জহির উদ্দিন বাবর; আওয়ার ইসলাম
ফোকাসে থাকা শীর্ষ আলেমদের কেউ তিনি ছিলেন না। ‘হাঁকডাকে’র কোনো কর্মকাণ্ডে তাঁকে দেখা যেতো না। তবে দল-মত নির্বিশেষে সব মহলের কাছে একবাক্যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল তাঁর। অনেক খুঁজেও ঢাকায় তাঁর সমকক্ষ ‘সর্বজন গ্রহণযোগ্য’ কোনো আলেম আমি অন্তত পাইনি। অভিভাবকতুল্য সেই আলেম শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রহ. আজ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাঁর এই চলে যাওয়ায় যে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা আদৌ কোনোদিন পূরণ হবে কি-না তাতে সন্দেহ আছে। এমন নীরব সাধকের প্রয়োজন আজ ইলমি মহল হাড়ে হাড়ে টের পাবে। যাদের কারণে দেশ ও জাতি অনেক বড় বড় বিপদাপদ থেকে রক্ষা পায় তাদেরকে বলা হয় ‘শহর কুতুব’। আমার দৃঢ় বিশ্বাস পাহাড়পুরী হুজুর সেই কুতুবদের একজন ছিলেন। সুতরাং তাঁর এই শূন্যতা শুধু ইলমি মহলই নয়, জাতীয়ভাবে অনুভূত হবে।
আমরা যখন জামিয়া রাহমানিয়ায় দাওরায়ে হাদিস পড়তে আসি তখন প্রথম শুনি পাহাড়পুরী হুজুরের কথা। তবে আভ্যন্তরীণ গণ্ডগোল থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার কারণে পাহাড়পুরী হুজুর তখন রাহমানিয়ায় আসতেন না। তাঁর মতো একজন মহান শিক্ষককে না পাওয়ার খেদ তখন আমাদের মধ্যে ছিল। তবে সেই খেদ কিছুটা পূরণ হয়েছিল তাঁর কয়েকটি দরসে বসার সুযোগ পেয়ে। তিনি লালমাটিয়া মাদরাসায় হাদীসের দরস দিতেন। আমরা প্রায়ই লালমাটিয়ায় ছুটে যেতাম। মাগরিবের পর তিনি বুখারী শরীফ সানী পড়াতেন। শুনেছি তাঁর মতো বুখারী সানীর এমন দরস খুব কম মুহাদ্দিসই দিতে পারেন। চোখ বন্ধ করে অনর্গল হাদীসের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতেন। মনে হতো সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগে চলে গেছেন। নিজ চোখে দেখে দেখে হাদীসের নানা ঘটনা ব্যাখ্যা করছেন। একবার তাঁর দরসে বসলে কেউ বিমুগ্ধ না হয়ে ওঠার কোনো উপায় ছিল না।
আরো পড়ুন: জানাজা অনুষ্ঠিত; তিল ধারণের ঠাই নেই
পাহাড়পুরী হুজুরকে নিজে খুব ঘনিষ্ঠভাবে না দেখলেও তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে বহু গল্প শুনেছি। তাঁর সম্পর্কে যত জেনেছি তত বিমুগ্ধ হয়েছি। তিনি হাফেজ্জী হুজুরের জামাতা এবং খুব প্রিয়ভাজন ছিলেন। সেই আশির দশকে হাফেজ্জী হুজুরের রাজনৈতিক উত্থানের সময়ও পাহাড়পুরী হুজুর ছিলেন সিনের বাইরের মানুষ। ‘ক্ষমতার কামড়াকামড়ি’র ধারেকাছেও তাঁকে পাওয়া যেত না। নীরব সাধক নীরবেই মানুষ গড়ার কাজ করে গেছেন। আধ্যাত্মিক জগতের রাহবারি করেছেন। ইলমের চর্চা ও প্রসারে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। বৈষয়িক প্রাপ্তির দিকে কখনো ফিরে তাকাননি। দ্বীনের আদর্শিক ধারায় অক্ষুণ্ন থেকে নিরলস কাজ করেছেন। খ্যাতি আর প্রাপ্তির প্রতি নির্মোহতা তাঁকে এমন এক উচ্চ আসনে আসীন করেছে সমসাময়িক কেউ তাঁর ধারেকাছেও না।
কাছ থেকে যারা দেখেছেন তারা জানেন, যথার্থই একজন মাটির মানুষ ছিলেন তিনি। আল্লাহওয়ালা লোকদের চেহারায় ফুটে উঠে এর নিদর্শন। পাহাড়পুরী হুজুরকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হতো। এই যুগেও এমন খাঁটি মানুষ হতে পারে সেটা তাঁকে দেখে বুঝেছি। আপাদমস্তক ছিলেন সুন্নতের অনুসারী। যে কয়েকবার তাঁর কাছে ভেড়ার সুযোগ হয়েছে তাঁকে ‘বিশুদ্ধতম’ একজন বুযুর্গ হিসেবে পেয়েছি। দিন দিন তাঁর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা শুধু বেড়েছেই।
বছর-পাঁচেক আগে ময়মনসিংহ থেকে দারুল উলূম নিজামিয়ার মুহতামিম মাওলানা আমিনুল হক সাহেবের নেতৃত্বে একটি কাফেলা ঢাকায় আসে। তাদের সঙ্গে আমারও পাহাড়পুরী হুজুরের মিরপুরের বাসায় যাওয়ার সুযোগ হয়। তখনও তিনি অসুস্থ, চোখে খুব কম দেখতে পান। আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললেন। আমরা লেখালেখির সঙ্গে জড়িত জেনে অনেক দুআ দিলেন। আসার সময় তাঁকে কিছু নসিহত করতে বলা হলো। তিনি তখন যে নসিহতটা করেছিলেন তা ছিল, ‘যতটুকু প্রয়োজন এর বেশি সম্পর্ক দুনিয়ার সঙ্গে করবেন না।’
শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর ইন্তেকালের পর মহানগর নাট্যমঞ্চে তাঁর স্মরণসভায় এসেছিলেন পাহাড়পুরী হুজুর। সবশেষ জনসম্মুখে তাঁকে তখনই দেখি। সেদিন তিনি তাঁর উস্তাদ শায়খুল হাদিসের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের গভীরতার গল্প শুনিয়েছিলেন। বিমুগ্ধ হয়ে হলভর্তি শ্রোতা শুনেছিল সেই গল্প। হাফেজ্জী হুজুর, শায়খুল হাদীস রহ.-এর মতো মহান ব্যক্তিদের হাতেগড়া সেই বিদগ্ধজন এখন নিজেই গল্প। নীরবে-নিভৃতে একজন সাধক কিভাবে মানুষের হৃদয়রাজ্যে স্থান করে নিতে পারেন সেই গল্পেরই বাস্তব রূপকার পাহাড়পুরী রহ.। বিদায়ের মধ্য দিয়ে দল-মত নির্বিশেষে সর্বমহলে যেভাবে তিনি শোকের ছায়া বিস্তার করে গেলেন এর উদাহরণ বোধহয় নিকট অতীতে কমই আছে। আল্লাহ তাঁর কবরকে নূর দ্বারা ভরপুর করে দিন। তাঁকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে এমন নীরব সাধকদের মিছিল দীর্ঘ হোক-সেই দুআ করি।
লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক; ঢাকা টাইমস ২৪ ডটকম
সাধারণ সম্পাদক; বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম
আরআর