জুলফিকার জাহিদ।।
পাকিস্তানের শীর্ষ বুযুর্গ আলেম ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী। ১৯৫৩ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের জংগ জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন৷ তার পিতার নাম আল্লাহ দিতা। তার বাবা হাফেজে কুরআন ছিলেন৷
জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী প্রথমে ছিলেন একজন ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার। ৪০ বছর বয়সে তিনি এই প্রফেশন থেকে অবসর নিয়ে সর্বাত্মকভাবে দ্বীনের রাস্তায় আত্মনিয়োগ করেন। একাধারে হাফেজে কোরআন, আলেম, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার এবং নকশবন্দী তরিকার শায়খ হিসেবে এজাজতপ্রাপ্ত। সবমিলিয়ে এক বিরল ও বৈচিত্রপূর্ণ গুণাবলীর অধিকারী তিনি।
শিক্ষা জীবন:
বড় ভাই মাস্টার আহমদ আলীর তত্ত্বাবধায়নে প্রাইমারী লেখা পড়া শেষ করেন৷ ১৯৬৬ সালেম্যাট্রিক পাশ করেন৷ ১৯৭১ সালে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে বি,এস ও ১৯৭৬ সালে ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে বি,এস পাশ করেন৷ এছাড়াও তিনি লম্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিউম্যান রিসোর্স কোর্স সম্পন্ন করেন৷
আধুনিক জ্ঞানের পাশাপাশি তিনি একজন হাফেজে কুরআন৷ মুফতি ওলী উল্লাহ ও মুফতি জামিল আহমদ থানবীর কাছে পড়াশোনা করেন জিয়াউল উলুম নামক মাদরাসায়।
আল্লাহ তায়ালার প্রতি অসামান্য মুহব্বত, রসূলের সুন্নতের প্রতি ঐকান্তিক আগ্রহ ও আত্মত্যাগ, পুঙ্খানুপুঙ্খ শরীয়তের অনুসরণ এবং তার সাথে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে তার অসংখ্য মুরিদ ও ছাত্র। পৃথিবীর আনুমানিক ৩০টি দেশে ইংরেজি এবং উর্দুতে তিনি ইসলামিক বিষয়ে অসখ্য বক্তব্য রেখেছেন এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছেন।
প্রতি বছর মালয়েশিয়ায় ৩ দিনের ইজতিমা হয়ে থাকে যেখানে শায়খ যুলফিকার আহমেদ নকশবন্দী- এর উপস্থিতি এবং বক্তব্য এক বিশেষ আকর্ষণ। বর্তমানে যখন পীর সাহেবদের মধ্যে বই লেখার প্রচলন খুবই কম এমন সময়ে তিনি আনুমানিক ১৫টিরও বেশি বই তিনি নিজে লিখেছেন। এছাড়া তার অসংখ্য ইসলামিক বিষয়ের আলোচনা সম্বলিত উর্দু বয়ানের অনুবাদ বাংলায় হয়েছে যা ৩২ খন্ড “খুতবাতে জুলফিকার” নামে বাংলা ভাষায় সহজলভ্য।
পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দীর হাদিসের সনদ
তিনি বুখারি পড়েছেন হাফিযুল কোরআন ওয়াল বুখারী শাইখুল হাদিস আল্লামা ইয়াকির সাহেবের কাছে জামিয়া জিয়াউল উলুম পাকিস্তানে৷ তখন সবে মাত্র পাকিস্তান বেফাক বোর্ডের জন্ম৷ তিনি বার বার তার উস্তাদকে বলেন যে হযরত আমার ইচ্ছা বেফাক বোর্ডে দাওরা পরীক্ষা দিব৷ কিন্তু উস্তাদ জবাবে বলেন যে, তুমি সনদ চাও না ইলম চাও৷ তখন নকশবন্দী বলেন, হযরত ইলম চাই৷ উস্তাদ বলেন, তাহলে আমি যে ইলম তোমাকে দান করেছি এতে সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই৷ আমিও কোন বোর্ডে পরিক্ষা দেইনি৷
সেই সময় পাকিস্তানের অনেক মাদরাসা বেফাক বোর্ডে যোগ দেয়নি৷ উস্তাদের কথা মেনে তিনি বেফাক বোর্ডের পরীক্ষা হযরত অংশ গ্রহণ করেননি৷ অন্যথায় বোর্ডের ফাস্ট ছাত্র হওয়ার সম্ভবনা ছিল।
হযরতকে পাকিস্তানের দুটি প্রসিদ্ধ মাদরাসা দাওরায়ে হাদিসের সনদ দিয়েছে৷
এক: জামিয়া রহমানিয়া জাহানিয়া মিন্ডী৷ দুই: জামিয়া কাসিমুল উলুম মুলতান৷
এদিকে তার রয়েছে হাদিসের চারটি আলি সনদ :
১) দারুল উলুম ওয়াকফ দেওবন্দের সাবেক মুহতামিম ও শাইখুল হাদিস মাওলানা সালিম কাসিমী রহ. স্বয়ং তাকে তার খাস কামরায় নিয়ে হাদিসের দরস দিয়ে সনদের ইজাযত প্রদান করেন৷
২) হারামে মক্কার এক সময়ের শাইখুল হাদিস আহমদ আলী (ভারত) তাকে হাদিসের ইজাযত দেন৷ যার কাছ থেকে স্বয়ং তাকি উসমানি হাদিসের ইজাযত নিয়েছেন৷ এ সনদে রয়েছেন ফজলুর রহমান গনজে মুরাদাবাদী রহ. ৷
৩) তুর্কিতে তাকে হাদিসের ইজাযত দিয়েছেন শায়খ আমিন সিরাজ যিনি যাহিদ আল কাওসারি রহ.- এর সর্ব শেষ ছাত্র৷
৪) বুখারার সমরকন্দে সিরিয়ার আরেক শায়খ তাকে হাদিসের ইজাযত দিয়েছেন৷ যা মাত্র পনের সনদে রাসুল সা. পর্যন্ত পৌঁছে৷ এ সনদে রয়েছেন আল্লামা শামী রহ.৷ অথচ উপমহাদেশে বিশ ওয়াসিতা-এর কমে সনদ নেই৷
খেলাফত:
১৯৪৩ সালে খাজা গোলাম হাবীব নকশবন্দী রহ. তাকে খেলাফত ও ইজাযত দান করেন৷ যুবক বয়সে জুলফিকার আহমদ নকশবন্দির এক শত বার রাসুল সা.- এর যিয়ারত নসিব হয়েছে৷
সাউদি আরব, মিসর, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, নেপাল, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আমেরিকা (২২ প্রদেশ), উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাকিস্তান, গিরগিস্তান, তাতারিস্তান, রাশিয়া, ইউক্রেন, আফগানিস্তান, হাঙ্গেরি, ব্রিটেন, জার্মান, নরওয়েসহ প্রায় ৭০ টি রাষ্ট্রে দাওয়াতী সফর করে ইসলাম সম্পর্কে সারগর্ভ আলোচনা করেছেন।
লক্ষ লক্ষ মানুষ তার কাছে তাওবা করেছেন৷ অনেকে তার হাতে মুসলমান হয়েছেন৷ বিশ্বে তার দেড়শত খুলাফা রয়েছেন৷
তার মধ্যে অন্যতম হলেন করাচিতে মুফতি আবু লুবাবা যিনি পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ দরসগাহ জামিয়াতুর রশীদের মুহাদ্দিস ও মুফতি৷
ভারতে মাওলানা খলিলুর রহমান সাজ্জাদ নুমানী৷ যিনি মাওলানা মনজুর নুমানী রহ. এর ছেলে, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের তরজুমান ও মাসিক আল ফুরকানের সম্পাদক।
সাউথ আফ্রিকায় মাওলানা ইমাম শামিল, লাহোরে মাওলানা ডঃ শাহেদ ওয়াইসি৷ চকওয়ালে মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস। আযাদ কাশ্মীরে মাওলানা মুফতি গোলাম রসুল৷
তিনি যখন মাওলানা ফজলুর রহমান সাহেবকে ইজাযত প্রদান করেন তখন তিনি বলেন, সিয়াসত মে ওহ মেরা ইমাম হায় আওর রিয়াজত মে ময় উসকা ইমাম হায়৷
১৯৮৪ সালে দারুল উলুম জংগ নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি৷ ১৯৮৬ সালে জামিয়া আয়েশা সিদ্দিকা নামে মেয়েদের জন্য আলাদা মাদরাসা নির্মাণ করেন৷ যার পরিচালক হলেন তার স্ত্রী৷
মাহাদুল ফকির আল ইসলামিয়া নামে জংগে একটি জামিয়া নির্মাণ করেন৷ যেখানে দারুল ইফতা সহ অনেক গুলো শাখা রয়েছে৷
১৯৯৯ মাকতাবাতুল ফকির নামে একটি প্রকাশনা চালু করেন৷ যেখান থেকে লক্ষাধিক কিতাবাদি ছাপা হয়েছে৷
তিনি খাজা মুহাম্মদ আব্দুল মালিক সিদ্দিকীর মেয়ে বিবাহ করেন৷ তার দুই ছেলে মাওলানা পীর হাবীবুল্লাহ ও মাওলানা পীর সাইফুল্লাহ৷
এনটি