মুফতি আল আমিন রাহমানী।। ঐশী পবিত্রতায় সুসিক্ত হয়ে একটি শিশু পৃথিবীর বুকে আগমন করে। পরম নিষ্কলুষ মানবীয় চরিত্র-মাধুর্য হয়ে থাকে শিশুর আত্মীক ধর্ম।
শিশু যে ‘আসমানি হেদায়াত’ নিয়ে জন্ম লাভ করে তা ধরে রাখা এবং হিংস্র পৃথিবীর বিষাক্ত থাবা থেকে তাকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন সুনিবিড় পরিচর্যা। বাচ্চারা শিশুকালে যে শিক্ষা পায় ভবিষ্যত জীবনের পরতে পরতে তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটে। তাই শিশুকালেই শিশুর কোমল মন-মননে সুশিক্ষার বীজ বপন করে দিতে হয় পরম যতেœ ও সুকৌশলে।
ঐশী ধর্মের পবিত্র আচার-আচরণে শিশুকে অভ্যস্ত করে তুলতে হয়। আর পবিত্র রমজান মাস এর যথোপযুক্ত সময়। কেননা মহিমান্বিত রমজানের আগমনে মুসলিম সমাজের ঘরে ঘরে তৈরি হয় স্নিগ্ধ-পবিত্রতার এক অপার্থিব আবেশ।
বড়োদের ন্যায় মুসলিম শিশুর কচি মনেও রমজানকে ঘিরে থাকে নানা কল্পনা-জল্পনা। রমজান উদযাপনের জন্য ওরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে। শিশুরা পরম আনন্দ নিয়ে পবিত্র রমজানের নতুন চাঁদ দেখতে ছুটে যায়। নতুন চাঁদের বাঁকা হাসিতে নেচে ওঠে ওদের কোমল মনন।
মুআজ্জিনের আযানের ধ্বনি কানে বাজতেই টুপি-পাঞ্জাবী পরে শিশুরা ছুটে চলে মসজিদ পানে। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে রোজা-তারাবি নিয়ে নানা প্রত্যয়-পরিকল্পনার কথা শেয়ার করে। সাহরি-ইফতারকে ঘিরে শিশুদের আনন্দের অন্ত থাকে না। শিশুর ধর্মীয় এ আবেগ অনেক বড়ো সম্পদ। সচেতন অভিভাবকদের উচিত শিশুর এ ভাবাবেগের যথাযথ মূল্যায়ন করা।
রমজান মাস শিশুদের মনে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করা এবং রোজা-নামাজসহ অন্যান্য ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার প্রতি শিশুকে অভ্যস্থ করে তোলার স্বর্ণ সময়।
বাচ্চাদেরকে ধর্মীয় আচারে অভ্যস্থ করে তোলার জন্য নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের শিশুসন্তানদের রোজা রাখার প্রতি সবিশেষ উৎসাহ প্রদান করতেন। রুবাই বিনতে মুআওয়ায ইবনে আফরা রা. বলেন, ‘নবিজী সা. আশুরার সকালে মদিনার আশেপাশে আনসারদের এলাকায় ঘোষণা করলেনÑ ‘যে ব্যক্তি এখনো অনাহার অবস্থায় আছে, সে যেনো আজ রোযা পূর্ণ করে।
আর যে ব্যক্তি ইতোমধ্যে পানাহার করেছে, সে যেনো বাকি দিনটুকু পানাহার থেকে বিরত থাকে।’ এরপর থেকে আমরা আশুরার দিন রোযা পালন করতাম এবং আমাদের ছোটো শিশুদেরকেও রোযা রাখাতাম। আমরা (তাদের নিয়ে) মসজিদে যেতাম এবং তাদের জন্য উল দিয়ে খেলনা তৈরী করে রাখতাম। তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদলে তাকে সেই খেলনা দিয়ে ইফতারের সময় পর্যন্ত সান্ত¡না দিয়ে রাখতাম। (বুখারী, হাদিস নং: ১৯৬০, মুসলিম, হাদিস: ১১৩৬)
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মুমিনীন উমর ফারুক রা. রমজান মাসে এক মদ্যপ ব্যক্তিকে ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন, তোমার জন্য আফসোস! আমাদের ছোটো শিশুরা পর্যন্ত রোজা রাখছে। আর তুমি রোজা না রেখে মদ খাচ্ছ? এরপর তাকে প্রহার করা শুরু করলেন। [হাদিসটি ইমাম বুখারী রহ. ‘শিশুদের রোযা’ শিরোনামের অধীনে উল্লেখ করেছেন]
মহিমান্বিত রমজানের পবিত্র সময়ে শিশুর মানসিক বিকাশ সাধন এবং ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিপালনে অভ্যস্থ করার জন্য এ ক্ষেত্রে অভিভাবকগণ বেশ কিছু বিষয় ফলো করতে পারেন।
১. রোজা ও অন্যান্য ইবাদতের ফজিলত শিশুদের বোধগম্য ভাষায় তাদের সামনে তুলে ধরা। ২. শিশুদের সামনে রমজানের জন্য নিজের কর্মপরিকল্পনা পেশ করা এবং শিশুদের থেকে তদের পরিকল্পনা শোনা। সে কয়টা রোজা রাখবে, কয়টা সুরা মুখস্থ করবে ইত্যাদি।
৩. ধীরে ধীরে রোজা রাখায় অভ্যস্ত করে তোলা। সেক্ষেত্রে প্রথমদিকে দিনের কিছু অংশে রোজা পালন করানো। ক্রমান্বয়ে সেই সময়কে বাড়িয়ে দেয়া।
৪. ভালো কাজে শিশুদের পুরস্কৃত করা। দৈনিক বা সাপ্তাহিক পুরস্কার দেয়ার মাধ্যমে তাদেরকে রোজাসহ অন্যান্য ইবাদত পালনে উৎসাহিত করা।
৫. মসজিদ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া। যাতে সে মসজিদ ও দ্বীনি মজলিসে যাতায়াতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে, শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। বড়োদের যা করতে দেখে তারা তাই করে। এজন্য প্রথমে অভিভাবকদের নিজেদেরও আমলের প্রতি যত্নবান হতে হবে। তাহলে সন্তানও দেখে দেখে শিখে নিবে।
তবে, শিশুকে ধর্মীয় অনুশাসনে অভ্যস্থ করে তুলতে গিয়ে জোড়াজুড়ি বা অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। শিশুর শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্য যেনো কোনোভাবেই ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে সে বিষয়ে যথাযথ লক্ষ্য রাখতে হবে। অন্যথায় হিতে বিপরীত হতে পারে।
আজকের শিশুই আগামী পৃথিবীর কর্ণধার। নীতি-নৈতিকতার সোনালি সেতু পেরিয়ে একটি শিশু পরিণত সোনার মানুষে। তাই আগামীর সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণে শিশুর নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার বিকল্প নেই।
লেখক: শিক্ষক, কাজিপুর আল জামিয়াতুল মাদানিয়া মাদরাসা, সিরাজগঞ্জ।
-এটি