বাসীর আহমাদ: আল্লাহ তায়ালার দরবারে আল্লাহ তায়ালার কোন গুণবাচক নাম,নিজের নেক আমল বা আল্লাহ তায়ালার কোন প্রিয় বান্দার ওসিলা দিয়ে দোয়া করা।
যেমন এভাবে বলা হে আল্লাহ আমার নামাজ,কোরবানি,সদকার ওসিলায় বা আপনার প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওসিলায় বা আপনার অমুক নেক বান্দার ওসিলায় আমার দোয়া কবুল করুন।
উম্মতের অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম এবং ওলামায়ে দেওবন্দের আকিদা হলো, এভাবে দোয়ার মধ্যে নবীগণ ও ওলীদের ওসিলা ধরে দোয়া করা বৈধ তাদের জীবদ্দশাতেও এবং তাদের মৃত্যুর পরেও।
নেক আমলের ওসিলা দিয়ে দোয়া করা যেমন সর্বসম্মতিক্রমে বৈধ। আল্লাহর প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্তার ওসিলা দিয়ে দোয়ার এ রীতির সূচনা হয়েছে স্বয়ং প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে তাঁরই নির্দেশে সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে। এবং স্বয়ং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও পূর্ববর্তী নবীগণের ওসিলা দিয়ে দোয়া করার বিষয়টিও হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত।
পরবর্তিতে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম ও তাবীগণের যুগেও হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্তার ওসিলা দিয়ে দোয়া করার রীতি প্রচলিত ছিল।
ইমাম শাফী রহ: এর ব্যাপারে সহিহ সনদে ”তারীখে খতীব” নামক কিতাবে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি ইমাম আবু হানীফা রহ: এর ওসিলা দিয়ে দোয়া করেছেন।
নিম্নে ওসিলা দিয়ে দোয়া করা জায়েয হওয়ার স্বপক্ষে কিছু দলিল উল্লেখ করা হলো:
১. হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ রা. বর্ণনা করেন একদা এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে আরয করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর নিকট আপনি আমার সুস্থতার জন্য দোয়া করুন। উত্তরে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন তুমি চাইলে আমি দোয়া করি,আর যদি তুমি চাও তাহলে ধৈর্য ধারণ করো,আর এটাই তোমার জন্য অধিক উত্তম।
সে বললো আপনি দোয়া করুন। তখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে উত্তমরূপে ওজু করে এভাবে দোয়া করার আদেশ দিলেন, ’হে আলাহ! আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করি এবং আপনার রহমতের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওসিলা সহকারে আপনার অভিমুখি হই। হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি আমার এই প্রয়োজন পূরণে আপনার ওসিলা দিয়ে প্রভুর অভিমুখি হলাম। হে আল্লাহ! আপনি আমার ব্যাপারে তাঁর সুপারিশ কবুল করুন। (সুনানুন নাসাঈ হাদিস নং-১০৪১৯, মুসনাদে আহমাদ হাদিস নং-১৭২৪০, সহীহ ইবনে খুযাইমা হাদিস নং-১২১৯।) উল্লেখিত হাদীসটি ইমাম তিরমিজী রহ. সুনানে তিরমিযীতে বর্ণনা করে হদীসটিকে ’হাসান সহীহ’বলেছেন। হাদিস নং-৩৫৭৮।
ব্যক্তি সত্তার ওসিলা দিয়ে দোয়া করা প্রমাণিত হওয়ার ব্যাপারে এ হাদীসটিই যথেষ্ট।
১. এমনিভাবে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ রা. এর পরামর্শে এক তাবেয়ী হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্তার ওসিলা দিয়ে হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ রা. এর বর্ণিত হাদীসে বাক্যগুলো দ্বারা নিজের প্রয়েজন পূরণে আল্লাহর নিকট দোয়া করেছেন, এবং তিনি এতে সফলও হয়েছেন। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ হাদীস নং-৩৬৬৮।)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এই দোয়ার সরাসরি শিক্ষালাভকারী হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ রা.ও এটাই অনুধাবন করেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পরও তাঁর সত্তার ওসিলা দিয়ে তেমনি দোয়া করা যায়, যেমনটি তাঁর জীবদ্দশায় করা যেত। অন্যথায় তিনি উক্ত তাবেয়িকে এভাবে দোয়া করার নির্দেশ দিতেন না।
২. হযরত আনাস ইবনে মালিক রা.বর্ণনা করেন হযরত আলী রা. এর মাতা ফাতিমা বিনতে আসাদ ইবনে হাশিম মৃত্যুবরণ করলে তার কবর খনন করা শেষ হওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের ভিতর ঢুকলেন এবং শুয়ে এই দোয়া করলেন, ’আয় আল্লাহ! যিনি জীবন ও মৃত্যু দান করেন। যিনি চিরঞ্জীব। আমার মা (সমতুল্য) ফাতেমা বিনতে আসাদকে ক্ষমা করুন এবং তাঁকে কবরের প্রশ্নের উত্তর স্মরণ করিয়ে দিন। তাঁর কবরকে প্রশস্ত করে দিন আপনার নবী এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণের ওসিলায়। আপনি তো সকল দয়ালুর চাইতে বেশি দয়ালু। (আল মুজামুল কাবীর,হাদীস নং-৮৭১, মাজমাউয যাওয়ায়েদ হাদীস নং-১৫৩৯৯।)
এই হাদীসে স্পষ্টভাবেই এর উল্লেখ রয়েছে মৃতব্যক্তির ওসিলা দিয়ে দোয়া করা বৈধ। কেননা স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই তাঁর পূর্ববর্তী মৃত নবীগণের ওসিলা দিয়ে দোয়া করেছেন।
৪. হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. বর্ণনা করেন, দুর্ভিক্ষকালে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. হযরত আব্বাস ইবনু আব্দিল মুত্তালিব রা. এর ওসিলা দিয়ে বৃষ্টির জন্য এভাবে দোয়া করতেন, হে আল্লাহ! আমরা আমাদের নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওসিলা দিয়ে দোয়া করতাম,ফলে আপনি বৃষ্টি দান করতেন। এখন আমরা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা আব্বাস রা. এর ওসিলা দিয়ে বৃষ্টির দোয়া করছি,আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন। (সহিহ বুখারি,হাদিস নং-১০১০।)
৫. দুর্ভিক্ষকালে হযরত ওমর রা. সাহাবায়ে কেরামকেও হযরত আব্বাস রা. এর ওসিলা ধরে দোয়া করার আদেশ দিতেন এভাবে-’হে লোকসকল! তোমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করো তাঁর চাচা আব্বাস রা.এর ব্যাপারে এবং তাকে আল্লাহর নিকট ওসিলা হিসেবে পেশ করো’। (ফাতহুল বারী খ:২ পৃ:৬১৩।)
ওসিলা দিয়ে দোয়া করার বিষয়টি যখন স্বয়ং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত এবং তিনি নিজেই সাহাবীকে এভাবে দোয়া করার নির্দেশও দিয়েছেন এবং হযরত ওমর রা. এর মত জালিলুল কদর সাহাবী থেকেও এভাবে দোয়া করা প্রমাণিত যেমনটি ইমাম বুখারি রহ. উল্লেখ করেছেন। আর এই ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশই নেই যে, কোন মুসলমান যখন কারো ওসিলায় দোয়া করে তখন সে আল্লাহ তায়ালার কাছেই তার কাক্সিক্ষত বস্তু কামনা করে ওসিলাকৃত ব্যক্তির কাছে নয়।
যেমন কেউ নেক আমলের মাধ্যমে দোয়া করলে (যা সর্বসম্মতিক্রমে বৈধ) সে এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালার কাছেই চায়, আমল শুধু বরকত হিসেবে পেশ করে থাকে। এখানেও ওসিলাকৃত ব্যক্তিকে বরকত হিসেবেই পেশ করা হয়, সে প্রয়োজন পূরণ করে দিবে, কখনই এই উদ্দেশ্যে পেশ করা হয় না। তবে এমন উদ্দেশ্য থাকলে তখন অবশ্যই এটা র্শিক হবে।
বুখারি শরীফের জগদ্বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ: বলেন: হযরত ওমর রা: এর উক্তি সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওসিলা দিয়ে দোয়া করতেন, মোটেই একথা বোঝায় না যে তারা আল্লাহর রাসূলের নিকট বৃষ্টির দোয়া করার আবেদন করতেন। বরং একথারই প্রমাণ বহন করে যে, উভয় অবস্থাতেই তাঁরা আল্লাহর নিকটই বৃষ্টির জন্য দোয়া করতেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওসিলা দিয়ে। (ফাতহুল বারী:খ.২ পৃ. ৬১০)
ওসিলা দিয়ে দোয়া করা জায়েয হওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট হাদীস রয়েছে। পক্ষান্তরে এমন কোন হাদীসই নেই যেখানে ওসিলা দিয়ে দোয়া করার নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে। অথবা এর প্রতি সামান্যতম ইঙ্গিত রয়েছে। সেমতে ওসিলা দিয়ে দোয়া করতে কোন সমস্যা নেই।
লেখক: শিক্ষার্থী ফতোয়া বিভাগ, জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
-এটি