আতাউর রহমান খসরু: ওয়াজ হলো মানুষকে সদুপোদেশ দেয়া ও তাদের কল্যাণের পথে ডাকা। ইসলামের সূচনাকাল থেকে ওয়াজ সাধারণ মানুষের মাঝে ইসলাম ও ইসলামের বিধি-বিধান প্রচারের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নবী-রাসুল আ. সাধারণ মানুষকে সত্যের পথে যে আহবান জানাতেন তারই প্রচলিত একটি রূপ ওয়াজ।
নবীর উত্তরসূরী হিসেবে আলেমগণ; বিশেষত বুজুর্গ আলেমগণ যুগ যুগ ধরে ওয়াজ-নসিহত করছেন এবং তা ইসলামি শিক্ষা বিস্তারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষত ইসলামি শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা মুসলিম সমাজে ওয়াজ বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা সাধারণ শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত ও মূর্খ মানুষরা ওয়াজের মাহফিলে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো জানতে পারে খুব সহজে।
এক সময় শুধু সমাজের বুজুর্গ ও সাধক আলেমগণই ওয়াজ করতেন। কিন্তু এখন ওয়াজে পেশাদারিত্ব এসেছে। সুরেলা ব্যক্তিরা ওয়াজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছেন। জ্ঞানের স্তর যাই হোক না কেনো এসব বক্তা তাদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে আশ্রয় নেন নানা কৌশলের।
কেউ বেছে নেন মনগড়া কিচ্ছা-কাহিনী, কেউ আশ্রয় নেন জ্ঞানহীন সুর ও গান আবার কেউ বেছে নেন হাসি-কৌতুক। তাদের হাসি-কৌতুক থেকে রক্ষা পান না কুরআন-হাদিস থেকে নবী-রাসুল কেউ-ই।
এমনই একজন কৌতুকপ্রবণ বক্তা নোয়াখালীর মাওলানা রফিকুল্লাহ আনসারী। তার প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো হাস্য-কৌতুকে শ্রোতাকে আমোদিত করা। তিনি কুরআন ও হাদিসের আলোচনা করেন কৌতুকের ছলে।
জাহান্নামের ভয়াবহ চিত্রও উপভোগ্য হয়ে ওঠে তার বর্ণনায়। নিচের বর্ণনায় মাওলানা রফিকুল্লাহ আফসারী জাহান্নামের একটি ভয়াবহ চিত্র অনেকটা হাস্যরস মিশিয়ে উপস্থাপন করেছেন।
একইভাবে তিনি কেয়ামতের দৃশ্য ও ফেরেশতাদেরও কৌতুক করতে ছাড়েন নি। যেমন নিচের ওয়াজে তিনি মহান ফেরেশতা ইসরাফিলকে রেফারি, আদম আ. কে মামলার আসামি হিসেবে উল্লেখ্য করেছেন।
অথচ হাদিসের বর্ণনায় এসেছে রাসুলুল্লাহ সা. যখন জাহান্নামের বর্ণনা দিতেন তখন আল্লাহর ভয়ে তার চেহারা লাল হয়ে যেতো। যেনো জাহান্নাম তার সামনে উপস্থিত।
তবে তিনি বেশি সমালোচিত হয়েছেন হজরত মুসা আ. এর মুখের জড়তা নিয়ে কৌতুক করে। সে ওয়াজে (নিচের ভিডিওতে দেখুন) দেখা যায় তিনি হজরত মুসা আ. এর মুখের জড়তা এবং আল্লাহর সঙ্গে তার সংলাপ অভিনয় করে দেখাচ্ছেন।
মাওলানা রফিকুল্লাহ আফসারীর কৌতুককর ওয়াজ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম দেশের শীর্ষ আলেম, মারকাযুশ শাইখ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক এবং অন্যতম খ্যাতিমান বক্তা মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদের কাছে।
আওয়ার ইসলামকে তিনি বলেন, বক্তাদের কৌতুক ও হাস্যরস পরিহার করেই ওয়াজ করা উচিৎ। বিশেষত কুরআন-হাদিস ও নবী-রাসুল নিয়ে কৌতুক করা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা বেয়াদবি ও গুনাহ।
ধরুন! তিনি মুসা আ. এর মুখের জড়তা নিয়ে কৌতুককর অভিনয় করেছেন। হজরত মুসা আ. এর মুখের জড়তা কেমন ছিলো তা কুরআন ও হাদিসে বিস্তারিত নেই। কেউ যদি ইতিহাস থেকে তা জেনে মুসা আ. এর মুখের জড়তাকে তোতলামি হিসেবে অভিনয় করে দেখান তবে তা কুরআনের অপব্যাখ্যা হবে এবং নবীর শানে বেয়াদবি ও কটূক্তি বলে গণ্য হবে।
তিনি আরও বলেন, আমি যতোদূর জানি রফিকুল্লাহ আফসারী কুরআন-হাদিস ও ইতিহাসের যেসব বর্ণনা দেন তার অধিকাংশই তিনি বাড়িয়ে কমিয়ে উপস্থাপন করেন। তিনি রহস্য করে রঙ-রসে নিজের মনমতো উপস্থাপন করেন। এটা দাঈ ও বক্তার জন্য বৈধ নয়।
মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ বলেন, কুরআন-হাদিস ও ইতিহাসের কিভাবে কোনো কিছুর যদি বিবরণ না থাকে তবে তার বিবরণ ও রূপ দাড় করানো ঠিক নয়। এতে মানুষের মাঝে ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়। ভুল মন্তব্য করে। মূলত এভাবে কুরআন-হাদিস উপস্থাপন করা আমাদের পূর্বসূরীদের নীতি বহির্ভূত। শরিয়ত কুরআন-হাদিসের এমন নাটকীয় উপস্থাপন অনুমোদন করে না।
রকমারি ডটকমে বিক্রির শীর্ষে যে ১০ ইসলামি বই
মাওলানা রফিকুল্লাহ আফসারীর মতো বক্তাগণ কুরআনের হুশিয়ারি ‘তারা রাসুলকে উপহাসের পাত্র হিসেবে গ্রহণ করে’-এর অন্তর্ভূক্ত হবে কি?
‘না তারা এ আয়াতের অন্তর্ভূক্ত হবে না। যদিও এমন কাজ বেয়াদবির শামিল। কেননা এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে সেসব কাফিরদের ব্যাপারে যারা নবী আ. কে অপমান ও অসম্মান করার জন্য কৌতুক করতো, একজন আলেম সে যে পন্থীই হোক না কেনো তার উদ্দেশ্য নবীকে অসম্মান করা নয়।’ বলেন মুফনি মিযান সাঈদ।
তার কাছে আরও জানতে চেয়েছিলাম একজন আদর্শ বক্তার বৈশিষ্ট্য কী হওয়া উচিৎ?
বাংলাদেশর শীর্ষ এ আলেমের মতে, একজন বক্তা একজন দাঈ। দাঈ ব্যক্তির প্রধান কাজ হলো উপস্থিত মানুষের মেধা ও মননের প্রতি লক্ষ্য রেখে কথা বলা। যে সমাজে তিনি যাবেন সে সমাজের জন্য আমল ও তাকওয়ার জন্য, ঈমান ও আকিদার জন্য উপকারী কথাগুলো বলবেন।
যে বিষয়টি উপস্থাপন করবেন, তা কুরআন-হাদিস ও ইতিহাসের যে বর্ণনা তিনি উপস্থাপন করবেন তা অবিকৃত অবস্থায় উপস্থাপন করবেন। নিজের অভিমান, অনুমান ও আবেগ দিয়ে তা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে পারবেন না। করলে তা বিকৃতি হবে। তবে উদাহরণ ও উপমা দিতে পারেন। এটা দূষণীয় নয়।
দেশে এই প্রথম আধুনিক চিকিৎসার সমন্বয়ে নববি চিকিৎসা হিজামা
বক্তার মনে ইখলাস থাকতে হবে। তিনি নিজেকে বড় মনে করে শ্রোতাকে ছোট মনে করে কোনো আলোচনা করবেন না। শ্রোতারা যেনো উপস্থাপিত বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে সে দিকে লক্ষ্য রাখবেন।
রফিকুল্লাহ আফসারীর ওয়াজের মানুষ কতটা শুদ্ধ হয় সেটা জানা না গেলেও অনেককে বলতে শোনা যায়, দারুণ রস আছে তার ওয়াজে। বেশ মজা পাওয়া যায়।
ইউটিউবে ছাড়া তার ওয়াজের ভিডিওর শিরোনামগুলো দেখলেও ব্যাপক বিনোদিত হন ভিজিটররা। কয়েকটা শিরোনাম এমন, ‘বিয়া যে এত মজা আগে জানলে আব্বার আগে বিয়ে করতাম!’, ‘নোয়াখালী হুজুরের চরম হাসির ওয়াজ, হাসিতে বাধ্য থাকবেন’, ‘টেলিভিশন শরীফ বাই রফিকুল্লাহ আফসারী’, ‘নোয়াখালী ভাষায় চরম হাসিও ওয়াজ তোরা ভেটকাস কেনু’, ‘দিল ঠাণ্ডা না হলে এমবি ফেরত’।
যদিও ওয়াজের এসব উদ্ভট শিরোনাম বক্তারা দেন না। তবে দেখার পর প্রতিবাদ করেন কিনা সে বিষয়টি ভাবনীয়।
মজার ব্যাপার হলো রফিকুল্লাহ আফসারীর একটি ওয়াজ আপলোড করে সেখানে তাকে অভিনেতাও বলা হয়েছে। নিচের স্ক্রিনশটটি খেয়াল করুন।
এসব মজাদার শিরোনাম ও থাম্বনেল দিয়ে ওয়াজগুলো ইউটিউবে ছাড়েন মূলত তৃতীয় একটি পক্ষ। যাদের সঙ্গে মাহফিলের কর্তৃপক্ষ কিংবা বক্তা কারও সম্পর্ক থাকে না। এরা নিজেরা ভিডিও করেন বা কোথাও থেকে কালেক্ট করে ইউটিউবে ছাড়েন।
রফিকুল্লাহ আফসারীকে অভিনেতা হিসেবে উল্লেখ করা ইউটিউব চ্যানেলটির নাম বাংলা ইসলামিক সেন্টার।
সার্চ করে নাম্বার বের করে কল দেয়া হয়। কল ধরেন চ্যানেলটির প্রতিষ্ঠাতা নাসির উদ্দিন। তিনি কোনো আলেম নন সাধারণ শিক্ষিত ব্যক্তি।
আলেম না হয়েও ওয়াজের ভিডিও প্রচার করেন কেন জানতে চাইলে তিনি স্বীকার করেন এটা তার ব্যবসা।
কিন্তু এমন আজগুবি থাম্বনেল আর শিরোনাম কেন জানতে চাইলে বলেন, মানুষ এখন আকর্ষণীয় কিছু না দেখলে ভিডিওতে ক্লিক করতে চায় না এ কারণেই এমন শিরোনাম।
এমন পদ্ধতিতে মানুষকে ওয়াজ শুনিয়ে ওয়াজের উদ্দেশ্য হাসিল হবে কিনা জিজ্ঞেস করলে তিনি আপত্তিকর বিষয়গুলো দ্রুত সরিয়ে দেবেন বলে আশ্বস্ত করেন।
তবে মাওলানা রফিকুল্লাহ আফসারীর ওয়াজের ভক্তও নিতান্ত কম নয়। কিছু আপত্তিকর বিষয় থাকলেও তার ওয়াজে মানুষ ভালো পথের দীক্ষা পান এ কথাও অনস্বীকার্য বলে মনে করেন তার বেশ কয়েকটি ওয়াজ শোনা মাওলানা আল আমিন।
তিনি মনে করেন, কিছু আপত্তিকর বিষয় বাদ দিলে রফিকুল্লাহ আফসারীর ওয়াজে দৃষ্টিকটু তেমন কিছু দেখি না। এখন মানুষ একটু ব্যতিক্রমী জিনিস চায় এ কথা তো অস্বীকারের উপায় নেই। তাই তিনি যদি একটু অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে মানুষকে ভালো পথে আকর্ষণ করেন তাহলে ক্ষতি কী।
তবে এসব বিষয় নিয়ে অনেক চেষ্টা করা হলেও মাওলানা রফিকুল্লাহ আফসারীর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
শিক্ষানীতি তৈরিতে দেওবন্দের পরামর্শ চেয়েছে মোদী সরকার