আবদুল আজিজ: থেমে নেই রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাডুবির ঘটনা। জীবন বাঁচাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার পথেই অনেক রোহিঙ্গা মারা পড়ছেন। প্রায়ই ঘটছে নৌকাডুবির ঘটনা।
এসব ঘটনায় জীবিত উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ভয়ঙ্কর তথ্য। তারা জানিয়েছেন, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং অতিরিক্ত যাত্রী বহন ছাড়াও অর্থের লোভে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এক শ্রেণির দালাল চক্র নাফ নদী পারাপারের নামে হাতিয়ে নিচ্ছে নগদ অর্থ এবং স্বর্ণালংকারসহ প্রয়োজনীয় মূল্যবান আসবাবপত্র। আর যেসব রোহিঙ্গা সময় মতো টাকা দিতে না পারে, মূলত তাদের নৌকাগুলো ইচ্ছে করেই ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তারা বলছেন, ওপারের সীমান্তে যখন মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ছোটাছুটি, নারী-শিশুদের আর্তনাদ, হাজারও মানুষের এপারে আসার আকুতি, ঠিক তখনি এক শ্রেণির দালাল চক্র তাদের টাকার বিনিময়ে নাফ নদীর পারাপারের নামে বাণিজ্যে মেতে উঠেছে।
২০১৭ সালের ২৪ আগস্টের পর থেকে নাফ নদী পার হতে গিয়ে ২৮টি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। এতে ১৮৪ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
এসব ঘটনায় প্রায় চার শতাধিক দালাল ও মাঝিকে গ্রেফতার করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ জামিনে বেরিয়ে আসলেও অনেকে এখনও কারাগারে রয়েছে। কিন্তু এরপরও থেমে নেই নাফ নদীতে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাডুবির ঘটনা।
সর্বশেষ ১৫ অক্টোবর সোমবার ভোরে শাহপরীর দ্বীপের নাফ নদীর মোহনায় ১২ জন রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ২১ জনকে। নিখোঁজ রয়েছে ১৫ থেকে ২০ জন রোহিঙ্গা।
কেন নাফ নদীতে বার বার রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটছে? জানতে চাইলে টেকনাফ কোস্টগার্ডের স্টেশন কমান্ডার লে. জাফর ইমাম সজিব বলেন, ‘অতিরিক্ত টাকার লোভে অদক্ষ মাঝিদের দিয়ে নৌকা পারাপার করা হয়। কখন জোয়ার কখন ভাটা ওই হিসাব না করে নৌকা চালানো হয়।
আরেকটি কারণ হচ্ছে যতবেশি লোকজন উঠাবে ততবেশি টাকা। প্রত্যেকটি নৌকায় দেখা যাচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ জন রোহিঙ্গা। এতে বেশিরভাগ লোক হচ্ছে নারী ও শিশু। তারা দিনের পর দিন না খেয়ে এমনিতেই দুর্বল। আর এতে কোনও নৌকা ডুবে গেলে সাঁতরিয়ে কূলে ফিরে আসার শক্তি তাদের থাকে না।
এছাড়া রোহিঙ্গাদের বহনকারী নৌকাগুলো হচ্ছে মাছ ধরার নৌকা, মানুষ পারাপারের জন্য নয়। এ কারণে বার বার নৌকাডুবির ঘটনা ঘটছে।’
লে. সজিব আরও বলেন, ‘মাঝিরা ইচ্ছাকৃতভাবে নৌকাগুলো ডুবিয়ে দিচ্ছে। কারণ, রোহিঙ্গাদের জনপ্রতি তিন হাজার চুক্তিতে নৌকায় উঠানো হয়। নাফ নদীর মাঝপথে এসে তারা অতিরিক্ত টাকা আদায় করতে চায়। সেটা না পেলে নৌকাটি এদিক-ওদিক দোলা দেয় এবং ডুবিয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়।
এতে ভয়ে নারীরা সঙ্গে থাকা স্বর্ণ, নগদ টাকা ও প্রয়োজনীয় মূল্যবান সামগ্রী নৌকার মাঝি ও দালালদের হাতে তুলে দেয়। এ সময় টাকা দিতে ব্যর্থ হলে অনেক মাঝি ইচ্ছাকৃতভাবে নৌকা ডুবিয়ে দেয়।’
তিনি বলেন, ‘এসব দালালদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অভিযান এবং নৌকার মাঝি ও দালালদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এমনকি আজকেও (১৬ অক্টোবর) শাহপরীর দ্বীপের স্থানীয় এক ইউপি সদস্য নুরুল আমিনকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ।
তবে তিনি জড়িত কিনা বলা সম্ভব নয়। কারণ, সত্য মিথ্যা যাচাই করার ক্ষমতা পুলিশের হাতে।’ তিনি বলেন, ‘শাহপরীর দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ এই অসৎ কাজে জড়িত। বলতে গেলে শাহপরীর দ্বীপকে অপরাধের স্বর্গরাজ্য বলা চলে।’
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আফরুজুল হক টুটুল বলেন, ‘আসলে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাডুবির পর এপার থেকে যাতে কোনও নৌকা ওপারে পারাপার করতে না পারে সেজন্য ব্যবস্থা নিয়েছি। আর এখন নৌকার মাঝিরা সাগরের অন্যপথে ঘুরিয়ে নৌকা ওপারে নিয়ে যাচ্ছে। আর যখন ফিরে তখন আবহাওয়া খারাপ থাকে এবং অতিরিক্ত যাত্রী বহন করার কারণে নৌকাটি ডুবে যায়।’
এএসপি টুটুল বলেন, ‘এই পর্যন্ত ৪০০ দালাল ও নৌকার মাঝিকে গ্রেফতার করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হয়েছে। এরপরও রোহিঙ্গা পারাপারকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন দালাল ও নৌকার মাঝি গজাচ্ছে।
কারণ অভিযুক্ত সব দালাল এখন জেলহাজতে। এরপরও নতুন করে নাম পাওয়া যাচ্ছে। আমরা খুব শিগগিরই তাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘নাফ নদীর মাঝপথে এসে নৌকা ভাড়ার চুক্তির বাইরে অতিরিক্ত টাকা চাইতে পারে। কারণ দালালদের কোনও নীতি নেই। এই বিষয়টি মাথায় নিয়ে পুলিশ এগিয়ে যাচ্ছে।’ আজকালের মধ্যে এসব দালালদের ব্যাপারে একটি ভাল ফলাফলও পাওয়া যেতে পারে বলে আশ্বস্ত করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আফরুজুল হক টুটুল বলেন, ‘এক শ্রেণির দালাল টাকার লোভে মিয়ানমার থেকে অতিরিক্ত রোহিঙ্গা নিয়ে নাফ নদী পার হচ্ছে। এতে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটছে। জেলা পুলিশ এসব দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। রোহিঙ্গাদের সহায়তার নামে প্রতারণার অভিযোগে এ পর্যন্ত ৪০০ দালালকে আটক করে সাজা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।’
টেকনাফ ২ নম্বর বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নাফ নদীতে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাডুবির তিনটি কারণ। এগুলো হলো: অতিরিক্ত যাত্রী বহন, পুরনো নৌকা ও নৌপথে নৌকা চালানো।’
শাহপরীর দ্বীপে গত মঙ্গলবারের নৌকাডুবির উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই নৌকার ধারণক্ষমতা রয়েছে ১৫ থেকে ২০ জনের। কিন্তু, আমরা এই ঘটনায় ১২ জনের মৃতদেহ ও জীবিত ২১ জনকে উদ্ধার করেছি। নিখোঁজ রয়েছে অনেকেই। এতেই ধারণা পাওয়া যায় এই ছোট নৌকাটিতে কতজন লোক ছিল।’
চলতি বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর থেকে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে ২৮টিরও বেশি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ১৮৪ রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে ৯৭টি শিশু, ৫৮ জন নারী ও ২৯ জন পুরুষ। মরদেহগুলো ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন