আওয়ার ইসলাম: যতদূর সম্ভব নিজ তাকাজা কুরাবনি করে মশওয়ারায় অংশ গ্রহণ করো; চাই যতই কষ্ট হোক না কেন। এক ব্যক্তির সাথে ইমাম সাহেবের ঝগড়া হলো কোনো ব্যাপারে। তাই বলে কি নামাজ ছেড়ে দিবে? এটা কি সম্ভব?
ঝগড়া ঝগড়ার জায়গায়। তাই বলে তো নামাজ ছাড়া যাবে না। ঝগড়া ইমামের সাথে, নামাজের সাথে নয়। ঠিক তেমনি মাশওয়ারাওলাদের কারো সাথে বিতর্ক হলো তাই বলে কি মশাওয়ারা ছেড়ে দিব? আমার মসজিদ, আমার নামাজ তো আমাকে পড়তে হবে। এমন কি রুকু সেজদায় তাকে অনুসরণও করতে হবে।
এমন না যে, ঝগড়ার কারণে আমি পৃথক রুকু বা সেজদা করব। তেমনি আমাদের মশওয়ারাওলাদের সাথে ঝগড়া হয়েছে বলে মাশওয়ারাও ছাড়া যাবে না, অনুসরণও ছাড়া যাবে না।
যদি আমার রায় মানা হয় তাহলে ইস্তেগফার করব আর যদি মানা না হয় তাহলো শোকর করব। সবর না, অনেকে বলে সবর করো। না এটা সবরের মাকাম না। একটা কথা মনে রাখবে, যে ব্যক্তি নিজ রায়ের উপর (না মানা হলে) সবর করবে সে পেরেশান হবে। কারণ এটাতো শোকরের মাকাম।
আমার রায় অনুযায়ী যদি ফয়সালা হতো তাহলে (এই জিম্মাদরী আমার উপর বর্তাবে) আমাকে জিজ্ঞাসা করা হতো (কেয়ামতে)। কারণ, যত রায় দেয়া হয় খোদার কসম, ঐসব রায় আল্লাহর কাছে লিখা হয়। কুরা’আনে এসেছে, নিশ্চয়ই প্রত্যেকের কান, চোখ, অন্তর জিজ্ঞাসিত হবে। তখন বের হবে কার রায়ে নফছানিয়াত ছিল? কার রায়ে হাছাদ ছিল? কার রায়ে খায়েশ ছিল? কার রায়ে দাওয়াত ছিল? এটা পাক্কা কথা।
এজন্য বলা হয়, মশওয়ারাতে বসার আগে আল্লাহর দিকে মতাওজ্জুহ হও। নিজ রায় দেয়ার আগে ভালো করে খেয়ার করো যে আমার রায়ে কোনো খাহেশ নেই তো? এ জন্য সব অবস্থাতে মশওয়ারাতে অংশ গ্রহণ করো। আমাদের মেহনতে ওয়াক আউট (walk out) নেই, এটা তো রাজনীতির কাজ। যে, আমার কথা মানো, তাহলো আসব, নতুবা নয়। না আসলে তুমি ২ কাজ থেকে বঞ্চিত হবে। মনে করবে মশওয়ারাতে না জুড়লে কি হবে?
মহল্লার কাজ করব, গাস্ত করব, নিজ মসজিদের মেহনতে জুড়ব, সমস্যা কি যদি আমি মশওয়ারায় না জুড়ি? না, এটা তো আম মানুয়ের জন্য, আমাদের জন্য হলো, যে, মশওয়ারা থেকে কেটে যাবে, সে কাম থেকে সরে যাবে। এজন্য মাশওয়ারাকে ইজতেমায়ী বানাও।
হযরত ওমর রা. এর যুগে একজনও যদি মশওয়ারাতে অনুপস্থিত থাকতেন তবে ওমর রা. তার ঘরে যেতেন এবং জানতে চাইতেন যে, সে কেন মশওয়ারায়ে এলো না?
মাশওয়ারাকে ইজতেমায়ী বানানোর ২য় বিষয় হলো, সাথীদের থেকে রায় নাও। একা একা ফায়সালা করো না। যেখানেই একাকী ফায়সালা হবে সেখানেই এখতেলাফের সৃষ্টি হবে। সীরাত পড়লে এমনটিই দেখা যায়। যখনই ফায়সালা একা একা (উমুমী মশওয়ারা ছাড়া শুধু ফায়সালের ফয়ালায় হয়েছে) তখনই মত বিরোধ দেখা দিয়েছে।
কোনো এক এলাকাওয়ালা, কোনো এক জেলাওয়ালা এসে জিজ্ঞেস করল বা জানতে চাইল, আজ-কাল (এখন) ফায়সাল কে? কেউ বলল অমুকে ফায়সাল। বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে, চল ফায়সালকে জিজ্ঞেস করে নেই। তারপর ফায়সালের কাছে গেল। ফায়সাল তখন তাদের বলতে হবে, অমুক সময় আমাদের মশওয়ারাওলা সাথীরাও থাকবেন তখন আসবেন।
কুর’আনে এরকমই ইশারা পাওয়া যায়- হে ঈমানদাররা, আল্লাহ এবং তার রাসুলের অনুসরণ করো এবং তাদের, যারা তোমাদের মধ্যে দায়িত্ব প্রাপ্ত (জিম্মাদার)। যদি কোনো বিষয়ে মতভেদ ( ) সৃষ্টি হয় তাহলে বিষয়টি নিয়ে আল্লাহ ও তার রসুলের দিকে ফিরে চল (অর্থাৎ আল্লাহ এবং তার রাসুলের তরিকার উপর মশোয়ারাকে আনো) যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী হও, এটা তোআমাদের জন্য উত্তম এবং সুন্দর তাওয়িল।
জিজ্ঞেস করনেওয়ালা একা, ফায়সালা করনেওয়ালা একা; তখনই এখতেলাফ হবে। যখন নিজ জেলায় গিয়ে কাজ শুরু করবে তখন এখতেলাফ হবে।
মেরে মোহতারাম, আমার চাই যে, কাজ ফায়সালা দিয়ে চালাব না। এই কাজ তো চলবে সাথীদের রায়ে। ইজতেমায়ী মাশওয়ারায় চলবে। মাশওয়ারাকে নামাযের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। ফয়সাল ইমাম এবং মামুর মুক্তাদি এর মতো যে, ইমাম ভুল করলে মুকতাদি মনে করিয়ে দিবে, লুকমা দিবে।
হানাফী মাজাহাব মতে যদি কোন একজন নামাজের বাহির থেকে লুকমা দেয় আর ইমাম লোকমা নেয়, তাহলে সবার নামাজ শেষ। তরতিব হলো, নামাজে শরিক হয়ে লুকমা দাও, তোমার কথা শুনা হবে। আর বাহির থেকে হলে তোমার কথা সত্য হলেও শোনা হবে না। তেমনি কাজে শরিক হও, সব আমলে শরিক হও, তোমার কথা শোনা হবে।
তবুকের সময় সাহাবাদের সব খাদ্য শেষ হয়ে গেল। সাহাবাদের খুব ক্ষুধা দেখা দিল। এক সাহাবীর জযবা, সে উট জবেহ করে খাওয়াতে চাইল। এজন্য সে হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে অনুমতি চাইল। হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিলেন। যখন সে উট জবেহ করার জন্য গেলেন, তখন হযরত ওমর রা. বাধা দিলেন।
সে বলল, আমি অনুমতি নিয়ে এসেছি। হুজুর সা. অনুমতি দিয়েছেন। হযরত ওমর রা. তুবও জবেহ করতে দিলেন না, যে, তুমি একা একা কেন জিজ্ঞেস করেছ? আমাদের সাথে রাখতে। চল এক সাথে গিয়ে জিজ্ঞেস করব।
হযরত ওমর রা. হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আপনি কি করছেন? আমাদেরকে যদি কেউ বলে যে, কি করছেন? তাহলে আমাদের বড় গোস্বা এসে যায়।
হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কি ব্যাপার? হযরত ওমর রা. বললেন, আপনি উট জবেহ করার এজাজত দিয়েছেন? , হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হ্যাঁ। হযরত ওমর রা. বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমার রায় তো এমন। হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার কথাই ঠিক।
হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ ফয়সালা ফিরিয়ে নিলেন। হযরত ওমর রা. বললেন, আপনি বরকতের দোয়া করে দেন। হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করলেন। খাদ্যে এত বরকত হলো যে, সাহাবাদের জন্য খাদ্য উঠিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে গেল। সাহাবীদের ব্যাগ বস্তা ভরে গেল। এমন কি সাহাবারা জামার হাতা ভরে খাদ্য নিলেন। এ ঘটনা থেকে পাওয়া যায়, মাশওয়ারা এস্তেমায়ী না হলে এখতেলাফ আর ইজতেমায়ি হলে বরকত।
নিজ রায়ের উপর এছরার করবে না। যে রায় দিয়ে দিলো সে তার উপর এর দায়িত্ব পুরো করো দিলো। এখন আল্লাহর দিকে মুতাওজ্জহ হও। হক কথার উপরও এছরার (পিড়াপিড়ি) ঠিক নয়। হক কথার উপরও এছরার গলদ।
যেমন হুদায়বিয়ার সময় হযরত ওমর রা. এছরার করতে লাগলেন। যে, আমরা ওমরা করে যাব। ওমরার জযবা তো ভালো। তেমনই যারা এখতেলাফ করে তাদের জযবাও ভাল। এমন না যে, তারা গলদ কিছু চায়। ভালো জযবার কারণেই তো বিরোধিতা। কিন্তু হুকুম তার বিপরীত। আর এমনটা আল্লাহ তা’লা এজন্যই করেন যে, আল্লাহ তা’লা দেখতে চান এদের মধ্যে মানার যোগ্যতা কতটুকু তৈরি হয়েছে।
এক ব্যক্তি ব্যভিচারের অনুমতি চাচ্ছে। তাকে বলা হলো না, এটা হারাম, সে যেনা থেকে বিরত থাকল, সে নেকি পাবে। কারণ হারাম থেকে বিরত থাকল। কিন্তু ওমর রা. ওমরা করতে চায়, যা বাইতুল্লাহ ছাড়া গোটা পৃথিবীতে কোথাও করার অবকাশ নেই। নামাজ, জাকাত, রোজা সারা দুনিয়ায় করা যেতে পারে। কিন্তু ওমরা এক বাইতুল্লাহ ছাড়া সম্ভব নয়। ওমর রা. এর জজ্বা ওমরা করব। কিন্তু হুকুম এলো, না । ওমরা করবে না। ফিরে যাও। এটা এজনই ঘটেছে যে, আল্লাহ দেখতে চান- এদের মধ্যে নবীর এতেয়াতের যোগ্যতা কতটুকু?
এজন্যই ভালো জযবার বিপরীত হুকুম আসে। ওমর রা. এছরার করলেন যে, না, আমরা হকের উপর আছি, আমরা ওমরা করব। হযরত ওমর রা. বলেন, আমি সারা জীবন সদকা দিয়েছি, এস্তেগফার করছি, যে, কেন আমি সে দিন রায়ের উপর এছরার করছি? এটা বলেন নি যে, আমি হকের উপর ছিলাম। বরং তওবা করেছেন যে, হে আল্লাহ, আমার সে দিনের গুনাহ ক্ষমা করে দেন। যে, কেন আমি রায়ের উপর এছরার করলাম?
একটু ভাল করে চিন্তা করুন। সাথীরা ভালো জযবার কারণে এছরার করেন। না ভাই, নিজ রায় দিয়ে অবসর হয়ে যাও। যখনই কোন সাথী ও শুরার রায়ে এখতেলাফ বা মতভেদ সৃষ্টি হয় বা এখ্তেলাফ দেখা দেয়, তখন খোলাফায়ে রাশেদীনদের (প্রথম শুরাদের) দেখ। তারা তাদের সময় সাথীদের রায়র কি রকম এহতেরাম করতেন। গভীর ভাবে চিন্তা করবে।
এক রেওয়াতে আছে, হযরত ওমর ও হযরত ওসমান রা. এর মধ্যে মশওয়ার মধ্যে এমন এখতেলাফ হতে যে, যারা দেখতেন তারা ভাবতেন আজকের পর বোধ হয় এ দুজন আর একত্র হবে না। কিন্তু মজমা থেকে ওঠার পর তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আগের চেয়েও ভালো হতো।
মশওয়ারাওয়ালাদের, শুরা হযরতদের আমি একটা কথা বলছি যে, যখন তাদের আপোষে কোনো বিষয়ে এখ্তেলাফ হয়ে যায়, তখন তারা একে অন্যের রায়কে এহতেরাম করবে, যেমন আবু বকর রা. ওমর রা. একে অন্যের রায়কে এহতেরাম করতেন। এটা অত্যন্ত জরুরি। যদি এমন না করা হয়, তাহলে খোদার কসম, দুশমন ঢুকে পড়বে।
অর্থাৎ যতক্ষণ একে অন্যের রায়ের এহতেরাম করবে এবং শুরার মধ্যে কোনো ফাটল না ধরবে ততক্ষণ বহিরাগত দুশমন ভিতরে ঢুকতে পারবে না। মশওয়ারাই হলো ফেৎনা বা ছালাহ (সুসম্পর্ক) করার দরজা।
যদি মশওয়ারা ফেটে যায় অর্থাৎ এর উসুল নষ্ট হয়, তাহলে দরজা ফেটে যাবে অর্থাৎ দুশমনের প্রবেশের রাস্তা খুলবে। কাজ যাতে আমার আপনার মন মতো না হয় বরং কাজ সীরাত প্রদর্শিত রাস্তা অনুযায়ী হয়। যদি কাজ সীরাত (নবী সাহাবাদের জীবনে) থেকে সরে যায় তাহলে আর আল্লাহর সাহায্য থাকবে না।
[উল্লেখ্য, মাওলানা সাদ কান্ধলভীর বিশেষ এ মোজাকারা মারকাজ ডটঅর্গ থেকে নেয়া। এটি ২০১২ সালের একটি বয়ানের অংশ]