আতাউর রহমান খসরু
আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি আফগানিস্তানের সংবিধান সংশোধন করে হলেও তালেবানকে বৈধতা প্রদান এবং তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ ঘোষণা আফগানিস্তানের রাজনীতিতে ইতিবাচক সাড়া জাগিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলও আশান্বিত হয়েছেন।
গতকাল বুধবার কাবুলে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্যে আফগান প্রেসিডেন্ট দেশের রাজনৈতিক সংকট কাটাতে তার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে নতুন এ ঘোষণা দেন।
২৫ দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।সম্মেলনের লক্ষ্য শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া এবং তার জন্য গ্রহণযোগ্য রূপরেখা তৈরি করা।
আফগান প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্যে বলেন, আমাদের কাছে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাতীয় ঐক্যের সরকার কোনো প্রকার পূর্বশর্ত ছাড়াই তালেবানের সঙ্গে ফলপ্রসূ ও গ্রহণযোগ্য শান্তিচুক্তি সম্পাদন করতে চায়। সংবিধান সংশোধন করে এক নতুন শান্তি কাঠামো তৈরি করা হবে। যাতে তালেবানের সাথে শান্তিচুক্তি করা সম্ভব হয় এবং আফগান গৃহযুদ্ধ বন্ধ হয়।
তবে তিনি বলেছেন, তালেবানকে অবশ্যই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং জাতীয় ঐক্যের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবনার ব্যাখ্যা করে আশরাফ ঘানি বলেন, তিনি তালেবানকে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চান। যেনো তারা জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে।
একই সঙ্গে যথাযথ আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তালেবান বন্দীদের মুক্তি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় তালেবান যোদ্ধাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার বিষয়টিও শান্তিপ্রক্রিয়ার আইনী কাঠামোয় অন্তর্ভূক্ত হবে।
আশরাফ ঘানি পূর্বে তালেবানকে ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘বিদ্রোহী’ শব্দে সম্বোধন করলেও এবারের বক্তব্যে ‘বন্ধুভাবাপন্ন’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
আফগান প্রেসিডেন্ট জানান, তিনি আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলকেই আলোচনার ভেন্যু হিসেবে অগ্রাধিকার দিবেন। তবে তালেবান চাইলে যেকোনো মুসলিম রাষ্ট্রে আলোচনা হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, কাবুল অবশ্যই তালেবানের বিরুদ্ধে বলবৎ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, তাদের পাসপোর্ট ও ভিসা লাভের ব্যাপারে চেষ্টা করবে। যেনো তারা শান্তি আলোচনায় অংশ নিতে পারে।
বিশেষজ্ঞগণ তার এ প্রস্তাবে গুলবুদ্দিন হেকমেতিয়ারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। যার ফলে আফগানিস্তানের যুদ্ধবাজ এ নেতা চারদশক পর যুদ্ধ পরিহার করে সরকারে যোগ দেয়।
ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত তালেবানের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় নি।
তবে তালেবান একদিন আগে বলেছিলো তারা আফগান সরকারের সঙ্গে না হলেও ওয়াসিংটনের সঙ্গে বসতে প্রস্তুত। তালেবানের পক্ষ থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে এটি দ্বিতীয় শান্তিপ্রস্তাব।
আফগান প্রেসিডেন্ট ও তালেবান উভয় পক্ষের ঘোষণায় মূলত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আশান্বিত করছে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর তালেবানের উপর আক্রমণ তীব্র করে। অন্যদিকে তীব্র হামলার মধ্যেই তালেবান শহর এলাকায় ভয়াবহ আক্রমণে সক্ষমতার পরিচয় দেয়। এতে পরোক্ষভাবে হলেও কিছুটা নমনীয় হয়েছে ওয়াশিংটন।
রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকগণ মনে করছেন, মূলত মার্কিন সরকারই এখন আফগান যুদ্ধের পরিসমাপ্তি চাচ্ছে। আর তা তালেবানের সঙ্গে আপোষ-রফা ব্যতীত সম্ভব নয়।
অন্যদিকে তালেবানকে নির্মূল করেও এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি করাও যে সম্ভব নয় তা গত দুই দশকের যুদ্ধ থেকে টের পেয়েছে মার্কিন প্রশাসন ও তার মিত্ররা।
আফগানিস্তানে দীর্ঘদিনের নিষ্ফল যুদ্ধের পর সেখানে আর্থিক রক্তক্ষরণ বন্ধে চাপ তৈরি হয়েছে দেশগুলোর জনসাধারণের পক্ষ থেকে। সে চাপের প্রেক্ষিতেই তালেবানের সঙ্গে আপোষ চায় মার্কিনিরা।
তালেবানকে তাদের শ্রেণি শত্রু মনে করলেও পশ্চিমানির্ভর আফগান সরকার মার্কিন চাপেই তাদের সঙ্গে আপোষ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কারণ, পশ্চিমা শক্তি আফগানিস্তান ত্যাগ করলে তালেবানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ কোনো সমাধানে যাওয়া আরও কঠিন হবে।
এ প্রচেষ্টা মার্কিন নির্দেশের বাস্তবায়ন মাত্র জেনেই তালেবান আফগান সরকারের পরিবর্তে মার্কিন কর্তৃপক্ষ আলোচনার জন্য অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
দীর্ঘ মেয়াদি যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসার মার্কিন প্রচেষ্টা যতো জোরালোই হোক না কেনো তালেবানের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের মনোভব সত্যিকারে কতোটা পরিবর্তন হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আদৌ তালেবানের উপর বিদ্যমান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে কি না তাও বোঝা যাচ্ছে নয়।
অন্যদিকে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওয়াহেদ মোজদাহ তালেবানকে শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে আশরাফ ঘানির প্রস্তাবে নতুনত্ব খুঁজে পাচ্ছেন না।
তিনি বলেন, ‘আমি খুব মনোযোগ দিয়ে তার বক্তব্য শুনেছি। আমি তাতে নতুনত্ব বা তালেবানকে আলোচনায় আগ্রহী করবে এমন কিছু খুঁজে পাই নি।’
মোজদাহ আরও বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট নতুন শান্তি প্রস্তাবের নামে পুরাতন প্রস্তাবের পুনরাবৃত্তি করেছে। সরকার বলছে, পূর্ব শর্ত ছাড়াই তারা তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। অথচ তারা জাতীয় ঐক্যের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে বলছে। যা এক প্রকার পূর্বশর্ত।’
কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর নাজিব মাহমুদ মনে করেন, ‘প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্যে যুদ্ধ ও শান্তির মাঝে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছেন। তবে এজন্য জাতীয় ঐক্যের সরকারের সাথে আরও বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজন। কেননা তালেবান আরও শক্তিশালী হবে সরকার যদি বিভক্ত হয়ে যায়। তাই প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব হলো, তালেবানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার পূর্বে জাতীয় ঐক্যের সরকারে থাকা উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলীয় নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করে নেয়া।’
সম্প্রতি ইন্ডিয়া, পাকিস্তান ও তুর্কমিনিস্তারে সঙ্গে ১০ বিলিয়ন ডলারের গ্যাস পাইপলাইনের যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তাতে ইতিবাচক মনোভব দেখিয়েছে তালেবান। তারা বলেছে, তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে পাইপলাইনের নিরাপত্তা তারা দিবে।
তালেবানের এ ঘোষণাকে জাতীয় ঐক্য ও দেশের আর্থিক উন্নতির ব্যাপারে তাদের আগ্রহের কথাই জানান দেয়।
আশরাফ ঘানির প্রস্তাব ও তালেবানের জাতীয় ঐক্যে আগ্রহে আশার আলো দেখছে আফগানিস্তান যুদ্ধক্লান্ত জনসাধারণ। তাদের আশা হয়তো যুদ্ধ শেষে হয়তো শান্তি ফিরবে আফগানিস্তানের মাটিতে।
সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স, আরব নিউজ ও এএফপি