আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: সুলতান দ্বিতীয় সেলিমের সম্মান স্মারক ও মসজিদ স্থাপত্য শৈলীর অনন্য নিদর্শন সেলিমিয়া মসজিদ। ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত স্থাপনার মধ্যে সেলিমিয়া মসজিদ শুধু ওসমানীয় স্থাপত্য নৈপণ্যে অনন্য নয়, বরং বিশ্বের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার এবং মসজিদ নির্মাণ কৌশলের ধারায় সুউচ্চ স্থান দখল করে দাঁড়িয়েছে।
তাজকিরাতুল বুনিয়ান’ নামের মুসলিম স্থাপত্যশৈলী বর্ণনার একটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে আছে, ‘সেলিমিয়া মসজিদের গম্বুজ উচ্চতার দিক থেকে ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়া বা হাজিয়া সোফিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে এবং এর মিনারগুলোও অপ্রতিদ্বন্দ্বী।’
তুরস্কের এর্দিন বা এড্রিন শহরে সেলিমিয়া মসজিদ ১৫৭৪-১৫৭৫ সালে নির্মিত হয়। বিখ্যাত ওসমানি স্থাপত্যবিদ মিমার সিনান মসজিদের চারটি মিনারকে বিশেষ নির্মাণ আঙ্গিকে মেলে ধরেছেন।
পূর্বদিক থেকে অর্থাৎ উসমানি খিলাফতের রাজধানী ইস্তামু্বল থেকে তাকানো হলে মসজিদের দুটি মিনার দেখা যেত, যা ছিল ইসলামের বিনয়-নম্রতার প্রকাশ। আবার পশ্চিম দিক থেকে তাকালে অর্থাৎ খ্রিস্টান বিশ্ব বা ইউরোপের দিক থেকে দেখা যেত চারটি মিনার, যা হলো ইসলামের শক্তির পরিচায়ক।
মুসলিম বিশ্বে তুরস্ক এমন একটি দেশ, যে দেশ একই সঙ্গে ইসলামী ঐতিহ্য ও ইউরোপীয় আধুনিকতায় পরিপুষ্ট। দেশটির অবস্থানও এশিয়া ও ইউরোপে বিস্তৃত।
আর ইউরোপীয় অংশে অবস্থিত এর্দিন বা এড্রিন শহরটি ওসমানি সাম্রাজ্যের একটি ঐতিহ্যবাহী শহর। সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ ইস্তাম্বুল বিজয়ের আগে এই শহরটি ছিল ওসমানি সাম্রাজ্যের রাজধানী। নানান ঐতিহ্য ও স্থাপত্য নিদর্শনে ভরপুর এই শহরটি প্রাচীনত্ব ও আভিজাত্যে অসাধারণ।
বিখ্যাত ওসমানি স্থাপত্যবিদ মিমার সিনানের স্থাপত্য নকশার পরিকল্পিত বাস্তবতা এর্দিন বা এড্রিন শহর। এই শহরের প্রধান স্থাপনা হলো সেলিমিয়া মসজিদ। ইসলামি স্থাপত্য রীতি ও ওসমানীয় কৃতিত্বের গর্বিত অহংকার সেলিমিয়া মসজিদ।
মুসলিম স্থাপত্য নির্মাণের পথিকৃত ওসমানীয় শাসকরা। তাদের প্রধান স্থপতি মিমার সিনান। তিনিই অসংখ্য নির্মাণের কারিগর। এই মিমার সিনানের অনন্য মেধা ও যোগ্যতার জীবন্ত প্রতীক সেলিমিয়া মসজিদ।
১৫৬৮ সালে শুরু হয়ে ১৫৭৪-৭৫ সালে মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। দীর্ঘ সাত বছর প্রায় ১৫ হাজার শিল্পী, কারিগর ও শ্রমিকের অবিশ্রান্ত শ্রম সাধনার নিপুণ স্পর্শে প্রাণবন্ত সত্তার আকার লাভ করে সেলিমিয়া মসজিদ। এই মসজিদের বিশালত্ব, এর আকর্ষণকে আলাদাভাবে প্রকাশ করেছে, এর অভ্যন্তরীণ মূল নামাজকক্ষের কারণে।
মসজিদটির প্রধান গম্বুজের নিচে অবস্থিত মূল কক্ষের উচ্চতা নামাজের জন্য আসা মুসল্লিকে এবং পর্যটককে বিস্মিত করে। মূল নামাজকক্ষের উচ্চতার মাধ্যমে ফুটে ওঠে মিমার সিনানের স্থপতি জীবনের বিশালত্ব।
মসজিদটিতে একসঙ্গে ছয় হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের চারটি মিনারের সবটাতেই আছে তিনটি করে প্লাটফর্ম, যেখান থেকে দাঁড়িয়ে আজান দেওয়া যায়। তবে মিনারগুলো উচ্চতায় দীর্ঘতর হলেও গঠনগতভাবে অনেকটা সরু, যা ইসলামী স্থাপত্য শৈলীতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ঐতিহ্যবাহী সেলিমিয়া মসজিদের আকর্ষণ সৃষ্টিতে ব্যবহৃত হয়েছে এক প্রকার বিশেষ টাইলস। দেয়ালে রয়েছে বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা, ক্যালিওগ্রাফি লতাপাতার সুবিন্যস্ত প্রক্ষেপণ।
সেলিমিয়া মসজিদের গুরুত্ব যে শুধু নামাজের জন্য তা নয় বরং এখানে রয়েছে শিক্ষার জন্য মাদরাসা, সেবা ও চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল, হাম্মামখানা, মুসাফিরখানা ইত্যাদি। মসজিদ কমপ্লেক্সে সংযুক্ত দুটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা মাদরাসা এখন দুটি বিশেষ শাখায় বিভক্ত—ক) দারুল কুরা মাদরাসাটি বর্তমানে ফাউন্ডেশন মিউজিয়াম, খ) দারুল হাদিস মাদরাসাটি বর্তমানে তুর্কি ও ইসলামি আর্ট মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বস্তুত তুরস্কের জাদুঘর শহর (Museum City) হিসেবে খ্যাত এর্দিন বা এড্রিন শহরের শ্রেষ্ঠতম আকর্ষণ সেলিমিয়া মসজিদ, ভ্রমণপিপাষু সবার স্মৃতি ও অভিজ্ঞার সমৃদ্ধ ভাণ্ডার হয়ে স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদের প্রবেশমুখেই আছে স্যুভেনির শপ, যেকোনো পর্যটক এখান থেকে সংগ্রহ করতে পারেন নানা ধরনের স্মৃতিচিহ্নও।
-এটি