রবিবার, ০৭ জুলাই ২০২৪ ।। ২৩ আষাঢ় ১৪৩১ ।। ১ মহর্‌রম ১৪৪৬


‘বাবার সান্নিধ্য’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| মাসউদুল কাদির ||

বাবা কাহিনী-১

নব্বই দশক। তখনকার বাবারা আরো কড়া ছিলেন। সন্তানদের হাতে একদম পয়সা দিতেন না।  সকাল, দুপুর এবং রাতে মাদরাসায় খাবার দিয়ে যেতেন। বাইরের খাবার তারা পছন্দ করতো না। সবার বাবা আসে, দেখা হয়, হইহুল্লুর হয়। আমার বাবা কখনও আসে না। অন্য ফ্রেন্ডদের বাবা প্রায় প্রতিদিন আসে। আমরাও সালাম দিই, মুসাফা করি। অনেকে নিজেদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। আমাদের জন্য দোয়াও করেন। অনেক এতিম ছেলেরাও আমাদের সঙ্গে পড়ত। এদের অনেক ডিমান্ড ছিল মারাসায়। কারণ, এদের কারণে মাদরাসায় অনেক ‘দান’ আসত। উস্তাদগণ তাদের আলাদা নজরে দেখত।

একদিন এক বৃদ্ধ লোকের খপ্পরে পড়লাম। শ্রদ্ধাভাজন এ বৃদ্ধ আমাকে মনে করেছিলেন- এতিম। তিনি আমাকে কিছু একটা খাওয়ানোর জন্য জোর  করে রাস্তার মোড়ে নিয়ে গেলেন। খাওয়ালেন। আমি ভয়ে কাঁপছি। গ্রামে থাকতে জানতাম, ‘কেল্লা খাটুরি’ মাথা কেটে নিয়ে যায়। ভয়ে পাট ক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতাম না। ঢাকায় এসে শুনি, ‘ছেলে ধরা’ নিয়ে। মেয়ে ধরে নিলেও লোকজন ছেলে ধরাই বলে। নাম বদলায় না। রাজধানীতে কত কত রাহাজানি, সন্ত্রাস দৌরাত্ম্য চোখে দেখেছি-এর শেষ নেই। একসম সাহস হয়ে গেল। কারণ, খারাপ লোকদের টার্গেটে ছিল পয়সাওয়ালারা। পকেট ফাঁকা লোকেরা তাদের টার্গেট নয়। অশান্ত ঢাকায় হিরোইনখোর তখন কম ছিল।

কেবল মায়ের কাছে যাবে বলে, বাবার সান্নিধ্য পাওয়ার দুইদিন খায়নি আমার এক ক্লাস ফ্রেন্ড। উস্তাদ আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাকে বাসাবোর পাটোয়ারি বিল্ডিংয়ের বাসায় পৌঁছে দেওয়ার। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি না খেয়ে কান্না করে অসুস্থ হয়ে গেলে?

বাবাকে না দেখলে, মা- কে না দেখলে আমার পেটে ভাতই যায় না। এক টেবিলে বসলে আমি ঠিকই খেতে পারি। অবশ্য এটার একটা দার্শনিক যুক্তি আছে। ছোটবেলায় আমরা অনেকেই একবার চুরি করেও দুই লুকমা খাবার খেয়েছি। দুধ খেয়েছি। একবার দুধের সর নিয়ে কী এক দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। মাত্র দুধের সর খেলাম। গরম দুধও একটু খেলাম। এরই মধ্যে আম্মা গোসল সেরে এলেন। আমি তো ভয়ে শেষ। মুখ মুছে এক্কেবারে ভালো ছেলের মতো ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছি। যেন কিছুই বুঝি না। আমরা অনেক ভাই। আটজন। খাবার দাবার নিয়ে বরাবরই আমার মা খুব ন্যায়বিচারক। অলক্ষ্যে কারও খাবার চলবে না। একসঙ্গে বসে খেতে হবে। বাবার খাবার হতো সবার সামনেই। প্রতি বেলাতেই বাবার জন্য একটু আলাদা কিছু থাকতো। এটা মা-ই ব্যবস্থা করে রাখতেন। আমি ভয়ে ভয়ে আরও একবার দুধের পাতিলের কাছে গেলাম। আমি তো থ বনে গেলাম। মা দেখে ফেললেন আমার মুচকি হাসি। একটু চড়া গলায় বললেন, এখন দুধ খাওন যাইতো না। আজকে দই বানাবো।

আমি বল্লাম, জী। 
মা এবার আমাকে দিয়ে বললেন, খেতে বসো। সবাইকে খেতে ডাকো। আমি কেন হেসেছিলাম, মা হয়তা বুঝতে পারেননি। তিনি ধরে নিয়েছিলেন আমি দুধ খেতে চাচ্ছি। আমি তো আগেই দুধ খেয়ে সাবাড় করে রেখেছি।

মা এবার সত্যিই দুধের পাতিলের কাছে গেলেন। তখন একটু ভয় কেটে গিয়েছিল। কিন্তু চোরের মনে তো পুলিশ পুলিশ। আমার আবার বুকটা ধক্ করে উঠলো। মাথা নুয়ে এল।

মা আমাকে ডেকে বললেন, দেখো কত সুন্দর সর হয়েছে। একটু খাবি? 
-না আম্মা। আমি সর খাবো না। ভাত খাবো। 
- নে নে, তুই তো হিফজ পড়বি। একটু সরটর খেলে পড়াটা ভালো পারবি।
-ঠিক আছে। একটু করে দাও। 
- নে পুরোটাই খেয়ে নে। আবার সর হবে।

এ বিষয়টাই আমার জানা ছিল না। একবার সর খেয়ে ফেললে আবার হয়। পাতিলে নতুন করে আবার সর দেখেই আমি মুচকি হেসেছিলাম।

বলছিলাম, বাবার কথা। জীবনে বাবা বড় সম্পদ। বাবা যার মাথায় একবার হাত দেয় তার জীবনের গতিটাই বদলে যায়। ঢাকার জীবনে বাবার শূন্যতা অস্বীকার করবার সুযোগ নেই। নব্বইয়ে এখনকার মতো যোগাযোগ ব্যবস্থাও এত উন্নত ছিলো না। এক মেঘনা নদী ছিল ‘ঢাকা থেকে আমাদের বাড়ি’ কয়েকগুণ দূরত্বের সমান। এটা বিশাল উন্নতি। সিলেটবাসী আদতে এসব ভুলে গেছে। ছয় ঘণ্টার রাস্তা যেতেও তাদের ডাকাতের ভয়ে মাঝপথে হোটেলে রাত যাপন করতে হতো।

সবার বাবা প্রতিদিন আসে। তারা বাবার ভালোবাসা প্রাণভরে নেয়। কিন্তু এরা বাবাকে ঠিক মতো সালামও করতো না। একজন পুলিশ আঙ্কেল ছিল। আমরা সালাম মুসাফা করতাম। তিনি আমাদের খুব প্রশংসা করতেন। ময়মনসিংহের ত্রিশালের ওই পুলিশ আঙ্কেল জেদ করে বলতেন, দেখো, এতো পুলিশের ছেলে, মানুষ হবে না। 
আমি বলতাম, কেন আঙ্কেল। মানুষ হবে না কেন?
-  দেখো না, তোমরা কী সুন্দর বড়দের সালাম দাও। কথা বল। ওতো সালামও দেয় না।
-ও লজ্জা পায়। আপনার ছেলেও ভালো।

তখন তিনি মুচকি হাসতেন। ত্রিশালের হিফজবন্ধুর সঙ্গে আমার অনেক বছর পরে একবার সাক্ষাৎ হলো। একবার মাদরাসার এক বড় ভাইয়ের কাছে গেলাম। তিনিও হিফজের উস্তাদ। আমি কিতাব বিভাগে পড়ি। গিয়ে দেখি ওই বন্ধু হিফজ শুনাচ্ছে। তবে হিফজ শেষ করেছে। তখন আবার তার বাবার কথা মনে পড়লো। দেরিতে হলেও সে তো হিফজ সম্পন্ন করেছে। কম কী।

একদিন বিকালে আমার চোখ যেনো আনন্দ হিল্লোলে নেচে উঠলো। বিস্মিত হলাম। আমি বিশ^াসই করতে পারছিলাম না। শুধু বাবা একা নয়। আমার আরো অনেক চাচা একত্রে আমাকে দেখতে এসেছে। আমি যেনো দোতলা থেকে একপ্রকার উড়ে এসে বাবার কোলে পড়লাম। বাবার সঙ্গে জনাব গিয়াস উদ্দীন বাবু চাচা ছিলেন। তিনি আমাকে টাকা দিলেন, আদর দিলেন। গেল কয়েক বছরের সম্পূর্ণ নিরানন্দ বেদনা যেনো পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল।

বাবা, আমার উস্তাযগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। খবর নিলেন। আমার গতিপ্রকৃতি কেমন? আমি পারবো কিনা? জানতে চাইলেন।

বাবার সান্নিধ্য পেয়ে আমি একেবারে উতলা হয়ে গিয়েছিলাম। ফিরে যাওয়ার সময় বাবা কেবল বললেন, দুষ্টুমী করো না। মন দিয়ে পড়। তাহলেই স্বপ্ন পূরণ হবে। 
আজ জানতে বড় ইচ্ছে করে, আমাকে নিয়ে কী স্বপ্ন ছিল বাবার?

কেএল/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ