ওমায়ের আহমেদ।।
তালবিয়ার সাথে কে না পরিচিত? হজ্বের মাসে মসজিদে মসজিদে হজ্বের অনুশীলন হয় এবং ফাযাইল ও মাসাইলের আলোচনা হয়। তালবিয়ার প্রসঙ্গ তখন অপরিহার্যভাবে আসে এবং আলোচক-শ্রোতা সবার কণ্ঠে তালবিয়া ধ্বনিত হয়। এ কারণে মুসলিম সমাজের ছোট-বড় সকলেই তালবিয়ার সাথে পরিচিত। আর আল্লাহ যাদের দান করেছেন হজ্বের সৌভাগ্য তাদের কথা তো বলাই বাহুল্য। তালবিয়ায় তাদের ইহরামের সূচনা; তালবিয়া তাদের হজ্বের সঙ্গীত।
এ হজ্ব-সঙ্গীত অতি প্রাচীন, যুগে যুগে তা ধ্বনিত হয়েছে আল্লাহর ঘরের মুসাফিরদের কণ্ঠে ও হৃদয়ে। এ মুসাফির দলের অগ্রভাগে আছেন মানবজাতির সর্বোত্তম অংশ, আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দা-নবী ও রাসূলগণ। মাঝে আছেন সাহাবা-হাওয়ারিয়ীন এবং শুহাদা-সালেহীনের মোবারক জামাত আর শেষে আছে পাপী তাপী নিঃস্ব ভিখারীর দল। সবাই এক আল্লাহর বান্দা, সকলের কণ্ঠেই ধ্বনিত তালবিয়া-সঙ্গীত-‘লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক’।
আমাদের পরম সৌভাগ্য, আমরা আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত। তাঁর অনুসরণের মাধ্যমে আমরা অনুসারী সকল নবী ও রাসূলের। তাঁরই স্বর্ণসূত্রে আমরা যুক্ত নবী-রাসূলের সোনালী ধারার সাথে। আজ আমরা যে তালবিয়া পাঠ করি-আল্লাহ আমাদের কলব ও যবানের সকল মলিনতা দূর করে দিন-হুবহু এই বাক্যগুলো উচ্চারিত হয়েছিল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পাক যবানে। বড় বড় সাহাবী তা গ্রহণ করেছেন ও বর্ণনা করেছেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মোবারক যবান থেকে তালবিয়া শিখেছি। তিনি বলতেন-
لَبَّيْكَ اَللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لا شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لا شَرِيْكَ لَكَ
-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৫৪০, ১৫৪৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৮৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৯১৮
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা., হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. ও হযরত আনাস রা.ও এই তালবিয়া বর্ণনা করেছেন। (দেখুন ১. মুসনাদে আহমদ ১/৪১০; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৮/২১১; সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ৩৭৩২২; ২. সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৬২৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১৮১৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৯২৯; ৩. আবু ইয়ালা-মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস : ৫৩৬৪)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. নিজের সঙ্গীদেরকে এই তালবিয়া শেখাতেন। দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা,আসওয়াদ রাহ.-এর সূত্রে, হাদীস : ১৩৬৪২
এ তালবিয়া আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তালবিয়া, সাহাবায়ে কেরামের তালবিয়া, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের তালবিয়া এবং সকল যুগের নেককার-সালেহীনের তালবিয়া। এ সোনালী ইতিহাস হৃদয়ে ধারণ করে আল্লাহর ঘরের মুসাফির যখন তালবিয়া পাঠ করবেন তখন তার অবস্থাই হবে ভিন্ন-তার হৃদয় হবে প্রশান্ত, মস্তিষ্ক হবে আলোকিত এবং প্রাণ ও আত্মা হবে পরিতৃপ্ত। এটি এ মোবারক তালবিয়ার প্রথম গুণ।
তালবিয়ার শব্দ ও বাক্য
তালবিয়ায় ‘লাববাইক’ শব্দটি চারবার আছে। এটি একাধারে ভক্তি ও ভালবাসা এবং আনুগত্য ও সমর্পণের ভাব ধারণ করে।
‘লা-শারীকা লাক’ শব্দটি আছে দুইবার। এ হচ্ছে সকল প্রকার শিরক ও শরীককে বর্জনের ঘোষণা। শরণ ও প্রার্থনা এবং আনুগত্য ও উপাসনা কোনো বিষয়েই আল্লাহর কোনো শরীক নেই। তিনি লা-শরীক।
আর তৃতীয় বাক্যটি অর্থাৎ ‘ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক’ হচ্ছে তাওহীদের এ’লান, তাওহীদের দলিল এবং আল্লাহর হামদ ও শোকর।
বাংলায় উচ্চারণ ও অর্থসহ তালবিয়া-
i) لَبَّيْكَ ا للّهُمَّ لَبَّيْكَ
ii) لَبَّيْكَ لاَ شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ
iii) اِنَّ الْحَمدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ
iv) لاَ شَرِيْكَ لَكَ
তালবিয়ার উচ্চারণ-
১. লাব্বাইক আল্লা-হুম্মা লাব্বাইক,
২. লাব্বাইক, লা-শারি-কা লাকা লাব্বাইক,
৩. ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নি`মাতা লাকা ওয়াল-মুল্ক,
৪. লা শারি-কা লাক।"
তালবিয়ার অর্থ-
১. আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত!
২. আপনার ডাকে সাড়া দিতে আমি হাজির। আপনার কোন অংশীদার নেই।
৩. নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও সম্পদরাজি আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্য আপনার।
৪. আপনার কোন অংশীদার নেই।
তালিবায়া পড়ার নিয়ম-
ইহরামকারীর পক্ষে বেশি বেশি তালবিয়া পাঠ করা সুন্নাত। পুরুষ ও মহিলা স্বশব্দে তা পাঠ করবে যতক্ষণ না ফিতনার আশংকা দেখা দেয়, কখনও তালবিয়া পাঠ করবে, কখনও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর জিকির করবে, আবার কখনও তাকবির পড়বে।
বাইতুল্লাহ তাওয়াফ শুরু হওয়ার সাথে সাথে ওমরার তালবিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। আর হজের তালবিয়া মিনায় শেষ কংকর বা পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে বন্ধ হবে। সূত্র: আল কাউসার, ফতওয়ায়ে শামী।
এনটি