কাউসার লাবীব
প্রতিবেদক
প্রকৃত ইমানদার তো ওই সব লোক যাদের দিল আল্লাহর কথা শুনলে কেঁপে উঠে, যখন তাদের সামনে আল্লাহর আয়াত তেলাওয়াত করা হয়, তখন তাদের ইমান বেড়ে যায় এবং তাদের রবের ওপর ভরসা রাখে। [সুরা আনফাল : ২,৩]
কুরআনের ছোঁয়ায় আমরা হই মুগ্ধ ও বিমোহিত। কুরআনের সুরে ভেসে আমরা চলে যাই দূর আরবে। চোখের সামনে ভেসে আসে ৫৬৫ মিটার উপরের সেই গারে হেরার দৃশ্য। জাবালে নুরের পাথর খণ্ডের মায়াময়তার ঘ্রাণ।
যাদের সুরে ভর করে আমরা চলে যাই দূর আরবে তারা অনন্য তারা তুলনাহীন। তাদের ছুঁয়েছে পৃথিবীর সবটুকু নিরেট ভালবাসা। আর তারা ছুঁয়েছে মানুষের মন ও প্রাণ।
আজ আমরা আমাদের লালসবুজের এই ভুখণ্ডের এমন সাতজন কারির জীবনপাতা ছুঁয়ে আসব, যাদের সুরে ভর করে আমরা খুঁজে পাই বিমুগ্ধ লগন।হই প্রভুর প্রেমে মাতোয়ারা।
অবিভক্ত পাকিস্তানের একমাত্র স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কারি
অবিভক্ত পাকিস্তানের একমাত্র স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কারি শায়েখ ইউসুফ। তিনি প্রখ্যাত কারি, কারি বেলায়েত রহ.এর সতীর্থ। বাংলাদেশ বেতারে কুরআন তেলাওয়াতের অনুষ্ঠানগুলো এদের মাধ্যমেই শুরু হয়।
শায়েখ ইউসুফ ১৯৬২ সালে কেরাত তেলাওয়াতের জন্য প্রথম মালয়েশিয়া সফর করেন। এরপর থেকে তিনি প্রায় বহু দেশের শ্রোতাদের তার তেলাওয়াতে মুগ্ধ করেন।
তিনি বর্তমানে বিভিন্ন কেরাত প্রতিযোগিতায় বিচারকের আসন অলঙ্কৃত করে থাকেন। বাংলাদেশের অনেক আলোচিত কুরআনের খাদেম তার শিষ্য ও ছাত্র।
যার পরামর্শে রমজানে রেডিওতে কুরআন প্রচার
স্বাধীনতার পর মানুষের কাছে কুরআন পৌঁছে দেয়ার জন্য যে কয়জন হাফেজ আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে হাফেজ কারি মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হোসাইনের নাম উল্লেখযোগ্য।
কারি ওবায়দুল্লাহ ও কারি আবু ইউসুফের পর বাংলাদেশ বেতারে কারি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। তার পরামর্শেই বেতার কর্তৃপক্ষ মাহে রমজানে ইফতারির আগে হিফজুল কুরআন অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করেন।
প্রায় ১ যুগ এককভাবে খতমে কুরআন অনুষ্ঠানে তেলাওয়াত করার বিরল গৌরব অর্জন করেন কারি আবুল হোসাইন।
তেলাওয়াত শুনে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানকে স্কুল থেকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন।
কারি আবুল হোসাইন তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ মহুকমার আড়াই হাজার থানার দাশিরদিয়া মাদরাসায় হিফজ শেষ করেন। এরপর তিনি তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের সেরা হাফেজ খ্যাত হাফেজ আবদুর রব ও হাফেজ জামাল উদ্দিনের কাছে কেরাত শিখেন।
এরপর ঢাকায় হাফেজ্জী হুজুর রহ. প্রতিষ্ঠিত জামিয়া নূরীয়ায় হাফেজ্জী হুজুরের কাছে এবং লালাবাগ মাদরাসায় কারি খলিলুর রহমানের কাছে কেরাত শিখেন। পাশাপাশি তিনি বায়তুল মোকাররমের ইমাম থাকাকলীন তিন মাস ইরাকে উচ্চতর ক্বেরাত প্রশিক্ষণ নেন।
যার তেলাওয়াত বিশ্বেও সমাদৃত
দেশের প্রখ্যাত ও স্বনামধন্য কারি শায়েখ ইউসুফের ছেলে শায়েখ আহমদ বিন ইউসুফ আল আযহারী। বর্তমান বাংলাদেশের যেকয়জন কারি বিশ্ব দরাবারে লাল সবুজের পতাকাকে উজ্জ্বল করছেন করছেন তার মধ্যে তিনি অন্যতম।
খ্যাতিমান এ কারি কাতার, কুয়েত, মালয়েশিয়া, ইরান, মিসর, সৌদিআরবসহ বিশ্বের বহু দেশে তিনি তার কেরাতের সুর লহড়িতে কুরআন প্রেমিদের মুগ্ধ করে থাকেন।
কেরাত চর্চার ক্ষেত্রে দেশ ও বিদেশের কেরাত প্রশিক্ষকগণ শায়েখ আহমদ বিন ইউসুফের কেরাতকে পাথেয় হিসেবে নিয়ে থাকেন।
শায়েখ আহমদ বিন ইউসুফ মাআহাদুল কেরাত বাংলাদেশ নামে একটি কেরাত প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তুলেছেন। যার থেকে প্রতি বছর বহু কুরআনের খাদেম তৈরি হচ্ছে।
কুরআনের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন গ্রাম থেকে শহরে, গঞ্জ থেকে বন্দরে, দেশ থেকে বিদেশে।
কেরাতের অনন্য প্রতিভা
কারি সাইদুল ইসলাম আসাদ লেখাপড়া শুরু করেন ডেমরা বাইতুন নূর মাদরাসা থেকে। এরপর জামিয়া মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী থেকে তিনি দাওরায়ে হাদিস পাশ করেন।
তার কেরাতের হাতেখড়ি শায়খুল কুরআন কারি বেলায়েত রহ.এর হাতে। তিনি প্রায় বহুদিন শায়খুল কুরআনের সান্নিধ্যে থেকে কেরাত বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন।
কারি সাইদুল ইসলাম আসাদ একাধারে কারি, সঙ্গীত শিল্পী, বক্তা ও ওয়ায়েজ। কেরাতের পাশাপাশি তিনি সঙ্গীত ও ওয়াজের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে মানুষকে মুগ্ধ করে থাকেন।
বর্তমানে তিনি বেশ কয়েকটি মাদরাসায় শিক্ষতা করছেন। পাশাপাশি উত্তরা বায়তুল আমান জামে মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন।
চ্যানেলে যার কেরাতে প্রাণ জুড়ায়
বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ দেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলে তার কেরাত শুনে আমরা আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে থাকি। এছাড়াও তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মাহফিল ও জলসায় কুরআন তেলাওয়াত করে থাকেন।
কারি সাইফুল ইসলাম পারভেজের লেখাপড়ার হাতেখড়ি আল জামিয়া আল ইসলামিয়া ভবানীপুর ইসলামপুর মাদরাসা গোপালগঞ্জ থেকে। তিনি কেরাত বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন বাংলাদেশি বংশোভূত কাতারের ইমাম হাফেজ মাওলানা ইসমাইলের কাছে ।
তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম বাংলাদেশ নৌবাহিনী মসজিদে ইমামের দায়িত্ব পালন করছেন।
যার কণ্ঠের যাদু বুঝতে শেখায় কুরআনের মাহাত্ম
কারি তাওহিদ বিন লাহুরি মাহাদুল কেরাত ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে শায়েখ আহমদ বিন ইউসুফের কাছ থেকে কেরাতের দীক্ষা লাভ করেন। যার কণ্ঠের যাদু কুরআনের মাহাত্ম বুঝতে শেখায় কুরআনপ্রেমীদের।
তিনি বিভিন্ন জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে পুরুষ্কারলাভ করেন এবং মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায় ৮৯ জনের মধ্যে অষ্টম ও ইরান আন্তর্জাতিক ক্বিরাত প্রতিযোগিতায় ৫২দেশের ৫২জনের মধ্যে ৬ষ্ঠ স্থান অর্জন করনে।
বর্তমানে তিনি জামালুল কোরআন ক্বিরাত সেন্টারের পরিচালকের এবং মাদরাসাতুল কোরআন আল ইসলামিয়া ঢাকার ভাইস প্রিন্সিপালরে দায়িত্বে আছেন।
শিশুদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় শীর্ষে
কারি আবু রায়হান তার ভক্ত অঙ্গনে শিশুকারি হিসেবেই খ্যাত। তিনি হিফজ শেষ করে বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ আড়াইহাজারের একটি মাদরাসায় কেরাত তৃতীয় বর্ষ ও ইবতেদায়িতে পড়ছেন।
কারি আবু রায়হান ২০১৪ সালে বাংলাদেশ হুফফাজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় ২য়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সৌদি দুতাবাস কর্র্তৃক আয়োজিত কেরাত প্রতিযোগিতায় ২য়, বেসরকারি টিভি চ্যানেল Rtv আয়োজিত আলোকিত কুরআন ২০১৫ প্রতিযোগিতায় প্রথম এবং ২০১৬ সালে বৈশাখী টিভি আয়োজিত কেরাত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেন।
শিশু কারি আবু রায়হান বর্তমানে ইউটিউবে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। মাত্র সাত মাসে তার ইউটিউব চ্যানেলে প্রায় ২১ হাজার সাবস্ক্রাইব আসে। তার কোনো কোনো ভিডিও মিলিয়ন ভিউয়ারও দেখেছেন।