প্রবেশ করে, তবুও তার সুন্নত ইতিকাফ বাদ হয়ে গেল। কারণ তখন তার দশকের পূর্ণতা বাকি রইল না। এক সেকেন্ড কম হয়ে গেল।
সুতরাং, এ বিষয়ে খুব সতর্ক থাকা উচিত। আসরের পরই মসজিদে চলে যাওয়াই সবচে নিরাপদ। মাগরিবের পর, বা পরদিন ইতিকাফে বসলে তা নফল ইতিকাফ হবে। সুন্নত ইতিকাফ হবে না।
ইতিকাফ বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মাসআলা
১) ইতিকাফ আদায়কারী ব্যক্তির খাবার মসজিদে পৌঁছে দেওয়ার মতো কেউ না থাকলে খাবার আনার জন্য বাসায় যেতে পারবে। এ কারণে ইতিকাফ ভাঙবে না। তবে খাবার আনার জন্য মসজিদ থেকে বের হয়ে অন্য কোনো কাজে বিলম্ব করা যাবে না।
অন্য কাজে অল্প সময় ব্যয় করলেও ইতিকাফ ভেঙে যাবে। অবশ্য ঘটনাক্রমে খাবার প্রস্ত্তত না হলে সেজন্য অপেক্ষা করতে পারবে। (আলবাহরুর রায়েক ২/৩০৩; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৮০)
২) ইতিকাফরত ব্যক্তি পেশাব-পায়খানার জন্য মসজিদের বাইরে গেলে আসা যাওয়ার পথে পথ চলতে চলতে সালাম আদান-প্রদান করতে পারবে। তদ্রুপ এসময় পথ চলতে চলতে কারো সাথে অল্পস্বল্প কথাও বলতে পারবে। এতে ইতিকাফের ক্ষতি হবে না।
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনিবলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফ অবস্থায় চলতে চলতে রোগীর কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। কিন্তু এর জন্য রাস্তায় দাঁড়াতেন না। -(সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৭২)
তবে কারো সাথে কথা বলা বা কুশলাদি জিজ্ঞাসার জন্য মসজিদের বাইরে অল্প সময়ও দাঁড়ানো জায়েয হবে না। (-সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১২১)
৩) যদি মসজিদে কোনো ইস্তেঞ্জাখানার ব্যবস্থা না থাকে এমতাবস্থায় বাসায় এসে জরুরত সারা ছাড়া কোনো বিকল্প না থাকে তাহলে বাসা-বাড়িতে এসে ইস্তিঞ্জা সেরে মসজিদে এসে অজু করাতে ইতিকাফ ভঙ্গ হবে না। কেননা ইস্তেঞ্জার জরুরুতে মসজিদের বাইরে যাওয়া জায়েয।
আর মসজিদের ইস্তেঞ্জাখানা না থাকলে এজন্য বাসা-বাড়িতে যাওয়াও জায়েয। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফরত অবস্থায় ইস্তিঞ্জার প্রয়োজন ব্যতীত ঘরে প্রবেশ করতেন না। (-সহীহ বুখারী ১/২৭২; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১২)
৪) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফের জন্য কোনো লোক পাওয়া না যাওয়ায় মহল্লাবাসী সকলে মিলে একজন দিনমজুরকে যদি ঠিক করে যে সে ইতিকাফ করবে এবং তাকে এর বিনিময়ে ঐ দিনগুলোতে কাজ করলে যে পরিমাণ মজুরি সে পেত তাকে তা দেওয়া হবে। এ ধরনের বিনিময় নিয়ে ইতিকাফ করা বা করানো সম্পূর্ণ নাজায়েয হবে।কারণ ইতিকাফ একটি ইবাদত। আর ইবাদতের বিনিময় দেওয়া-নেওয়া নাজায়েয।
বিনিময় নিয়ে ইতিকাফ করা বা করানো সম্পূর্ণ নাজায়েয। কারণ ইতিকাফ একটি ইবাদত। আর ইবাদতের বিনিময় দেওয়া-নেওয়া নাজায়েয। (জামে তিরমিযী ১/৫১; বাদায়েউস সানায়ে ২/৪৪;)
৫) বুঝমান নাবালেগের ইতিকাফ সহীহ। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্য থেকেই ইতিকাফে বসা উচিত । কেননা রমযানের শেষ দশকের ইতিকাফ অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ ইবাদত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা গুরুত্ব সহকারে আদায় করতেন। তাই এ ব্যাপারে উদাসীনতা মোটেই ভালো নয়।(ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১১; রদ্দুল মুহতার ১/৫৭৭)
৬)পুরুষের ইতিকাফ সহীহ হওয়ার জন্য শরয়ী মসজিদ হওয়া জরুরি। নামায-ঘরে ইতিকাফ সহীহ হবে না। তাই ইতিকাফে বসতে চাইলে মসজিদেই বসতে হবে।
(সূরা বাকারা ১৮৭; সুনানে আবু দাউদ ৩৩৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১১)
৭) অস্থায়ী নামাযের ঘরে ইতিকাফ সহীহ হবে না। কেননা অস্থায়ী নামায ঘর ‘শরঈ মসজিদ’ নয়। ইতিকাফ সহীহ হওয়ার জন্য ‘শরঈ মসজিদ’ হওয়া জরুরি। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, “তোমরা মসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় তাদের (স্ত্রীদের) সাথে মিলিত হয়ো না”। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৭
ইমাম কুরতুবী রাহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, উক্ত আয়াতের আলোকে সকল ইমাম এ বিষয়ে একমত যে, মসজিদ ছাড়া অন্যস্থানে ইতিকাফ সহীহ হবে না।
-সূরা বাকারা (২) : ১৮৭; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৪৪২; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৪০
৮) জানাযার উদ্দেশ্যে মসজিদ থেকে বের হলেও ইতিকাফ থাকে না। তাই ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদের বাইরের জানাযার নামাযে শরিক হওয়া যাবে না। বের হলে সুন্নত ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৪৬৫; ফাতাওয়া খানিয়া ১/২২২
৯) যদি কোনো মহিলা নিজ ঘরেই সুন্নত ইতিককাফ শুরু করে এবং তিন দিন পর তার মাসিক শুরু হয়ে যায় তাহলে মাসিক শুরু হওয়ার কারণে তার ইতিকাফ ভেঙে যাবে। যে দিন মাসিক শুরু হয়েছে শুধু সেই একদিনের ইতিকাফ কাযা করে নেওয়া জরুরি।
এই এক দিন কাযা করার নিয়ম হল, একদিন সূর্যাস্তের আগে ইতিকাফ শুরু করতে হবে। পরবর্তী দিন রোযা থাকতে হবে। সূর্যাস্তের পর ইতিকাফ শেষ হবে। এভাবে একদিন রোযাসহ ইতিকাফ করলেই কাযা আদায় হয়ে যাবে। পুরো দশ দিনের ইতিকাফ কাযা করতে হবে না। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৭; ফাতাওয়া রহীমিয়া ৭/২৮৬
১০) মহিলাদের ইতিকাফ : মহিলারা ঘরের যে অংশে সাধারণত নামাজ পড়া হয় সেই রকম কোনো অংশকে ইতিকাফের জন্য নির্দিষ্ট করে দশ দিন কিংবা কম সময়ের জন্য ইতিকাফের নিয়ত করে সেই জায়গায় বসে ইবাদত বন্দেগি শুরু করবেন।
শরঈ কোনো ওজর ছাড়া সেখান থেকে উঠে অন্যত্র না যাওয়া। (রাতে সেখানেই ঘুমাবেন)। ইতিকাফ অবস্থায় যদি মহিলাদের মাসিক শুরু হয়ে যায় তাহলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন : সদকায়ে ফিতর সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ১০ মাসআলা