প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রণিধানযোগ্য কারণ হিসেবে পবিত্র কোরআনে আমরা দেখি যে মানুষের কর্মকাণ্ডের ফল হিসেবেই দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসে। যেমন : আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণে জলে ও স্থলে বিপর্যয় দেখা দেয়। যার ফলে আল্লাহ তাদের কিছু কিছু কৃতকর্মের ফল প্রদান করে থাকেন, যেন তারা পাপ থেকে ফিরে আসে।’ (সুরা : রুম, আয়াত : ৪১)
অথচ আল্লাহ তায়ালা নিজ গুণে মানুষের নানা ধরনের অপরাধ ক্ষমা করে দেন।
তিনি বলেন, ‘তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তা তো তোমাদের কৃতকর্মের ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন।’ (সুরা : আশ-শুরা, আয়াত : ৩০)
ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিকম্পের মতো মসিবত আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। বান্দার কৃতকর্মের কারণেই আল্লাহ তায়ালা এ ধরণের পরীক্ষার সম্মুখীন করেন এবং বান্দাদের সতর্ক করেন। এ অবস্থায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি মুসলমানদের জন্য তাওবা-ইস্তেগফার, সদকা ও দোয়ার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এখানে দুর্যোগের ক্ষতি থেকে বাঁচতে কিছু সুন্নাহসমর্থিত আমল তুলে ধরা হলো।
১. ধৈর্য ধারণ
যেকোনো বিপদে ধৈর্য ধারণ করা মুমিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফলফলাদির ক্ষতির মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। ’ (সুরা বাকারা: ১৫৫)
আল্লাহ তায়ালা আরও ইরশাদ করেন, নিশ্চয় ধৈর্যশীলদের অপরিমিত পুরস্কার দেয়া হবে। (সুরা যুমার: ১০)
২. তাওয়াক্কুল
মুসলমানদের সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) রাখা উচিত। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সুরা তালাক: ৩)
৩. তাওবা ও ইস্তেগফার
তাওবা-ইস্তিগফার সম্পর্কে কুরআনে এসেছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহর সমীপে খাঁটি তাওবা করো, এই আশায় যে তোমাদের প্রভু তোমাদের সব পাপ ক্ষমা করে দেবেন আর তোমাদের এমন উদ্যানসমূহে উপবিষ্ট করবেন, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত থাকবে।’ (সুরা আত-তাহরিম: ০৮) ভয়াবহ বিপদ কিংবা দুর্যোগে ইস্তেগফার অন্যতম ফলপ্রসূ আমল। বান্দারা যখন ইস্তেগফারে রত হয়ে যায়, তখন আল্লাহ আজাব উঠিয়ে নেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ এমনও নন যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করবে অথচ তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন।’ (সুরা আনফাল: ৩৩)
৪. সদকা
সদকা সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, নিশ্চয়ই সাদকা অপমৃত্যু রোধ করে। (তিরমিজি: ৬৬৪; ইবনে হিব্বান: ৩৩০৯) আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেন, ‘তোমরা অধিক হারে সদকা করো। কেননা বালা-মুসিবত সদকাকে অতিক্রম করতে পারে না।’ (বায়হাকি: ৮০৮৩)
৫. সচেতনতা অবলম্বন
ইসলামে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য জোর তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দুর্যোগের সময় কে কোন দায়িত্ব পালন করবে- সেটা বণ্টন করে দিতে হবে। দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনরা, সতর্কতা অবলম্বন করো।’ (সুরা নিসা: ৭১)
৬. সহযোগিতা
ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, অতিবৃষ্টিসহ সকল দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশা দাঁড়াতে উৎসাহিত করে ইসলাম। এটি উৎকৃষ্ট নেক আমল বা মহান ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিন মুমিনের জন্য ইমারতসদৃশ, যার এক অংশ অন্য অংশকে মজবুত করে। এরপর তিনি (হাতের) আঙুলগুলো (অন্য হাতের) আঙুলে (ফাঁকে) ঢোকালেন। (বুখারি: ৬০২৬) রাসুল সা. আরও বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বান্দার সাহায্যে ততক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ সে অপর ভাইয়ের সাহায্যে থাকে।’ (মুসলিম: ২৩১৪)
৭. দোয়া
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিভিন্নরকম হতে পারে। যেমন- ভূমিকম্প, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি ইত্যাদি। এখন এই অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে। এই অবস্থায় একটি দোয়া পড়া সুন্নত। দোয়াটি হলো—
اللهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ خَيْرَهَا، وَخَيْرَ مَا فِيهَا، وَخَيْرَ مَا أُرْسِلَتْ بِهِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا، وَشَرِّ مَا فِيهَا، وَشَرِّ مَا أُرْسِلَتْ بِهِ
উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা খাইরাহা ওয়া খাইরা মা-ফিহা ওয়া খাইরা মা-উরসিলাত বিহি, ওয়া আউজুবিকা মিন শাররিহা ওয়া শাররি মা-ফিহা ওয়া শাররি মা-উরসিলাত বিহি।’
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করি এই ঝড়ের কল্যাণ, এর মধ্যস্থিত কল্যাণ, এর সঙ্গে প্রেরিত কল্যাণ। আমি আপনার নিকট পানাহ চাই এই ঝড়ের অনিষ্ট থেকে, এর মধ্যস্থিত অনিষ্ট থেকে, এর সঙ্গে প্রেরিত অনিষ্ট থেকে।
আয়েশা রা. বলেন, যখন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হতো এবং ঝড়ো বাতাস বইত, রাসুলুল্লাহ সা.-এর চেহারায় চিন্তার রেখা ফুটে উঠত। এই অবস্থা দেখে তিনি এদিক-সেদিক পায়চারি করতে থাকতেন এবং দোয়াটি পড়তেন। (বুখারি: ৩২০৬; মুসলিম: ৮৯৯; তিরমিজি: ৩৪৪৯)
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত এই দোয়াটিও পড়বেন- رَبَّنَا اکۡشِفۡ عَنَّا الۡعَذَابَ اِنَّا مُؤۡمِنُوۡنَ ‘রাব্বানাকশিফ আন্নাল আজাবা ইন্না মুমিনুন।’ অর্থ: ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের উপর থেকে আপনার শাস্তি প্রত্যাহার করুন, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করছি।’ (সুরা দুখান: ১২)
এছাড়াও যেকোনো মসিবতে দোয়া ইউনুস পড়া বিশেষ আমল। দোয়াটির ফজিলত বর্ণনায় হজরত ইউনুস আ.-কে বিপদমুক্ত করা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাঁর আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাঁকে দুশ্চিন্তামুক্ত করে দিলাম। আমি এভাবে বিশ্ববাসীদেরকে মুক্তি দিয়ে থাকি।’ (সুরা আম্বিয়া: ৮৭)
আল্লাহ তায়ালা আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এনএ/