আওয়ার ইসলাম: কর্পোরেট দুনিয়ার মা-বাবাদের কোনো সময় নেই বাচ্চাদের দেওয়ার মতো, স্ত্রীকে দেওয়ার মতো। সবকিছুতেই যেনো দখল করে আছে মোবাইল। রাতের বেলাও ফোন অফ করে রাখে না।
আরে ভাই! স্ত্রী-সন্তানদের জন্য বরাদ্দ করা সময়টাতে তুমি তো ফোনটা অফ করে রাখতে পারো। যে সময়টা তুমি ঘরের জন্য বরাদ্দ রেখেছো তা তুমি ষোল আনাই ঘরে দাও! সন্তানের কাছে যখন বসো, তখন মোবাইলটা বন্ধ করে বসো!
ভাইয়েরা আমার! মোবাইল আমাদের জীবনকে ক্রমে ক্রমেই একাকীত্বে পরিণত করছে, জীবনের কাঠামোগুলো বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে।
আমিও এ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মানুষের অনেক অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করে চলেছি, এজন্য আমি এ বিষয়ে কিছু বলা জরুরি মনে করছি যে, মোবাইল ফোন কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, কাউকে যখন তখন ফোন করে বিরক্ত করা যাবে না। যাকে ফোন করা হবে, সেই লোকটির অবস্থা বুঝে তারপর তাকে কল দিতে হবে।
কেউ কেউ তো এমন যে, সে যাকে কল দিচ্ছে, সে লোকটি হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত থাকতে পারে, এখন যদি সে এক/দুটি কল দেওয়ার পরও ফোন না উঠায় তাহলে বুঝতে সে ব্যস্ত আছে। কিন্তু আমরা এসব বুঝার চেষ্টা না করে কলের পর কল দিয়ে যেতেই থাকি।
কোনো একদিন নফল নামাজ পড়ছি, তো ফোনটা ভুলে খোলা ছিল। হঠাৎ ফোনটা বাজতে শুরু করলো, একবার দুবার নয় অনেক অনেকবার। নফল নামাজ শেষ করি দেখি একই নম্বর থেকে আশিটা কল এসেছে।
একদিন আমি ফোন বন্ধ না করে ঘুমিয়েছিলাম। রাত একটায় ফোন বাজতে শুরু করলো। ভাবলাম এতো রাতে কার ফোন! নিশ্চয় কারো কোনো সমস্যা হয়েছে। ফোন উঠিয়ে বললাম, জি বলুন! জনাব, টয়লেটে যেতে হলে কোন দোয়া পড়তে হয়? মনে মনে বললাম, এ আবার কোন প্রজাতির লোক! এতো রাতে আমার ঘুম নষ্ট করে ফোন করেছে টয়লেটে যাবার মাসআলা জানতে?
এই তো গেল সপ্তাহে আমি নামাজ পড়ছিলাম। তো ফোনের রিং বাজতে শুরু করলো। ফোন বাজছে তো বাজছেই এ বাজার যেনো কোনো শেষ নেই। তো নফল নামাজ শেষ করে দেখি, বিশটা কল আর পাঁচটা ম্যাসেজ। ম্যাসেজে লিখেছে, ফোন ওঠাও, ফোন ওঠাও! শেষ ম্যাসেজে লিখেছে, ও! আমি গরিব দেখে আমার ফোন উঠাও না, মালদার পার্টি হলে তো উঠাতেই!
তো আমি ভাবলাম, বেচারার মনে হয় কোনো জরুরি দরকার, হয়তো কোনো বিপদে পড়েছে, তা না হলে এতোগুলো ফোন আর ম্যাসেজ দিয়েছে। তো ব্যাপারটা দেখার জন্য ফোন উঠিয়ে বললাম, জি জনাব বলুন! আপনার খিদমত করতে পারি! আমাকে কোনো একটা দেশের ভিসার ব্যবস্থা করে দাও! আর দুটুকরো জমির ব্যবস্থা করে দাও, আমি মসজিদ তৈরি করবো! আমি বললাম, ঠিক আছে আমার বেটা! আসসালামু আলাইকুম! বলে ফোন কেটে দিলাম।
ভদ্রতার জীবন অবলম্বন করো। আমাদের সৃষ্টিকর্তা বলেছেন, কারো সঙ্গে যখন দেখা করতে যাও, তখন তার অনুমতি নিয়ে নাও! মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআনে কারিমে বলেছেন, হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য কারো ঘরে তাদের অনুৃমতি ছাড়া এবং তাদের সালাম না করে প্রবেশ করো না। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়। যাতে তোমাদের জন্য রয়েছে উপদেশমালা । (সুরা নূর, আয়াত: ২৭)
তাফসিরে লেখা আছে তাসতাআনিসু মানে তার কাছে অনুমতি চাও এবং সালাম করো। কিন্তু এখানে সরাসরি তাসতাআযিনু কেন বলেনি? এই শব্দটা এজন্য বলেছে যে, তাসতানিসু অনুমতি প্রার্থনা করো এবং সালাম করো! মানে উনস্ সৃষ্টি করো এবং সালাম করো। উনস সৃষ্টি করো। উনস সৃষ্টি করার অর্থ হলো, অসময়ে কারো সঙ্গে দেখা করতে যেয়ো না। অসময়ে কারো দরজায় কড়া নেড়ো না। অসময়ে কাউকে কষ্ট দিয়ে না!
একদিন কোনো এক সেমিনারে আমি পুরো দেড় ঘণ্টা কথা বলেছি। কথা শেষ করে দরজার দিকে গিয়ে দেখলাম, এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। বললাম, আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিলাম। তুমি কখন এসেছা? সে বললো, আমি একঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি। তো এখন আমি তো তোমাকে সময় দিতে পারবো। যুবক বললো, তবে আমি আপনাকে বেশি সময় দিতে পারবো না, বরং পাঁচ মিনিট দিতে পারবো। আমি বললাম ঠিক আছে।
যুবকটি আমাকে নিচে নিয়ে গিয়ে বসাল এবং বললো, আমি ইংল্যান্ডে যেতে চাচ্ছি, সেখানে আমাকে একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন, বললাম, আমি তো তোমাকে পাকিস্তানেই কোনো চাকুরি দেওয়ার ক্ষমতা রাখি না, ইংল্যান্ডে কিভাবে দেব। যুবক তখন বললো, আপনাকে যেমন ভাবছিলাম আপনি তেমন না। আমি বললাম, কী আর করার আছে, আচ্ছা চলি আসসালামু আলাইকুম!
আমার উপর এতো বড়ো ফতোয়া দিয়ে গেল যে, যেমন আপনার ব্যাপারে শুনেছি, তেমনটা পাওয়া যায়নি। বললাম, আমি কী জুনায়েদ বাগদাদী হয়ে গেছি নাকি, সবার আশা পূরণ করে দিতে পারবো! এমন আচরণই মানুষ মানুষের সঙ্গে করে।
তো ভাইয়েরা আমার! মহান আল্লাহ তায়ালার জন্যই সবাই ভদ্রতা শেখো। আল্লাহর ওয়াস্তে মানুষের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে শেখো!
সুইজারল্যান্ডে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম যে, সেখানে কেউ কাউকে এভাবে ফোন করে বিরক্ত করে না, বরং টেক্স করে, ম্যাসেজ লিখে যে, তুমি অবসর হলে আমাকে ফোন করবে অথবা আমি তোমাকে ফোন করবো? আর আমরা! ক্ষতি হোক অথবা জীবনটা হুমকির থাকুক না কেন, গাড়ি চালাচ্ছে আর একই সঙ্গে ফোনে কথা বলছে, অপরপ্রান্ত থেকে আসা কথা শুনছে, তো শুনছেই, এভাবে আমরা নিজের উপর কতো বড় জুলুমই না করে চলেছি।
খাওয়ার সময়ও ফোনে কথা বলছে, ফোনের কথা শুনে যাচ্ছে। যখন খেতে বসে তখন সমস্ত চিন্তা খাওয়ার মাঝে একত্রিত হবে, কারণ যখন হাতে খাবার উঠায় তখন শরীরে একটা বার্তা পৌঁছে, যখন খাবারের দিকে তাকায় তখনও বার্তা পৌঁছে, তারপর যখন খাবার মুখে তুলে তখন বার্তা যেতে থাকে।
যখন খাবার জিহ্বায় রাখে তখন ম্যাসেজ যেতে থাকে। যখন খাবার খেতে থাকে তখন ম্যাসেজ যেতে থাকে। যখন খাবার পেটে যেতে থাকে তখনও ম্যাসেজ যেতে থাকে।
তো এ সময় যদি তার ফোন আসে তখন সারা ডাইজেস্ট বা সিস্টেম ডিসকানেডেট হয়ে যায়। খাবার খাওয়ার সময় যে শরীর একটা অনুভূতি তৈরি হতো সেটা ধ্বংস হয়ে যায়। আল্লাহ তো এসব করার জন্য দেননি। অভিসম্পাত এ অস্থিতরতার উপর, যা নিজের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়।
যখন কেউ খাবার একনিষ্টভাবে খেতে থাকে তার মেধা একলোকমা পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক লোকমা খাবার, এক ঢোক পানিতে আমাদের এক তৃতীয়াংশ পরিমাণ মেধা বেড়ে যায়। তখন ম্যাসেজ যায়।
যখন খাবারে কোনো মনোযোগই না থাকে, আমাদের একদিকে থাকে ফোন, অন্যদিকে অফিসের ফাইল ঘাঁটাঘাটি করতে খাবারে পেট পরিপূর্ণ হয়ে গলা পর্যন্ত এসে যায়। তখন পেট একপাশে যায়, মানুষটা অবস্থান করে আরেকপাশে।
তো ভাইয়েরা! এই সব খুবই জরুরি বিষয়, যা আমি বলছি। অথচ আমাদের যাপিত জীবনে এসবের কোনো গুরুত্বই নেই। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যদি রাতে তোমার ঘরে ফিরতে দেরি হয়ে যায় তবে ঘরে ফিরো না, এতে ঘরের লোকদের কষ্ট হবে, ঘরে ফিরে কাউকে কষ্ট দিয়ো না।
উনস্ সৃষ্টি করো, মানে অনুমতি নাও, সালাম করো অতঃপর প্রবেশ করো। সুবহানাল্লাহ! আর যদি অনুমতি পাওয়া যায় তাহলে ঘরে প্রবেশ করতে পারো! আর যদি অনুমতির বদলে গালি পাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে বাড়ি না ফিরে অন্য কোথাও থেকে যাও! রাগ করো না।
আপনি যদি কারো সঙ্গে এক হাত দিয়ে মুসাফাহা বা হাত মিলান তো, কেউ কেউ বলতে শুরু করে লোকটার অনেক অহংকার। কেবল মুসাফাহার জন্য চারটা আঙ্গুল দিয়েছে, পুরো হাত দেয়নি। আমাদের দেশে একহাতে হাত মিলানোকে অহংকার মনে করে।
এটা বুঝার চেষ্টা করে না যে, লোকটা এতো এতো লোকের সঙ্গে হাত মিলাতে মিলাতে অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছে। তার হাতের বাহু ব্যথা হয়ে গেছে, সেটা না বুঝে তার ব্যাপারে যাচ্ছে তাই বলে যাচ্ছে। তার ব্যাপারে ফতোয়া দিয়ে যাচ্ছে লোকটা অহংকারী।
এক সাহাবির ব্যাপারে একলোক কিছু কথা বললো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। নবীজী বললেন, তুমি তার সঙ্গে কখনো সফর করেছো? লোকটি বললো, না। কোনো চুক্তি করেছো? লোকটির উত্তর, না। তাহলে তাঁর ব্যাপারে এ কথাগুলো কিভাবে বলছো! যদি কারো সঙ্গে লেনদেন করো, চলাফেরা করো, তার সঙ্গে অবস্থান করো, তারপরেও বলতে পারো যে লোকটি কেমন?
অতঃপর এটা কেমন কথা যে, একহাতে মুসাফাহা করা কী তাকাব্বুর বা অহংকারের লক্ষণ? একহাতে মুসাফাহা করা কোনো অসম্মানী? হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে একহাতে মুসাফাহা করেছেন। অথচ আমাদের কিছুলোক ফতোয়া দেওয়া শুরু করে দিয়েছে যে, কেবল চার আঙুল দিয়ে মুসাফাহা করে। বড়ো অহংকারী ও দেমাগওয়ালা হয়ে গেছে।
মদিনার সংস্কৃতি নামে একটা বইয়ে একটা হাদিস পড়েছিলাম যে, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পলায়ন করে হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহার ঘরে প্রবেশ করেছেন, হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনার কি হলো? লোকেরা মুসাফাহা করতে করতে ক্লান্ত করে দিয়েছে তো আমি পালিয়ে এসেছি।
যেখানে আল্লাহর নবী এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন, আমরা তো সাধারণ মানুষ, আমরাও তো লোকদের সঙ্গে মুসাফাহা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাই তখন এটাকে অহংকার বলা কতোটা অন্যায়!
তো ভাই! আমরা আদবের জীবন অনুসরণ সুন্দর করি, আর আদাবে জিন্দেগী অনুসরণের মাধ্যমে জীবন সুন্দর ও সুশোভিত হয়ে যায়, আল্লাহ তায়ালা সবাইকে সে তাওফিক দান করুন। আমীন।
অনুবাদ: আমিন আশরাফ