আওয়ার ইসলাম: রোহিঙ্গা মুসলিম নির্যাতন ইস্যুতে বাংলাদেশসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের সবরকম চাপ উপেক্ষা করে চলেছে মিয়ানমার। শুধু বাংলাদেশই নয়, জাতিসংঘ, আসিয়ান, ওআইসি, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ কোনো সংঘ বা রাষ্ট্রের অভিযোগই কর্ণপাত করছে না মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। প্রত্যাখ্যানের নীতিতেই তারা অটল আছে।
সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার সরকারের অনাগ্রহের কারণে কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিম ও শিশুদের ওপর মিয়ানমার পুলিশের নির্মম নির্যাতনের ভিডিওচিত্র নিয়ে জোর সমালোচনার মুখে তদন্ত কমিটি গঠন করে দেশটির সরকার। তবে কমিটির রিপোর্টেও যা উঠে এসেছে, তাকে প্রহসন বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী কোনো ধরনের নিপীড়ন চালায়নি।
গত বছরের ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের একটি পুলিশ চৌকিতে দুর্বৃত্তদের হামলায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। এ ঘটনার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন শুরু করে। প্রাণভয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিছু শরণার্থী প্রবেশও করে। এমতাবস্থায় মিয়ানমারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার আহ্বান জানায় বাংলাদেশ। ইতিপূর্বে পুলিশি চৌকিতে হামলার ঘটনারও নিন্দা জানায় ঢাকা এবং যে কোনো রকম সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। কিন্তু মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আশানারূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। উপরন্তু অক্টোবরে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিঠি নিয়ে মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত অং সান সু চির সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, তখন সু চি দেখা করেননি বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়। অব্যাহত চাপের মুখে ওই ঘটনার তিন মাস পর বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিয়ানমার। আর এ লক্ষ্যেই ঢাকায় সু চির বিশেষ দূত হিসেবে পাঠানো হচ্ছে দেশটির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ইউ কিওকে। তবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার সরকার আন্তরিক না হলে এ সফরেও বিশেষ কোনো ফল আসবে না বলেই মনে করছে ঢাকা।
আগামী ১১ জানুয়ারি মিয়ানমার সরকারের বিশেষ দূত বাংলাদেশে আসছেন বলে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। বিশেষ দূতের সঙ্গে বৈঠকে সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান চাইবে বাংলাদেশ এবং এ দেশে অবস্থানরত (নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত) সব রোহিঙ্গাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানানো হবে। মিয়ানমারের বিশেষ দূত ঢাকা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম মাহমুদ আলী ও পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে সূত্রের খবর।
রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাকা- ও নির্যাতন নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও চাপ অব্যাহত আছে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের সত্যিকার অবস্থা জানতে বাংলাদেশে আসছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনারের দপ্তর থেকে একটি প্রতিনিধি দল। দলটির চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরের কথা। এ সময় কক্সবাজার ও আশপাশের এলাকায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের শিবিরগুলো পরিদর্শন করবে দলটি। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে তারা একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেবেন।
অন্যদিকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর হামলার বিরুদ্ধে মুসলিম দেশগুলো একটি জোরালো অবস্থান নিতে কুয়ালালামপুরে প্রথমবারের মতো আলোচনায় বসছেন ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। ১৯ জানুয়ারি এ বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। বৈঠক শেষে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে ওআইসির সদস্য দেশগুলোর একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণের কথা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৫৭টি ইসলামি রাষ্ট্রের এ মোর্চা এবারই প্রথম রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিশেষ কোনো সভা ডেকেছে।
এর আগে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে এ ইস্যুতে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে আসিয়ানের পক্ষ থেকে জোর চাপ দেওয়া হলেও কার্যত কোনো ফল আসেনি। উপরন্তু মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চি সমস্যা সমাধানে অন্তত তিন মাস সময় লাগবে বলে আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সে সময় জানান।
এদিকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) হামলার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার সন্ত্রাসবিরোধী দপ্তরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। এ ছাড়া রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘের জরুরি হস্তক্ষেপ চেয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিকে ২২ নোবেলজয়ী একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন।
ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের বিষয়ে আন্তরিক নয়। তারা এর সমাধান চাইলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রস্তাবে অনেক আগেই সাড়া দিত।
ওই কর্মকর্তা মনে করেন, মিয়ানমারের প্রতিনিধির বাংলাদেশ সফরেও তেমন কোনো সফলতা আসবে না। তবে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে চেষ্টা চালিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
প্রসঙ্গত চার শতাধিক বছর ধরে রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে বসবাস করলেও মিয়ানমার সরকার তাদের এ পর্যন্ত নাগরিক হিসেবেই মেনে নেয়নি, দেয়নি এ সংক্রান্ত কোনো সুযোগ-সুবিধা। উপরন্তু বিভিন্ন সময় সরকারের মদদে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমনকি সেনাবাহিনী পর্যন্ত তাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে আসছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশটি থেকে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের তাড়িয়ে দিতে চায় সরকার। এ জন্যই বিভিন্ন সময় ইস্যু তৈরি করে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, চালানো হচ্ছে হত্যাকা--ধর্ষণ; যেন তারা অত্যাচারের ভয়ে নিজেরাই দেশ ছেড়ে পালায়। এরই সর্বশেষ প্রতিফলন ঘটেছে সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনায়।
ডিএস